ঢাকা ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অবান্তর বিতর্ক, গুজব কাম্য নয়

অবান্তর বিতর্ক, গুজব কাম্য নয়

গুলির নির্দেশ দিয়ে শত শত আন্দোলনকারীকে হত্যা করেও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। সেদিন সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির লিখিত ভাষণে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। অর্ন্তবর্তী সরকারের শপথ গ্রহণের আগে সুপ্রিমকোর্টের মতামত চাওয়া হলে সুপ্রিমকোর্টের পক্ষ থেকে রায় দেয়া হয়, সে অনুসারে ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পরিষদের শপথ অনুষ্ঠিত হয়। তবে অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই পতিত স্বৈরাচারের দোসররা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য নানা রকম অপতৎপরতা ও ষড়যন্ত্র চালিয়ে আসছে। সরকারের সক্রিয় ভূমিকা ও ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। লক্ষ্য অর্জনের পথে সরকার সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। সরকারের আড়াইমাস পেরিয়ে যাওয়ার পর সম্প্রতি মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর কাছে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তার কাছে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নেই বলে মন্তব্য করে রাষ্ট্রপতি নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। এ নিয়ে রাজনীতির ময়দানে তোলপাড় চলছে। রাষ্ট্রপতির ৫ আগস্টের বক্তব্য এবং এখনকার বক্তব্যের মধ্যে বৈপরীত্য থাকায় জনমনে বিভ্রান্তি ও সংশয় তৈরি হয়েছে। অর্ন্তবর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে মিথ্যাচারের অভিযোগ তুলে একে শপথ ভঙ্গের শামিল বলে দাবি করেছেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকা ব্যক্তির কাছ থেকে এমন দ্বিচারিতা কাম্য নয়। তবে তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হওয়া বিতর্কের প্রেক্ষিতে বঙ্গভবন থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এটি একটি মীমাংসিত বিষয়। এ বিষয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি না করতে রাষ্ট্রপতি আহ্বান জানিয়েছেন। একটি রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয়।

শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ভারত থেকে নানামুখী অপপ্রচার-অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন। যে কোনো সময় চট করে দেশে ঢুকে যাওয়ার মতো উদ্ভট মন্তব্য করে তা নেট দুনিয়ায় ফাঁস করে তিনি স্বৈরাচারের দোসরদের আশাবাদ জাগিয়ে রাখার চেষ্টাও করেছেন। এ ক্ষেত্রে মাঠের বাস্তবতা যা-ই হোক, গুজব ও অপপ্রচারই হচ্ছে তাদের মূল হাতিয়ার। জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে অর্ন্তবর্তী সরকারের মনোযোগকে মূল লক্ষ্য থেকে সরিয়ে দেয়া এবং অস্থিতিশীলতা ও অনাস্থা সৃষ্টি করাই এসব গুজব ও অপপ্রচারের মূল লক্ষ্য। সরকার এবং ছাত্র-জনতা এ বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক রয়েছে। শেখ হাসিনার গণভবন ত্যাগ, ভারতে পালিয়ে যাওয়া, গণমাধ্যমে সেনাপ্রধানের লাইভ ভাষণ, বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ, অর্ন্তবর্তী সরকারের শপথগ্রহণসহ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরের সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টে সেনাপ্রধানের উপস্থিতি ও সক্রিয় ভূমিকা দেখা গেছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগ একটি মীমাংসিত ইস্যু হলেও বিতর্ক ও গুজবের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতিকে ব্যাখ্যা দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করতে হয়েছে। এ বিষয়ে সেনাপ্রধানেরও একটি বক্তব্য এরইমধ্যে আসতে পারতো। তাতে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে যেতো। কারণ, পতিত স্বৈরাচারের দোসররা যে কোনো সাংবিধানিক বিতর্ক এবং অর্ন্তবর্তী সরকারের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি, অস্থিতিশীলতা ও সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের গুজবসহ নানাবিধ বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ পাচ্ছে। এসব অহেতুক গুজব সম্পর্কে ছাত্র-জনতা সচেতন থাকলেও আওয়ামী ফ্যাসিবাদের মুখোশধারী ও পলাতক সমর্থকরা বসে নেই।

দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বল্গাহীন লুটপাট, দুঃশাসন চালিয়ে দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছে। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে নানাবিধ আইনগত সংস্কারের মধ্য দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন অর্ন্তবর্তী সরকার। মাত্র দুই মাসের মধ্যেই বেশ কিছু ইতিবাচক ফলাফল দেখা যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধির গতি আপাতত শ্লথ হলেও অর্থনীতির সব সূচকে ইতিবাচক ধারা সূচিত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ আর্থিক খাতের সংস্থাগুলো সরকারের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু ভারত। তারা প্রকাশ্যে অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে অভিনন্দন জানিয়ে এই সরকারের সাথে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলেও বাস্তবে তার ইতিবাচক প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। মোদি সরকারের দ্বিমুখী নীতির কারণে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরও ভারতে বসে সরকারবিরোধী অপপ্রচার চালাতে পারছে। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আগরতলায় জমায়েত হওয়ার পরিকল্পনা করছে, সেখানে একটি প্রবাসী সরকারের ঘোষণা হবে ইত্যাদি ধরনের গুজবও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে। এমনকি ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমও এতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। যদিও বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দিল্লি, ত্রিপুরা, আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষ থেকে এসব তথ্য অস্বীকার করা হয়েছে। এ সময়ে নতুন করে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ইস্যুটি সামনে আসায় জনমনে সংশয় ও বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। পতিত স্বৈরাচারের ধংসস্তূপ সরিয়ে দেশকে প্রত্যাশিত লক্ষ্যে এগিয়ে নিতে হলে অহেতুক বিতর্কের সুযোগ রুদ্ধ করা জরুরি। এরইমধ্যে ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হলেও পরিবর্তিত বাস্তবতায় বহুল আলোচিত পিলখানা গণহত্যা, শাপলাচত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে গণহত্যার মতো ঘটনাগুলো এখনো বিচারের আওতায় আসেনি। অর্ন্তবর্তী সরকারের উপর দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষের আস্থা রয়েছে। গুজব ও অবান্তর প্রশ্ন ছড়িয়ে আস্থায় চিড় ধরানো যাবে না। সরকার ও প্রশাসনে থাকা স্বৈরাচারের সুবিধাভোগী ও দোসরদের সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে তাদের সরিয়ে দিতে হবে। ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশে পতিত স্বৈরাচারের প্রত্যাবর্তনের ন্যূনতম সুযোগ নেই। গণহত্যা ও রাষ্ট্র ধ্বংসের অপরাধে তাদের বিচারের সম্মুখীন করতে জাতি এখন ঐক্যবদ্ধ। বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতায় অর্ন্তবর্তী সরকার জাতির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত