রাজধানীতে অসহনীয় যানজট

কার্যকরী পদক্ষেপ জরুরি

প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

রাজধানী এখন গাড়ি ও রিকশার শহরে পরিণত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর গাড়ি ও রিকশার সংখ্যা কত যে বেড়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। গাড়ি, রিকশার এই বেপরোয়া উপস্থিতিতে রাজধানীবাসীর ভোগান্তি চরমে উঠেছে। একে তো রাজধানীর রাস্তাঘাট বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে ভেঙেচুরে এক শেষ। তদুপরি বিভিন্ন সংস্কার উন্নয়নের নামে কাটাকাটিতে খানাখন্দ সৃষ্টি হয়ে চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে ভয়াবহ যানজট নগর জীবনকে রীতিমতো স্থবির করে দিয়েছে। ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল- কোনো কিছুই কাজে আসছে না, যদিও যানজট নিরসনের কথা বলেই এগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। রাজধানীর গতি বাড়ানোর চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালে ঢাকায় গাড়ির গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে। বর্তমানে গতি যে আরো কমেছে, তা বলাই বাহুল্য। এখন ২০ মিনিটের রাস্তা যেতে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যায়। এ অবস্থায় এমন এক সময় আসতে পারে, যখন রাজধানী পরিত্যক্ত ঘোষিত হতে পারে। রাজধানীর রাস্তাঘাটের যে সক্ষমতা বা সামর্থ্য, তার চেয়ে যানবাহনের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে যানজট অবধারিত ও অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আগে থেকেই অতিরেক যান চলাচল ছিল; ক্রমে তা বেড়ে বিশৃঙ্খলা ও অচলতা দুর্বিষহ করে তুলেছে। ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরে ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের জবানিতে বলা হয়েছে, যানজটের প্রধান কারণ ব্যাটারিচালিত রিকশা। এরইমধ্যে ৮ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা রাজধানীতে প্রবেশ করেছে। রাইড শেয়ারিংয়ের নামে প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল চলাচল করছে ১৫ লাখ। ঢাকার বাইরে সিএনজি অটোরিকশা চলছে প্রায় ২৫ হাজার। ফিটনেসবিহীন ও রুটপারমিটহীন বাস-মিনিবাস প্রায় এক হাজার। ভুয়া কাগজপত্রের লেগুনা চলছে প্রায় ৫ হাজার। পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, পতিত স্বৈরাচারের দোসররা রাজধানীকে অচল ও জনদুর্ভোগ সর্বোচ্চ মাত্রায় বাড়ানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে গাড়ি, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটো, সিএনজি ইত্যাদি রাজধানীতে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ফিটনেসবিহীন ও অবৈধ বাস-মিনিবাস রাস্তায় নামিয়েছে এদের মালিকরা। অন্তর্বর্তী সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন ও ব্যর্থ করার জন্যই এটা করা হয়েছে বলে তাদের ধারণা।

কারণ বা পতিত স্বৈরাচরের দোসরদের হীন চক্রান্ত, যাই থাক, অন্তর্র্বতী সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রাণালয়, বিভাগ ও কর্তৃপক্ষও মওজুদ আছে। তাদের উপদেষ্টারাও আছেন। মন্ত্রণালয় তবে কী করছে, উপদেষ্টারাই বা কী করছেন, সঙ্গতকারণেই সে প্রশ্ন উঠতে পারে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান রাস্তাসমূহে আগেই ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোরিকশা এবং কোনো কোনো রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ বা নিয়ন্ত্রিত ছিল। এখন আর কোথাও নিষেধাজ্ঞা ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকর নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস এরইমধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে রাজধানীর রাস্তাঘাটে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির তরফে বলা হয়েছে, মালিকদের এক মাসের সময় দিয়ে আনফিট ও চলাচল-অযোগ্য গাড়ি রাস্তা থেকে তুলে নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল এবং পুলিশকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছিল। বাস্তবে মালিকরা কথা শোনেনি এবং পুলিশ কর্তৃপক্ষও ব্যবস্থা নেয়নি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষে অবশ্য বলা হয়েছে, ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ৬৫০০ বাস ও ৫০, ০০০ ব্যাটারি চালিত রিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এত বাস ও ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি কেন? পরিস্থিতি দিনকে দিন নাজুকই হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যাত্রীসংখ্যার চেয়ে যানবাহনের সংখ্যা কম হওয়ায় ফিটনেসবিহীন ও চলাচল-অযোগ্য বাস-মিনিবাস সম্পূর্ণ রহিত করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই, বিকল্প গণপরিবহন নিশ্চিত করা এ মুহূর্তে জরুরি। ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোর চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও সীমিত করতে হলে বিদ্যুৎ বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ব্যাটারিতে বিদ্যুৎ ভরার অসংখ্য স্থান বা দোকান গড়ে উঠেছে। কঠোর অভিযান চালিয়ে এসব দোকান বন্ধ করতে হবে। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে, যাতে ব্যাটারিতে কেউ বিদ্যুৎ ভরতে না পারে। একইসঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোর যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে। ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটো মূল্যবান বিদ্যুৎই নিচ্ছে না, সেই সঙ্গে যানজট ও দুর্ঘটনারও প্রধান কারণ হিসেবে ভূমিকা রাখছে।

রাজধানীর রাস্তাঘাটে শৃঙ্খলা ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ভূমিকা অত্যন্ত বেশি। পুলিশ ইচ্ছা করলে, দায়িত্বশীল হলে সড়ক ব্যবস্থাপনা জনআকাঙ্ক্ষার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে। রাজধানীসহ সারাদেশের ট্রাফিক ব্যবস্থা যথাযথ মানের নয়। ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যাও যথেষ্ট নয়। আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থা ও প্রয়োজনমতো ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা নিশ্চিত করা গেলে পরিবহন ও সড়ক ব্যবস্থাপনা সহজ ও মসৃণ হতে পারে। রাস্তাঘাটে শৃঙ্খলা ও যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মালিক, শ্রমিক, চালক- সবারই সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রত্যেকেই আইন ও নির্দেশিকা মেনে চললে যানজট ও ভোগান্তি কমতে বাধ্য। এ কথা মনে রাখা দরকার, রাজধানীর রাস্তাঘাটে যানজট ও অব্যবস্থাপনা পুরনো একটি সমস্যা। এ সমস্যা অনেক সমস্যার জন্ম দিচ্ছে, অনেক রকম ক্ষতি হচ্ছে। বিআইডিএস’র এক প্রতিবেদন মতে, রাজধানীতে যানজটের কারণে বছরে ক্ষতি হয় এক লাখ এক হাজার ৬৬ কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ দশমিক ৯ শতাংশ। এ কারণে মাথাপিছু আয় কমছে, প্রবৃদ্ধি কমছে, দারিদ্র্য বিমোচনের হার কমছে। একইসঙ্গে অপূরণীয় মানসিক ও শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে নগরবাসীর। কাজেই, যানজট নিরসনের বিকল্প নেই। আমরা আশা করবো, অন্তর্র্বতী সরকার যানজট নিরসন, রাস্তাঘাটে শৃঙ্খলা ও সহজ যাতায়াত নিশ্চিত করতে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ অবিলম্বে গ্রহণ করবে।