এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো কয়েকদিন। পাসের হার ও জিপিএ পাওয়া নিয়ে এবার বেশি আলোচনা-সমালোচনা দেখিনি। কারণ এই রেজাল্ট হয়েছে একটু ভিন্ন পদ্ধতিতে। এ বছর ২৯ জুন এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। গত কয়েক বছরের মতো পুনর্বিন্যাস করা পাঠ্যসূচি অনুযায়ী সব বিষয়ে পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ে পরীক্ষা হবে বলে রুটিন ছিল। কিন্তু পরীক্ষা চলাকালীন জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। যা পরবর্তীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রূপ নেয়। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে আন্দোলন তীব্রতর হওয়ার কারণে ছয়টি পরীক্ষার পরে আর পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এই অবস্থায় বাকি পরীক্ষাগুলো শিক্ষামন্ত্রণালয়ের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে বিগত দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে সাবজেক্ট ম্যাপিং পদ্ধতিতে ফলাফল নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। সেই অনুযায়ী শিক্ষাবোর্ডগুলোকে ফলাফল তৈরির নির্দেশ দেয়া হয়। সেইভাবে তৈরি হয়েছে এবারের এইচএসসির ফলাফল। যারা বিষয়টা বোঝে না তারা বলছেন অটো পাস। আসলে এটা কিন্তু অটো পাস না। এটি সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে দেয়া সিদ্ধান্ত। যদি অটো পাসই হতো তাহলে কিন্তু সবাই পাস করতো, কেউ ফেল করতো না! করোনার কারণে ২০২০ সালে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। সেবার পরীক্ষার্থীদের ‘অটো পাস’ দেয়া হয়। জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ফল তৈরি করা হয়েছিল। ২০২৪ সালে সব শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে পাসের হার ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আগের বছর ছিল ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর ২০২২ ও ২০২১ সালে পাসের হার ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, যথাক্রমে প্রায় ৮৬ শতাংশ ও ৯৭ শতাংশের বেশি। এবারও অতীতের ধারাবাহিকতায় যেমন শতভাগ পাসের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, রয়েছে শতভাগ ফেল করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। আশ্চর্য ব্যাপার হলো এই পদ্ধতিতেও কেউ পাস করতে পারে না একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দিয়ে আমাদের লাভটা কি? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি তো শিক্ষার মান বৃদ্ধির বিষয় না। দুটো ভিন্ন বিষয়। এবারও ফেসবুকে যারা এ প্লাস পেয়েছে তারা তাদের ছবি ও ফল দেখেছি। তবে অন্য বারের তুলনায় একটু কম। এর কারণ কী? খুব সম্ভবত এর কারণ হলো পরীক্ষার ফলাফল দেয়ার পদ্ধতি। ছাত্রছাত্রীদের দাবির মুখেই এই পদ্ধতিতে রেজাল্ট দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। যদিও সব ছাত্রছাত্রী এটা চায়নি। একটি অংশ পরীক্ষা চেয়েছিল। পরীক্ষা ছাড়া মূল্যায়ন বিষয়টা ঠিক বোধগম্য না। তা সে যত সংক্ষিপ্তই হোক। এর কারণ হলো মেধাবীরা বা যারা প্রস্তুতি নিয়েছে তারা কখনোই চাইবে না পরীক্ষা না দিয়ে রেজাল্ট হোক। তবে এ নিয়ে কেউ অপেক্ষা করেনি। পরীক্ষা বাতিল করা হয়।
পরবর্তীতে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে ফলাফল হলো। এখন আবার দেখলাম, এসএসসির সব বিষয় ‘ম্যাপিং’ করে ‘বৈষম্যহীনভাবে’ এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের দাবিতে রোববার দুপুর থেকে বিক্ষোভ করছে একদল শিক্ষার্থী। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সামনে রোববার রাতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান। আমাদের সময়ে যখন পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হতো তখন মিষ্টির দোকান খালি হয়ে যেতো। এখন আর আগের মতো মিষ্টি বিলি করা হয় না। কেন হয় না তা তারাই ভালো বলতে পারবে। তবে ফলাফলের উপর যে শিক্ষার মান খুব বেশি নির্ভর করে না সেটা আমরা গত এক দশকে বুঝতে পেরেছি। ভালো ফল করা ছাত্রছাত্রীরাও খুব বেশি শিখতে পারেনি। তারা প্রকৃত শিক্ষা থেকে অনেক দূরে। আমরা সবাই চাই কেবল পাসের হারে বৃদ্ধি না বরং মেধার হারে বৃদ্ধি ঘটুক। শতভাগ পাস দিয়ে কি হবে যদি মেধাবী শিক্ষার্থী না বের হয়। মেধাবী শিক্ষার্থী যাচাইয়ে যদি পাসের হার কমে তাহলে একটুও আফসোস নেই। কারণ কয়েকজন নামমাত্র শিক্ষিত বেকার যুবকের চেয়ে একজন প্রকৃত মেধাবী দরকার। কারণ সেই একজন বাকিদের কাজের ক্ষেত্র তৈরিতে ভূমিকা রাখে। সফলতা এবং ব্যর্থতাণ্ড জীবনের এই দুটি দিক গ্রহণের মানসিকতা থাকা উচিত। প্রকৃতপক্ষে সঠিক মূল্যায়ন বলতে সেই পরিমাপ কতটা সঠিক তা বলা যায় না। কারণ আজকাল বিভিন্ন পদ্ধতি বারবার পরিবর্তন করা হয়। ঠিক এখানেই নতুন কারিকুলামের স্বার্থকতা হবে। এই ধরনের মূল্যায়ন গ্রেড থাকবে না।
পরীক্ষা মানে পাস আর ফেল। যারা পাস করছে তারা নিঃসন্দেহে মেধাবী। কিন্তু যারা পাস করছে না তারা কি মেধাশূন্য? কোনো একটা বা দুইটা বিষয়ে ফেল করলেই কি তার মেধা নেই বলা যেতে পারে? শুধু ফলাফল দিয়ে নিশ্চয়ই কোনো ছাত্রছাত্রীর মেধা পরীক্ষা করা যায় না। কারণ স্কুল-কলেজের পাস ফেল শুধু সার্টিফিকেট দেয়া হয়। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে স্কুলে ছাত্র হিসেবে খুব খারাপ হয়ে পরবর্তী জীবনে বড় বড় ব্যক্তিদের কাতারে নাম লিখিয়েছেন। এবং এই সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। তাহলে পাস ফেল এবং মেধা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হলেও সম্পূর্ণ নির্ভর নয়। যে শিক্ষা মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে না তার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এতদিন ধরেই শিক্ষার যেন সেই মূল লক্ষ্য কেবল সার্টিফিকেট। কোনোমতে একটা সার্টিফিকেট পেলেই সব শেষ। তারপর এদিক সেদিক ধরাধরি করে একটা চাকরি বাগিয়ে সমাজে দিব্বি মেধাবী সেজে ঘুরে বেড়ানো যায়। একসময় দেশে পরীক্ষায় নকল করার একটা প্রবণতা ছিল। তখন পাসের হারও কম ছিল। কিন্তু সবাই নকল করতে পারতো না। তবে আশ্চর্যের বিষয় কিন্তু সেটা নয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো সেসময় পরীক্ষার কেন্দ্রে অসুদপায় অবলম্বন করলেও শিক্ষার্থীদের মেধা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতো না। কে পরীক্ষার কেন্দ্রে নকল করেছে সে বিষয়টার স্বাক্ষী কেবল আরেক পরীক্ষার্থী থেকে যেত। আজ কেন্দ্রের সামনে লেখা থাকে নকলমুক্ত পরীক্ষা কেন্দ্র। তবে শিক্ষার্থীদের মেধা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় কেন? পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর কোথাও কোথাও আত্মহত্যার খবর আসে যা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। এটা একদিনে হয়নি। ধীরে ধীরে সমাজের মানসিকতা পরিকল্পিতভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে। ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্যও পরিবর্তিত হয়েছে।
যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যাগুলো খতিয়ে দেখা দরকার। যারা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রছাত্রীকে পাস করাতে পারছে না, অন্তত একজনকেও, তাহলে সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দরকার নেই। দক্ষ জনসম্পদ তৈরি করতে মেধাবী ছাত্রছাত্রীই প্রয়োজন। পাসের হার বৃদ্ধি করে আপাত শিক্ষার প্রসার হলেও মান না বাড়লে স্থায়ী ক্ষতি হয়। এবার পাসের হার কমেছে। জানা গেছে, ইংরেজি বিষয়ের দুর্বলতার কারণ রয়েছে। অথচ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ছোটবেলা থেকে সন্তানকে ইংরেজি বিষয়েই বেশি সময় প্রাইভেট পড়ানো হয়।
তাই আমরা চাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মেধার বিকাশ ঘটুক। শেষ পর্যন্ত যদি কোনো ছাত্রছাত্রী পাস না করতে পারে তার জন্য প্রচলিত সংস্কৃতি অনুসারে তার ফেল করার কারণ উদঘাটন করতে ব্যস্ত না হয়ে তাকে বোঝানো যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত তো সে অবশ্যই জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। জীবন যুদ্ধের পরীক্ষার মতো কঠিন পরীক্ষা আর কি আছে। নৈতিকতা, মনুষ্যত্ব এসব লেখাপড়ার রেজাল্ট দিয়ে অর্জন করা সম্ভব না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এটা দিতে পারছে না। আমরা আর অটো পাস চাই না। আমরা সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে রেজাল্টও চাই না। বিশেষ কারণে যদি পরীক্ষা না হয়, তা হোক সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। তবুও পরীক্ষা হোক। পরীক্ষা বিহীন মূল্যায়ন কোনো পদ্ধতি হতেই পারে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট