মধ্যপ্রাচ্যের অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল। ইসরাইলিরা জোর করে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করে ইসরাইল রাষ্ট্র। সমর্থন দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধু দেশগুলো। উল্লেখ্য, ইসরাইলিদের হাতে যুগ যুগ ধরে মার খাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা, গৃহহীন হচ্ছে, মরছে পাখির মতোই। তাদের শক্তি নেই-মদত নেই। এভাবেই লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিরা নিজ দেশে উদ্বাস্তু হচ্ছে। ক’দিন পর পর বর্বর ইসরাইলিরা নামমাত্র উসিলায় আক্রমণ করে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে যাচ্ছে। গেল বছরে শুরু হওয়া আক্রমণেও হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হচ্ছে-আহত হচ্ছে হাজার হাজার কিন্তু বিশ্ববাসী নীরব, নীরব বিশ্বের নামিদামি মানবাধিকার সংস্থাগুলোও। তারা বাংলাদেশে র্যাবের মতো প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করার পরামর্শ দিয়ে থাকলেও যেখানে হাজার হাজার নিরিহ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারাচ্ছে ইসরাইলি বর্বরতায় সেখানে তারা নীরব? বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোও কথা বলছে না একমাত্র তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধান রিসেপ তাইয়েরা এরদোয়ান ছাড়া অন্য কেউ। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইসরাইল ফিলিস্তিনে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালাচ্ছে। তিনি এর কড়া সমালোচনাও করেন। এদিকে জাতিসংঘ নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। দেখছেন এবং হাসছেন-মরছে তো মুসলমান। তাদের ভাষায় এরা তো মানুষ নয়, মুসলমান? ভাইজেন তো সরাসরি সাহায্য করছে ইজরাইলকে।
ইসরাইলের স্থায়ী বন্দিশালা ও মানুষ শিকারের খামার খাজার রাফা এলাকা। আবু জেহাদ পরিবার থাকে রাফার একটি দ্বিতল ভবনে। পেশাগত জীবনে তিনি স্কুলশিক্ষক। আবু জেহাদ পরিবারে পাঁচ সদস্য। স্ত্রী আয়েশা এবং তিন ছেলেমেয়ে। মেয়ে সবার ছোট। বয়স সাত। দুই ছেলের বয়স ১১ এবং ১৩। সবাই রোজাদার, এমনকী সাত বছরের মেয়ে শিশুটিও। বেগম জেহাদ ইফতারি সাজিয়ে বসেছেন। ইফতারের বেশি বিলম্ব নেই। কয়েক মিনিটের মধ্যে পাড়ার মসজিদে সাইরেন বাজলেই তারা ইফতার করবেন। সাইরেন বাজার সাথে সাথে তারা ঠান্ডা লাচ্ছির গ্লাসে চুমুক দিয়েছেন। কয়েক ঢোক শীতল মিষ্টি পানি সারা দিনের তৃষ্ণার্ত পাকস্থলিতে অনির্বচনীয় শান্তির আবেশ ছাড়িয়ে দিয়েছ। এমন সময়ে তীক্ষè শব্দের ঝড় তুলে ভারি একটা বস্তু বাড়ির ছাদে আছড়ে পড়ে। পরপরই প্রচন্ড বিস্ফোরণে কয়েক দফা হিক্কা তুলে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে পুরো বাড়ি। একই সাথে আগুনের দখলে চলে যায় পুরো বাড়ি। বিস্ফোরণের প্রথম ধাক্কায় শহীদ হন পরিবারের সবাই চেয়ার টেবিল উল্টে আছড়ে পড়েন মেঝেতে। আগুন-রক্তস্রোত আর অভুক্ত খাবারে মাখামাখি হয়ে ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো খাবি খেতে খেতে মারা যান সবাই। পুত্র কন্যার সাথে জেহাদ দম্পতি প্রথমে রক্তাক্ত মাংসপিন্ড এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে পোড়া মাংসের রোষ্ট হয়ে পড়ে থাকেন। গত মঙ্গলবার ভোর থেকে ‘অপারেশর প্রোটেক্টিভ এজ’ নামে গাজায় আগ্রাসী অভিযান শুরু করে আগ্রাসী ইসরাইল। প্রথম দিন দফায় দফায় গাজায় ৪৫০ বার বিমান হামলা চালায় ইসরাইলের জঙ্গি বিমান বহর। পবিত্র রমজান মাসের ইফতার সেহরিসহ দিনের এই বর্বরতম হামলায় প্রথম দিনেই শিশু কিশোরসহ নিহত হন ৩০০ ফিলিস্তিনি। পবিত্র রমজান মাস বাংলাদেশসহ পৃথিবীর মুসলিম দেশগুলোর মানুষ যখন সিয়াম সাধনায় রত তখন ইফতারি বা সেহরির টেবিলে এ ধরনের বর্বরতম হামলা কত নির্মম এবং জঘন্য, ভাবতেই যে কোনো সুস্থ মানুষের রক্তচাপ বেড়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু পুরো বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ নির্বিকার-উদাসীন। রমজানের বাড়তি খাবার-দাবার আর ইবাদতের মাধ্যমে বেহেশতের সিট বুকিংয়ের প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত ছিলেন মুসলিম উম্মাহ! একই সাথে বিশ্ববিবেক যারা পৃথিবীতে গণতন্ত্র আর শান্তির পাঠশালা খুলে অনুন্নত ও নিজের মতাদর্শবিরোধী দেশগুলোর সরকার ও জনগণকে ঘাড় ধরে গণতন্ত্র আর অহিংসার তালিম দিচ্ছে, তারা এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ প্রাণভরে উপভোগ করছে! গাজার মানুষের অপরাধ পশ্চিম তীরে তিন ইসরাইলি কিশোরকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের বদলায় এক ফিলিস্তিনী কিশোরকেও ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। বিভিন্ন মিডিয়া সূত্রে প্রকাশ এটাও নাকি ইহুদিবাদের একটা চক্রান্ত। তাদের গোয়েন্দা সংস্থা নাকি ফিলিস্তিনিদের গাঢ়ে দোষ চাপাবার জন্য এ কান্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু এতে তৃপ্ত নয় ইসরাইল। ভুয়া অজুহাতে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে ‘অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ’ নামে ফিলিস্তিনি নিধন অভিযানের মাধ্যেমে। প্রথমে অপহৃত তিন কিশোরকে উদ্ধারের নামে পুরো গাজা অঞ্চলে ইসরাইলি সেনাবাহিনী বেপরোয়া অভিযান চালায়। হত্যা করে আরও এক ফিলিস্তিনি কিশোরসহ দুজনকে। আটক করে হামাস সদস্যসহ অন্তত দেড়শ ফিলিস্তিনিকে। এদিকে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সংবাদে প্রকাশ গাজায় খান ইউনিস এলাকায় ইসরাইলের বিমান হামলায় একই পরিবারের ২০ জন নিহত হন। তবুও নেতানিয়াহু এবং শিমন পেরেজদের রক্ততৃষ্ণা মিটেনি। শুরু করেছে বেপরোয়া বিমান হামলা। হামাস ইসরাইলি কিশোর অপহরণ বা হত্যার দায় অস্বীকার করা সত্ত্বেও ইসরাইল অজুহাতটি কাজে লাগিয়ে নতুন করে ক’দিন ধরে হামাস বিরোধী নিধনযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলি বিমান হামলার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে হামাসের কাশেম ব্রিগেড তেল আবিবসহ ইসরাইলি লক্ষবস্তুকে কয়েক দিনে শত শত রকেট হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে একটি রকেট ১০০ কিলোমিটার দূরত্বের ইসরাইলি শহর হামেরায় আঘাত হানে। এম ৩০২ নামের রকেটটি গাজার ভ্রাম্যমাণ রকেট লঞ্চার থেকে নিক্ষেপ করা হয়। অবশ্য অধিকাংশ রকেট ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আয়রন ডোম মাঝ আকাশ থেকে ভূপাতিত করে। মঙ্গলবার ভোর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলি বিমান হামলা টানা কয়েকদিন ধরে চলছে। একমাত্র ইরান এবং তুরস্ক ছাড়া কেউ এসব হামলার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানায়নি। জাতিসংঘ মহাসচিব ফিলিস্তিন পরিস্থিতিতে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে সব পক্ষকে সতর্ক করে দিয়ে তার দায়িত্ব পালন করেছেন! ইসরাইলের প্রধানমšী¿ নেতানিয়াহু হুমকি দিয়ে বলেছেন, আমরা হামাসসহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দেব। গাজায় অভিযান আরো জোরদার করবো। ইতিমধ্যে গাজা থেকে রকেট হামলা বন্ধ করতে স্থল হামলা চালাতে ৪০ হাজার রিজার্ভ সেনা সদস্য ডাকা হয়েছে। ইতিমধ্যে হামলা চালিয়ে ফিলিস্তিনিদের হত্যাসহ বিমান হামলার পাশাপাশি গাজায় নামানো হয়েছে স্থল সেনা। এদিকে ইসরাইলের বেপরোয়া বিমান হামলা থেকে গাজা সিটি, রাফা, নুসেইরাতসহ প্রতিটি জনবসতির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মার্কেট, ক্যাফে, মসজিদ কিছুই রক্ষা পাচ্ছে না। এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৪০.০০০ জনের বেশি নারী ও শিশু এবং আহত হয়েছে ৫০০০ জনের বেশি নিরীহ মানুষ। এবারের হামাসের পাল্টা হামলার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রথমবারের মতো কাশে ব্রিগেডের এমণ্ড৭৫ রকেট তেলআবিবের লক্ষ্যবস্তুতেও ছোঁড়া হয়েছে যদিও এই মডেলের দুটো রকেটই ধ্বংস করে দিয়েছে আয়রণ ডোম ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। তাছাড়া এবারই প্রথম ইসরাইলে ১০০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে রকেট পাঠাবার সামর্থ্য অর্জন করে হামাস।
জাতিসংঘ মহাসচিবের নরমণ্ডসরম স্রেফ একটি রুটিন বিবৃতি বলে দাবি করেছে লেবাননের হিজবুল্লাহ নিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যানেল। তাছাড়া হিজবুল্লাহ নিজস্ব নিউজ পোর্টাল থেকে দাবি করা হয়, ইসরাইল যেভাবে পাখির মতো ফিলিস্তিনি শিশু কিশোর হত্যা করছে, তার মূল্য কড়ায়-গন্ডায় ইহুদি সন্ত্রাসীদের শোধ করতেই হবে। পশ্চিম তীরে ইসরাইলি তিন কিশোর অপহরণ ও হত্যা যেমন চরম নিষ্ঠুরতা তেমনি ইসরাইল এই অজুহাতে শত শত ফিলিস্তিনি হত্যা মিশন শুরু করে বিশ্ব মানবতার টুঁটি টিপে হত্যা করছে। এই ধরনের জঘন্য বর্বরতার স্বরূপ অনেক আগেই একজন ইহুদি মানবতাবাদী অধ্যাপক জেফহালপার উন্মোচন করে দিয়েছেন। নৃবিজ্ঞানী অধ্যাপক হালপার ১৯৯৭ সালে ‘কমিটি এগেইনষ্ট হোম ডিমোলিশন’ (সিএএইটডি) নামে খোদ ইসরাইল থেকে একটি আন্দোলন গ্রুপ গড়ে তোলেন। কট্টর ‘ইসরাইলিদের জঘন্য ফিলিস্তিনি ভূমিগ্রাস কর্মসূচির বিরুদ্ধে তার সংস্থা ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন ও সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্স’ কর্মসূচিও পালন করে। ইসরাইল সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীর জঘন্য ভূমিগ্রাস নীতির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অধ্যাপক হালপার জনমত গঠনের পাশাপশি ইসরাইলি ভূমি দস্যুতার অমানবিক স্বরূপ উন্মোচন করে বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন। তার সর্বশেষ রচনা হচ্ছে ‘এ্যান ইসরাইলি ইজ প্যালেস্টাইন: রেজিষ্টিং ডিসপোজিশন রিডিমিং ইজরায়েল’।
বইটিতে দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে ইসরাইলের ভূমি আগ্রাসনের কুৎসিত চেহারা খুলে দিয়েছেন হালপার। তাঁর সোজাসাপ্টা বক্তব্য হচ্ছে, ফিলিস্তিনি অধিবাসীদের নির্মূলে ইসরাইল কোন নীতি নৈতিকতার ধার ধারে না। এ ব্যাপারে ইহুদিদের অনূকূলে ইসরাইল যে আইন পাস করে তাই তা মানতে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠী বাধ্য। তাদের হয় পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীর স্বেচ্ছায় ত্যাগ করতে হবে, অন্যথায় তাদের বসতি গুঁড়িয়ে দিতে সার্বক্ষণিক তৈরি আছে ইসরাইলি বুলডোজার। একই ভাবে দফায় দফায় প্রতিবাদী গাজার হামাস জনগোষ্ঠীর উপর হামলা চালিয়ে তাদের নির্মূল করে দিতে পারলে ইসরাইল ছোট একটি ভূখন্ডে অনুগত ফিলিস্তিনিদের ভেড়ার পাল এবং চাকর-বাকরের মতো পুষতে পারবে। দুঃখজনক হলেও সত্য জেফ হালপারের মত মানবতাবাদীদের আন্দোলন বক্তব্য, আগ্রাসী জায়নবাদের জঘন্য মানবতা বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বিশ্ব কর্পোরেট মিডিয়া দেখেও দেখছে না।
জাতিসংঘ নামের প্রতিষ্ঠানটিও নাকে তেল দিয়ে টানা ঘুম দিচ্ছে। সাংবাদিক-কলামিস্ট। মুসলিম বিশ্বকে এ বর্বরতার বিরুদ্ধে এক এবং একাত্ম হয়ে এগিয়ে না এলে অবস্থা যে কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাবে তা বলা মুশকিল।