ঢাকা ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যা চলছে গাজায়

আবুল খায়ের বাবু
পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যা চলছে গাজায়

গাজায় ইজরাইলিদের বর্বরতম অভিযানের একবছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে জানা যায় ১০ অক্টোবর, ২৪ পর্যন্ত ৪২ হাজারের অধিক মানুষ নিহত হয়েছে এবং ৯৮ হাজারের অধিক মানুষ আহত হয়েছে যার অধিকাংশ নারী ও শিশু। মসজিদ, চাচ’, গির্জা’, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বড় বড় হাসপাতালসহ সব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, আবাসিক এলাকার ৮০ শতাংশ অবকাঠামো মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ পানি সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছে। রাস্তা বুলডোজার দিয়ে চলাচলের অযোগ্য করা হয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ করা হয়েছে। লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত গাজাবাসীকে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে। কোথাও মাথাগোঁজার ঠাঁই নাই তবুও চলছে নিষ্ঠুর বিমান হামলা। অসহায় মানুষ বাঁচতে এখান থেকে ওখানে ছুটছে মরছে অকাতরে। ইতিহাসের হিটলার কর্তৃক ইহুদি নিধনের কুখ্যাত হলোকাষ্ট বর্বরতা আজ সেই কুখ্যাত হলোকাষ্ট থেকে বেঁচে এসে প্যালেস্টাইনে আশ্রয় নেয়া ইহুদিদের অমানবিক নির্বিচার ফিলিস্তিনি নিধন যেন সেই নাৎসি বর্বরতাকে ম্লান করে দিয়েছে। মানবতার ধারক-ইউরোপ-আমেরিকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় ঘটছে এই নারকীয় বর্বরতা।

আফসোস প্রতিবেশী আরব নেতারা যেন দেখেও কিছুই দেখছে না, আরবলীগ ওআইসি মাঝে মাঝে বিবৃতির ঝাঁপি খুলে আবার একেবারে নীরব। তথাকথিত সভ্য বিশ্বের নেতা, গণতন্ত্রের রক্ষক, বাক-স্বাধীনতার রক্ষক মানবতার রক্ষকগণ শুধু হাইলাইট করছে ৭ই অক্টোবর ২০২৩-এ হামাসের ইজরাইলে হামলা। কিন্তু তারা কখনো মূল কারণ বিবেচনা করেনি। তারা নিপীড়িত নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের সন্ত্রাসবাদী বলছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে আগ্রাসী হানাদার ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের যেভাবে হত্যা করে যাচ্ছে যাদের বেশিরভাগই শিশু এবং নারী, ফিলিস্তিনিদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে তা দখল করছে তা আমলে আনা হয় না। এভাবেই ফিলিস্তিনি ভূমিকে সংকুচিত করা হয়েছে। দীর্ঘ ৭৫ বছরে নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করে, রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে ভূমি দিয়ে তারা যে শিক্ষা নিয়েছে হানাদার দানব ইজরাইলিদের কাছ থেকে সেই একই কায়দায় পুঞ্জীভুত ক্ষোভের প্রতিশোধ নেয়া হয়েছিল ৭ই অক্টোবরে।

ফিলিস্তিনিদের নিয়ে অনলাইনে একটা নিবন্ধ পড়েছিলাম সম্ভত ২০১৭ সালে। কোথায় প্রকাশিত হয়েছিল তা মনে নেই। হোয়াইট হাউজে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট আব্বাসের মধ্যে আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে প্রেসিডেন্ট আব্বাস দেশে ফিরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন সেই আলোচনায় ট্রাম্প তাকে বলেছেন প্যালেস্টাইনে শান্তির জন্য ফিলিস্তিনিদের বড় ত্যাগের প্রয়োজন হবে তবে বিস্তারিতভাবে তিনি আর কিছুই বলেননি। একইভাবে ট্রাম্পের সাথে আলোচনা করে মিশরের কায়রোয় ফিরে এসে প্রেসিডেন্ট সিসি বলেন, খুব শিগগিরই মধ্যেপ্রাচ্যে একটা বড় পরিবর্তন আসছে কিন্তু তিনিও বিস্তারিত কিছুই বলেননি। সারা বিশ্ববাসী দেখছে ১০ অক্টোবর ২০২৩ এর হামাসের ইজরাইলের অভ্যন্তরে হামলার প্রতিশোধ নিতে যে দানবীয় ধংসযজ্ঞ শুরু করেছিল তা আজও চলমান। তবে এই কি সেই ফিলিস্তিনিদের বড় ত্যাগ?

১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ মিডল ইস্ট মনিটর বলেছে যে, ইসরায়েলি প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের সমুদ্রসীমায় প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ইসরায়েলি এবং আন্তর্জাতিক ছয়টি সংস্থাকে লাইসেন্স দিয়েছে। ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজ মার্চ-১৯, ২০২৪ প্রকাশ করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা এবং প্রধান পররাষ্ট্র নীতি উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার, গাজার সমুদ্র সীমাকে ‘খুব মূল্যবান’ বলে বর্ণনা করেছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন যে ইসরায়েলকে গাজা থেকে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের সরিয়ে নেয়া উচিত এবং অঞ্চলটি ‘পরিষ্কার করা প্রয়োজন’। সেই ট্রাম্প আবার সম্ভবত ২০২৫ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার অপেক্ষায়।

ইজরাইল কেবল সব অবকাঠামো মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত নয়। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে খাদ্যসহ সব প্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ বন্ধ করেছে। বিমান থেকে খাদ্যসামগ্রী ফেলা হলে সেই খাবার সংগ্রহের সময় বর্বর ইসরায়েলি বাহিনী ক্ষুধার্ত বেসামরিক মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে। গুলিতে আহত মানুষকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিতে বাধা দেয়া হয়েছে। গুলি করে ফিলিস্তিনিদের রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে যতক্ষণ না রক্ত ঝরে কষ্ট নিয়ে মারা গেছে। গোলা ছুড়ে অ্যাম্বুলেন্স ধংস করা হয়েছে। জাতিসংঘের কর্মী ডাক্তার নার্স সাংবাদিক কারো জীবনের নিরাপত্তার জায়গা নেই এখন আর গাজায়। ইজরাইলিদের নির্মমতা আর বর্বরতার নতুন সংযোজন তাঁবুতে আশ্রয় নেয়া ফিলিস্তিনিদের পুড়িয়ে মেরে ফেলা। আহত অনেককে জীবিত গণকবর দিয়েছে। মানবতার সমস্ত নিয়ম লঙ্ঘন করে গাজাকে তারা আজ বিশ্বের বৃহৎতর কবরস্থান বানিয়ে ফেলেছে। আজ এটা দিবালোকের মতো সত্য পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যা চলছে গাজায় ।

শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসী দেখেছে ইজরাইল বার বার শান্তি আলোচনায় বসে সময় নিয়েছে আর গাজায় তার বাধাহীন গণহত্যা চালিয়ে গেছে। ইসরায়েলে নেতানিয়াহুর দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অবস্থান ভালো নয়। তিনি পোড়ামাটির নীতি গ্রহণ করে, যে কোনো মূল্যে হামাসকে ধ্বংস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং যে কোনোভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার জন্য ৭ই অক্টোবর দেশের হারানো ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে চায়। শান্তি আলোচনা চালিয়ে যেতে দেখেছি বিশ্ববাসীকে শুধু ধোঁকা দেয়ার জন্য। তারা এভাবেই তাদের বাহিনীকে সংঘটিত করে সামরিক শক্তি বাড়ানোর জন্য সময় নিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস করেও তা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘকে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। আরব লীগের নেতৃবৃন্দ, ইসলামী দেশগুলোর সংগঠনের নেতারাও ইসরায়েলের বর্বরতা বন্ধে যৌথভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে তাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। সবাই দাপ্তরিক কাজ আর আলোচনার পর বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব সমাধা করেছে। আমেরিকার বিদেশ মন্ত্রী ব্লিংকিনের অতি ঘন ঘন মধ্যপ্রাচ্য সফর প্রকৃত যুদ্ধ বন্ধের জন্য ছিল না, ছিল গাজার গণহত্যায় আরব রাষ্ট্র নেতাদের নিরপেক্ষ রাখতে। সে তা পেরেছে। সব আরব রাষ্ট্র নায়ক আর বাদশা আজ আমেরিকা আর পশ্চীমাদেশগুলোর কাছে মাথা হেট করে আছে যাতে তাদের ক্ষমতা হাতছাড়া না হয় স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থেকে যাতে সুখ ভোগ করা যায়। তাদের আন্তর্জাতিক আদালতের (আইসিজে) ভূমিকাও ব্যতিক্রম দেখি না। তারাও গণহত্যার দায়ে ইজরাইলের বিরুদ্ধে কিছু করতে, গাজায় অসহায় মানুষকে রক্ষা করে মানবতাকে রক্ষা করতে শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসীকে আশ্বস্থ করার মতো কোনো কাজ করেনি।

যুদ্ধ আজ বিস্তৃত হয়েছে লেবাননে। হিজবুল্লাহকে ধংস করতে লেবাননকে গাজা বানানোর ঘোষণা দিয়েছে নেতানিয়াহু। হিজবুল্লাহ নেতা নসুরুল্লাহসহ বেশ ক’জন শীর্ষ স্থানীয় কমান্ডারকে হত্যার মাধ্যমে স্থল অভিযান শুরু করেছে ইজরাইল। স্থল অভিযানে সফল হতে না পারলেও বিমান হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত করছে ব্রৈুত এবং আশপাশের এলাকা। ইরানের সাথে হামলা ও প্রতি হামলার ঘটনা ঘটায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে গোটা মধ্যপ্রাচ্য। ইজরাইলিদের হামলা থেকে ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করতে না পারলেও ইজরাইলের ভেতর ইরানের হামলার সময় জর্ডান তার আকাশ সীমায় ইরানী ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে ইজরাইলকে রক্ষা করছে। জর্ডানসহ প্রায় সকল আরব রাষ্ট্রে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে রয়েছে আমেরিকান ঘাঁটি। সুতরাং কোনো রাষ্ট্রনেতার পক্ষে সম্ভব নয় ইজরাইলের বিরুদ্ধে যাওয়া। ইরান হুমকি দিয়েছে ইরানের ভেতর আক্রমণে ইজরাইলকে সহযোগিতা করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

আমেরিকা ও জাতিসংঘের বিশেষ সুবিধা পেয়ে ইজরাইল আজ একটা দানবে পরিণত হয়েছে। ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রী এখন প্রেসিডেন্ট বাইডেনকেও মানতে চায় না। মনে হয় ছাত্র তার শিক্ষকের চেয়ে বেশি স্মার্ট এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তারা এখন জাতিসংঘের মহাসচিবকেও ভিসা না দেয়ার হিম্মত দেখাতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলের পক্ষে ভেটো ক্ষমতা ব্যবহারের কারণে জাতিসংঘের এখন ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে বিশ্ববাসীকে মৌখিক পরিষেবা দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। বিশ্বের সভ্য দেশের নেতারা ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়ার সমালোচনা করছে। আক্রমণকারী আগ্রাসী রাশিয়াকে থামাতে ইউক্রেনকে সকল প্রকার সাহায্য সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

ইরানকে পরমাণু প্রকল্প হাতে নেয়ায় অবরোধ আর বিধিনিষেধ দিয়ে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আগ্রাসী দখলদার বর্বর ইজরাইলকে পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও থামাতে চাইছে না, বরং ফিলিস্তিনিদের ওপর সব ধরনের অমানবিক বর্বরতম কর্মকাণ্ড চালিয়ে তাদের ভূমি দখল অব্যাহত রাখতে অস্ত্র-গোলাবারুদসহ সব সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে। তাই শান্তিকামী মানুষের প্রশ্ন গাজায় সব অবকাঠামো ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে আশি শতাংশ মানুষ গৃহহীন খাদ্য চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষ অনাহারে আতংকে নিদ্রাহীন মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। এতো অমানবিকতা, মানুষের প্রতি মানুষের এতো নিষ্ঠুরতা দেখার পর মানবতাবাদী মার্কিন-ইউরোপিয়ান নেতাদের দানব ইজরাইলকে গাজায় চলমান গণহত্যা বন্ধ করাতে বাধ্য করতে কবে বিবেক জাগ্রত হবে? নাকি এই দানবকে দিয়েই মধ্য প্রাচ্যকে আমেরিকা ও পশ্চীমারা নরককুণ্ড বানাবে?

e-mail : [email protected]

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত