ঢাকা ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হান কাং : নোবেল ও অনন্য সাহিত্যকর্ম

আরিফ আনজুম
হান কাং : নোবেল ও অনন্য সাহিত্যকর্ম

২০২৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন হান কাং তার বিখ্যাত উপন্যাস The Vegetarian এর জন্য। এই অসাধারণ উপন্যাসটি তাকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। সুইডিশ একাডেমি তার রচনাকে ‘কাব্যিক গদ্যের অসামান্য শক্তি, যা মানবজীবনের দুর্বলতা ও ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডিকে তুলে ধরে’ বলে অভিহিত করেছে।

লেখক পরিচিতি

হান কাং ১৯৭০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ছোটবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। তার বাবা হান সেউং-উনও একজন লেখক ছিলেন, এবং লেখালেখির জগতে প্রবেশ করতে তার এই পারিবারিক প্রেক্ষাপটের প্রভাব ছিল। হান কাং-এর প্রথম প্রকাশিত কাজটি ১৯৯৩ সালে একটি সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং এরপর থেকেই তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় সুপরিচিত একজন লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন।

The Vegetarian এবং এর প্রভাব

The Vegetarian উপন্যাসটি তিনটি ভাগে বিভক্ত, যেখানে কাহিনী আবর্তিত হয় একজন মহিলার চারপাশে, যিনি আচমকা নিরামিষভোজী হয়ে যান। এটি তার পরিবার এবং সমাজে এক ধরনের উত্তাল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। উপন্যাসটি তার চরিত্রের আধ্যাত্মিক এবং মানসিক পরিবর্তনকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করে, যা পাঠকদের গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করে। এটি হান কাং-এর আন্তর্জাতিক পরিচিতি এনে দেয় এবং ২০১৬ সালে তিনি আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারও পান। এই উপন্যাসটি কেবল দক্ষিণ কোরিয়া নয়, বরং বিশ্ব জুড়েই আলোচিত হয় এবং বিশ্বসাহিত্যের পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।

হান কাংয়ের লেখার বৈশিষ্ট্য

হান কাংয়ের সাহিত্যকর্মে মূলত মানুষের অস্তিত্বের জটিলতা, শারীরিক ও মানসিক সঙ্কট এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা স্থান পায়। তিনি সাধারণত এমন চরিত্র নির্মাণ করেন, যারা তাদের পরিচিতি এবং ব্যক্তিগত জীবনে সংগ্রাম করে এবং এক ধরনের অব্যক্ত যন্ত্রণা অনুভব করে। তার লেখা প্রায়ই ভীষণ অনুভূতিপ্রবণ এবং গভীর অর্থবহ। তার সাম্প্রতিকতম বই We Do Not Part আরও পাঠক প্রিয়তা পাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কারণ এটি কোরিয়ার সামাজিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতার গভীরে প্রবেশ করে।

উল্লেখযোগ্য বইসমূহ

The Vegetarian : হান কাংয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং আলোচিত বই The Vegetarian, যেখানে ইয়ং হে নামে এক নারীর গল্প বলা হয়েছে, যিনি আচমকা নিরামিষভোজী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে তার জীবন এবং চারপাশের সম্পর্কগুলোর মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়। উপন্যাসটি কেবলমাত্র খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন নয়, বরং এর মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, শারীরিক ও মানসিক সংঘাত এবং সামাজিক বাধার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে।

Human Acts : এই উপন্যাসটি ১৯৮০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার গ্বাংজু বিদ্রোহের ওপর ভিত্তি করে রচিত। এখানে বিভিন্ন মানুষের জীবনকে এই গণঅভ্যুত্থানের প্রভাবের প্রেক্ষিতে তুলে ধরা হয়েছে। এটি একটি আবেগঘন ও শক্তিশালী উপন্যাস যা হান কাং-এর রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বোঝা যায় এবং মানবাধিকার ও মানবতার গভীর মূল্যবোধের দিকে ইঙ্গিত করে।

The White Book : এটি হান কাংয়ের একটি আত্মজৈবনিক ধাঁচের কাজ, যেখানে তিনি তার মৃত বোনের স্মৃতিচারণ এবং ব্যক্তিগত অনুভূতির বিবরণ দিয়েছেন। বইটি সাদা রঙের বিভিন্ন প্রতীকী অর্থ নিয়ে লেখা হয়েছে, যা মানব জীবনের নান্দনিকতাকে উপলব্ধি করানোর চেষ্টা করে। এটি তার জীবন এবং মৃত্যুর অভিজ্ঞতা, শোক এবং হারানোর ব্যথাকে সংবেদনশীলভাবে উপস্থাপন করে।

We Do Not Part : হান কাং-এর সাম্প্রতিকতম এই কাজটি পাঠকদের জন্য একটি নতুন প্রস্তাবনা। এটি তার পূর্বের লেখাগুলোর মতোই গভীর অনুভূতিতে পূর্ণ এবং মানবজীবনের অসীমতা ও বিচ্ছেদের মতো বিষয়বস্তুর ওপর আলোকপাত করে। হান কাং নিজে এই বইটি পাঠকদের জন্য প্রাথমিক পরিচয় হিসেবে সুপারিশ করেছেন, কারণ এটি তার অন্যান্য কাজের সাথে গভীর সম্পর্কযুক্ত বলে তিনি মনে করেন।

হান কাংয়ের সাহিত্যের যাত্রা তাকে শুধুমাত্র কোরিয়া নয়, সারা বিশ্বে পরিচিত করেছে।

তার সাহিত্যকর্মের মধ্যে সমাজের গভীর স্তরে লুকিয়ে থাকা সঙ্কট, মানবিক অনুভূতির অন্তর্গত দ্বন্দ্ব এবং ইতিহাসের কঠিন বাস্তবতা রয়েছে। ২০২৪ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার তাকে আরও বিশিষ্ট স্থানে নিয়ে গেল, যা কোরিয়ার সাহিত্যিকদের আন্তর্জাতিক ভাবে সম্মানিত হতে উদ্বুদ্ধ করবে।

লেখক : কথা সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত