পলিথিন ব্যবহার বন্ধে আইনের পাশাপাশি প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ

মো. তাহমিদ রহমান

প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ১ অক্টোবর থেকে পলিথিন, পলিপ্রপিলিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ। যদিও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবতা ভিন্ন। ইতোপূর্বে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর বিধান অনুসারে তৎকালীন সরকার ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। পরবর্তী তিন বছর পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন প্রায় বন্ধই ছিল। কিন্তু বিগত দেড় যুগে মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনের যথাযথ তদারকির অভাবে পলিথিন নিষিদ্ধের বিষয়টি যেন শুধুমাত্র কেতাবি ছিল। পৃথিবীতে বাংলাদেশ একমাত্র রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে আইন করে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, মজুদ ও বিতরণ নিষিদ্ধ করা হয়। আইনটির ১৫নং ধারায় বলা হয়েছে যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন করে তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। সেই সঙ্গে পলিথিন ব্যাগ বাজারজাতকরণ করলে ছয় মাসের জেলসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করা হয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত সেই পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক ব্যাগ ও মোড়কসামগ্রীর উপর ৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো পরবর্তীতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে তা প্রত্যাহার করে আইনটিকে আইনপ্রণেতারাই বৃদ্ধাঙুলি প্রদর্শন করে। বাস্তবতা হচ্ছে যে আইনপ্রণেতারা এই আইনটি প্রণয়ন করেছেন এবং যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই আইনটি প্রয়োগ করার কথা খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের হাতেও পলিব্যাগ শোভা পায়! জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর ৩১ জানুয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের প্রকাশিত খবর অনুযায়ী প্রায় তিন হাজার কারখানায় দৈনিক এক কোটি চল্লিশ লাখ নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিব্যাগ উৎপাদিত হচ্ছে। এসব পলিথিন অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে খাবার, পানি, বাতাস নানা মাধ্যমে প্লাস্টিকের কণা ঢুকে পড়ছে মানুষের শরীরে। মানব মস্তিষ্কে এবং মায়ের দুধেও প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক ম্যাথিউ ক্যাম্পেন বলেন, ‘৪৫ থেকে ৫০ বছর বয়সি স্বাভাবিক মানুষের মস্তিষ্কের প্রতি গ্রাম টিস্যুতে আমরা ৪ হাজার ৮০০ মাইক্রোগ্রাম (১ গ্রাম সমান ১০ লাখ মাইক্রোগ্রাম) প্লাস্টিক কণা পেয়েছি। এটি মস্তিষ্কের মোট ওজনের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে মস্তিষ্কে যে পরিমাণ প্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে তা প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এর অর্থ আজকের দিনে আমাদের মস্তিষ্ক ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ, বাকিটা প্লাস্টিক। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত পলিথিনের ব্যবহারের ফলে এটি খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করছে যার ফলে প্রজনন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। বন্ধ্যাত্ব, ক্যান্সারসহ ত্বকের নানারকম রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষের রক্তেও এখন প্লাস্টিক কণা পাওয়া যাচ্ছে। বেশিরভাগ শিশু খাদ্য পলিইথাইলিন, পলিস্টেরাইন দিয়ে তৈরি প্লাস্টিক প্যাকেটে মোড়ানো থাকে। অবুঝ শিশুরা এসব প্যাকেটজাত খাবার খাওয়ার সময় খাবারের কোন অংশ প্যাকেটে লেগে থাকলে চেটে খায় ফলে এসব যৌগের প্রভাব সরাসরি তাদের শরীরে প্রবেশ করে। আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের কথা ভেবে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। পলিথিন একটি অপচনশীল জৈব পলিমার এটি মূলত ইথেনের পলিমার যা বিভিন্ন রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে তৈরি হয়। এটি এসিড, ক্ষার ও অন্যান্য দ্রাবক দ্বারা সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না তাই এটি ভূমির নিচে প্রায় ১০০০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। বাংলাদেশে পলিথিনের যেসব ব্যাগ ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে প্লাস্টিকের পলিমার ছাড়াও থাকে নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ- বিসফেনল-এ, থেলেট, থেলেট এস্টার, পলিভিনাইল ক্লোরাইড ইত্যাদি। প্লাস্টিককে নমনীয় করার জন্য এসব যোগ করা হয়। এসব বিষাক্ত পদার্থ মানুষের জন্য ক্ষতিকর। অপচনশীল এবং নন-কম্পোস্টেবল হওয়ায় এটি মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস করে। পাহাড়ের চূড়া থেকে গভীর সমুদ্র সর্বত্রই পলিথিন তথা প্লাস্টিক দৃশ্যমান। নগর পেরিয়ে প্লাস্টিক-পলিথিন ছড়িয়ে পড়েছে দুর্গম গ্রাম ও জনপদে।

যত্রতত্র প্লাস্টিকজাত ব্যাগ, বোতল, মোড়ক এবং একবার ব্যবহার উপযোগী পলিথিন ব্যাগ ফেলার জন্য আমরা নাগরিকরাই দায়ী। বাংলার মাটিতে বেশিরভাগ মুনাফা লোভী ব্যবসায়ীরা জনগণের কথা পাত্তা দেয়নি। পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনকারীরা কথা শুনবে না সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু বিগত দেড় যুগে সরকারেরও টনক নাড়ানো সম্ভব হয়নি। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এবং অন্যান্য পরিবেশবাদী সংগঠন নদীর দখল, দূষণ ও ভার্জিন প্লাস্টিক পণ্য বন্ধে বিচিত্র কর্মসূচি পালন করছে। এবার তাদেরই একজন শুদ্ধমতির বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পানিসম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা। তাই আমাদের দাবি সর্বশক্তি প্রয়োগ করে হলেও পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করুন। প্লাস্টিক বর্জ্যে নদীগুলোর যে অবস্থা হয়েছে তাতে করে মনে হচ্ছে নদীর যদি মানুষের মতো ভাষা থাকত এবং থাকত দুটি হাত, তাহলে সে নিজেই সরকারের ঘরে গিয়ে করজোড়ে বলত, ‘আমাকে বাঁচান। আমি বাঁচলে আপনারা বাঁচবেন।’ একটি সুজলা-সুফলা, শস্যশ্যামলা সবুজ সুন্দর দেশ এক জিনিস, আর মধ্যম আয়ের উন্নয়নের অসুন্দর দেশ সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। এই দুটির মধ্যে প্রথমটিকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয়টিকে বেছে নিলে তা হবে দেশের জনগণের আত্মহত্যার শামিল। গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হয়ে গেলে একদিন না একদিন তা উপযুক্ত নেতৃত্বে পুনরুদ্ধার সম্ভব। কিন্তু প্লাস্টিকের বর্জ্যে নদ-নদীকে হত্যা করা হলে তাকে আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। যেমন মৃত মানুষকে আর জীবিত করা যায় না। পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার আইন থাকা সত্ত্বেও ৮০ শতাংশ মানুষ প্রতিদিন পলিথিন ব্যাগ ও প্লাস্টিকসামগ্রী ব্যবহার করছে। যারা উৎপাদন করছে এবং আমরা যারা ব্যবহার করছি তারা সবাই এ দেশের নাগরিক কিন্তু আমরা আমাদের জীবনব্যবস্থা ও পরিবেশ নিয়ে সচেতন নই। বিশ্ব সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ানো পলিথিন ও প্লাস্টিকসামগ্রী ব্যবহার করে পরিবেশ বিধ্বংসী কাজে নিজেরাই যুক্ত হচ্ছি। বিশ্বব্যাপী পলিথিন ব্যাগ ও প্লাস্টিকসামগ্রী ব্যবহার কমানোর নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও বাংলাদেশের ঘটছে ঠিক তার উল্টোটা। পলিথিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় শহর এলাকায়। ফলে শহর এলাকার নদনদীগুলোই পলিথিন দূষণের শিকার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী। বরিশালের কীর্তনখোলা। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর পড়েছে। ফলে এসব নদীতে পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণে মাছের জীবনচক্র হুমকির মুখে পড়ছে। বিগত দেড় যুগে বাংলাদেশে পলিথিনের ব্যবহার বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিদিন প্রায় ৮ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে। তন্মধ্যে মাত্র ৩৬ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার ৯৯৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। আমরা প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করে অন্যান্য বর্জ্যরে সাথে ফেলে দিচ্ছি। যার ফলে প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার ৯৯৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য ঢাকার পরিবেশের সাথে যোগ হচ্ছে। ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ পলিথিন ব্যাগ ও প্লাস্টিকসামগ্রী। ঢাকা শহরের ৮০ শতাংশ ড্রেইন পলিথিন ব্যাগে আবদ্ধ। যার কারণে ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের একুশে সেপ্টেম্বর ভারি বর্ষণের ফলে গোটা ঢাকা শহর ডুবে গিয়েছিল। এর পরও প্রশাসন এবং জনগণ উভয়ই নির্বিকার। পলিথিন ব্যাগ ছাড়াও গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক, বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক দ্রব্য বেশিরভাগই একবার ব্যবহার করে ভাগাড়, খাল-বিল, ড্রেন ও যত্রতত্র ফেলে দেয়া হচ্ছে ফলে সেগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশে অপাচ্য হিসেবে জমা হচ্ছে। যার ফলে জলজ প্রাণী, খাদ্যশৃঙ্খল এবং মানবজগতে বিশাল কুপ্রভাব পড়ছে। পরিবেশের সঙ্গে দূষণ সৃষ্টিকারী প্লাস্টিক মাইক্রোকণা সহজে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে। যার ফলে মানব স্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। প্লাস্টিক কণা উদ্ভিদ ও প্রাণীর কোষের ভেতর অবস্থিত ডিএনএ ও আরএনএ অনুর মধ্যে মিউটেশন ঘটিয়ে ক্যান্সার সৃষ্টি করছে। প্রতিবছর নদীপথে বঙ্গোপসাগরে প্রায় ২৭ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বের দশম সর্বোচ্চ প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষকগণ প্লাস্টিক দূষণ কমানোর জন্য কাজ করছে। প্লাস্টিকের তৈরি পণ্যের রিসাইক্লিং কৌশল উন্নত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তাই আমাদেরও প্লাস্টিকের পণ্যের একবার ব্যবহার কমাতে হবে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিকভাবে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। গৃহস্থালির কাজে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুপার সপগুলোতে পলিব্যাগ ব্যবহার না করার জন্য যেভাবে জোর দিয়েছে সেভাবেই কাঁচাবাজার, মুদির দোকান, মাছ বাজারসহ মাঠ পর্যায়ের সকল ক্ষেত্রে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধে প্রশাসনের তদারকি বাড়াতে হবে। সরকারের পাশাপাশি পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোকে এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে হবে। হাটবাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতা কেউই যাতে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে বণিক সমিতিগুলোকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সব ধরনের দ্রব্য প্লাস্টিকের প্যাকেটজাত করার ব্যবস্থা বন্ধ করতে প্রশাসনকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। সেই সাথে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের সবাইকে পলিথিন ব্যবহারের আত্মঘাতী প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে এদেশ থেকে পলিথিন ব্যাগ চিরতরে বন্ধ হবে এই প্রত্যাশা রইলো।

লেখক: প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা