অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়েছিলেন। দেশ পরিচালনায় এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত জানার জন্য প্রধান উপদেষ্টার এই প্রচেষ্টা সঙ্গত কারণেই মানুষকে কৌতূহলী করেছে। এই সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের অতীতের কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টগুলোর অনেকটা পার্থক্য রয়েছে। অতীতের সরকারগুলোর সামনে একমাত্র লক্ষ্য ছিলো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। তাদের সংস্কার চিন্তা করতে হয়নি। এমনকি তারা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যও প্রয়োজনীয় আইন বিধি-বিধান তৈরি পেয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকারকে গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সংস্কারের মতো গুরু দায়িত্বও পালন করতে হবে। আগের কেয়ারটেকার সরকারগুলো নিয়মিত কাজগুলো ছাড়া অন্যান্য কাজ করতে বাধ্য ছিলো না। কিন্তু বর্তমান সরকারকে একটি নির্বাচিত সরকারের মতো সর্ববিষয় পরিচালনা করতে হচ্ছে। আরো একটি ভিন্ন দিক হচ্ছে এই সরকার একটি বিপ্লবের ফসল। তাদের নিয়মিত কাজের বাইরে আগামী রাজনৈতিক সরকারের দিকনির্দেশনাও তৈরি করতে হচ্ছে।
দায়িত্বের ক্ষেত্র বেশি হলেও সরকারের আয়তন ছোট। ফলে তাদের কাজের চাপ বেশি। এই সরকারে দেশের সেরা সেরা মানুষগুলোকে এই উপদেষ্টা পরিষদে রাখা হয়েছে, তবে রাজনীতির ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা তেমন নেই। যে কারণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত গ্রহণ জরুরি। সেই বিবেচনাতেই প্রধান উপদেষ্টা এবারো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এভাবে মিলিত হয়েছেন।
রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে অগ্রাধিকারযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে সরকার কী কী করতে পারে সেগুলোর মোটামুটি একটি খতিয়ান উপস্থিত করেছে। বিশেষ করে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। এক্ষেত্রে গত রোববার সরকারের একজন উপদেষ্টার বক্তব্যের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। তিনিও বলেছেন, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার অত্যন্ত জরুরি।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন গত ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করার পর নির্বাচন কমিশন শূন্য হয়ে পড়েছে। মাসাধিককাল গত হওয়ার পরও নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন হয়নি এখনো। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের চেয়ে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণেই হয়তো সরকার নির্বাচন কমিশন গঠনের দিকে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে যাচ্ছে না। প্রচলিত নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক আছে। অতীতে দেখা গেছে নির্বাচন কমিশন যে সরকারই গঠন করুক না কেন সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার ঘাটতি থেকেই যায়। যে দল ক্ষমতায় থাকে তারা তাদের পছন্দমাফিক লোক দিয়ে কমিশন গঠন করে।
নির্বাচন শেষে পরাজিত দলগুলো নির্বাচন কমিশনকে সমালোচনা করে। এমনকি সরকারের বাইরে থাকা দলগুলো নির্বাচনের আগেই তাদের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে থাকে। নির্বাচন শেষে তারা তাদের বক্তব্যই যে ঠিক ছিলো তাও প্রমাণে চেষ্টা করে থাকে। নির্বাচনি আইনগুলো নিয়েও সমালোচনা হয়, আচরণবিধি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়। বিশেষ করে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোকে প্রায় নিয়মিত অভিযোগ করতে শোনা যায়-নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড দেওয়া হয় না। এটি মূলত দলীয় সরকার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন হলে বেশি হয়। গত কয়েকটি নির্বাচনে মনে হয় নির্বাচনে কারচুপির চেয়ে এই অভিযোগটি কম উচ্চারিত হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে তুলনামূলক এই অভিযোগটি অনুপস্থিত থেকেছে। তারপর আছে নির্বাচনে কারচুপি, ব্যালট ছিনতাইসহ নানা অপকর্মের খতিয়ান। এই অভিযোগ দলীয় সরকারের অধীনে কিংবা নির্দলীয় সরকারের অধীনে যে কোনো অবস্থায়ই নির্বাচন হোক না কেন, সবসময়ই হয়ে থাকে। এই মুহূর্তে নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল বিষয়েও বলতে হয়। নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে কোনো অভিযোগ দায়ের হলে এমনও দেখা যায়-সরকারের মেয়াদান্তে সেই অভিযোগের ফয়সালা হয়। অভিযোগকারী রায়ের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মনে ক্ষোভ থাকার পরও পারতপক্ষে কোনো অভিযোগ দায়ের করতে আগ্রহ পায় না।
নির্বাচনে কারচুপি একটি সাধারণ অভিযোগ। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে কমবেশি এই অভিযোগ হবেই। অন্তত বিগত সময়ের নির্বাচনগুলোর দিকে নজর দিলে সেটি দেখা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হলে সরকারের সুবিধাভোগী কোনো পক্ষ যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে থাকে তাহলে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড আশা করাটা দুরূহ। সেই কথাটি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলো বলে আসছে। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যাওয়ায় মানুষের চাওয়াটা পূরণ হয়নি। অতীতের নির্বাচনগুলো বিশ্লেষণ করে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনি প্রচারণায় সবাই যেন সুযোগ পায় সেই ব্যবস্থাটি করতে হবে এই সরকারকেই। যে কারণে হয়তো বিএনপি মহাসচিব নির্বাচন বিষয়টিকে এক নম্বর অগ্রাধিকার তালিকায় রাখার জন্য অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছেন। যা তাদের নিয়মিত বক্তৃতাণ্ডবিবৃতিতেও বার বার উল্লেখ করে আসছে।
লেখক : সাংবাদিক, শিশু সাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।