ঢাকা ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১১ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারকে ভাবতে হবে

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারকে ভাবতে হবে

স্বাস্থ্য খাত সর্বদাই অবহেলা বা খামখেয়ালিপনার শিকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও এর ব্যতিক্রম হয়নি। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করা হলেও স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারে কমিশন গঠন করা হয়নি। গুরুত্ব এবং জটিলতা বিবেচনায় স্বাস্থ্য খাতের ট্রান্সফরমেশনের জন্য একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন যে অপরিহার্য তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।

দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কার করার জন্য ১১ সদস্যের দায়সারা গোছের একটি প্যানেল গঠন থেকে বোঝা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকটও স্বাস্থ্য খাত তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ কমিটি যে শুধু দায়সারা তার বড় প্রমাণ, কমিটি থেকে কোনো প্রকার রিপোর্ট পাওয়ার আগেই ‘স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন ২০২৪’, অধ্যাদেশ আকারে পাস করার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে যা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ার অবস্থার মতো। ১২টি অধ্যায়, ৪৬টি ধারা এবং ১১২টি উপধারা বিশিষ্ট এই অধ্যাদেশে মূলত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা; ব্যক্তিগত চেম্বার ব্যবস্থাপনা; লাইসেন্স প্রদান, লাইসেন্স বাতিল ও ফি নির্ধারণ; পরিদর্শন, প্রবেশ ও জব্দ করার ক্ষমতা; অ্যাম্বুলেন্স ও লাশ ব্যবস্থাপনা; বিদেশি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তি কর্তৃক সেবা প্রদান; স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা; হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য; স্বাস্থ্য সেবায় খাদ্য, ওষুধ ও মালামাল সরবরাহকারীর দায়িত্ব; রোগীর অধিকার, দায়িত্ব ও চিকিৎসা অবহেলা; চিকিৎসা সেবায় অবহেলাজনিত ক্ষতির প্রতিকার; জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদান; বেসরকারি হাসপাতালে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দরিদ্র প্রতিবন্ধী রোগীদের হ্রাসকৃত মূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান; ডিজিটাল প্লাটফর্মে চিকিৎসাসেবা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান; চিকিৎসা সেবার মান, যথার্থতা পরীক্ষণ, মূল্যায়ন ও রেফারাল; রেজিস্টার্ড সংরক্ষণ; স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষা কমিটি গঠন; মোবাইল কোর্টের ক্ষমতা এবং ওই আইনবহির্ভূত কোনো কাজে জড়িত থাকলে কী কী দণ্ড প্রদান করা হবে তার ব্যাখ্যাসহ নানাবিধ বিষয়ের উল্লেখ আছে। এই অধ্যাদেশে সেবাগ্রহীতা এবং সেবাপ্রদানকারীর সুরক্ষার বিষয়ে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য নির্দেশনা থাকলেও আইনটির নামসহ অনেক ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা, ভাষাগত দুর্বোধ্যতা, আইনি ভাষা প্রয়োগের অভাব, সেবাগ্রহীতা এবং সেবাপ্রদানকারীর কার্যকারী সুরক্ষার দিকনির্দেশনার অভাবসহ নানান ধরনের দুর্বলতা প্রত্যক্ষভাবে লক্ষণীয়।

যেমন ‘ব্যক্তিগত চেম্বারে বেসরকারি চিকিৎসাসেবা’র ক্ষেত্রে রোগীর ব্যবস্থাপত্রে সুস্পষ্টভাবে জেনেরিক ওষুধের নাম বড় অক্ষরে লিখিতে হইবে’ মর্মে একটি ধারা আছে। এই ধারাতে বেসরকারি হাসপাতাল এবং সরকারি হাসপাতালের কথা কিছু বলা হয়নি। কেন শুধুমাত্র ‘ব্যক্তিগত চেম্বারে বেসরকারি চিকিৎসা সেবা’র ক্ষেত্রে এ ধারা প্রযোজ্য হবে? তা ছাড়া এই ধারা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশ জটিলতা দেখা দেবে। কেননা, এই ধারার প্রয়োগ তখনই সম্ভব হবে, যখন সব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো সমমানের ওষুধ উৎপাদন করবে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর তা নিশ্চিত না করতে পারলে ওষুধের বাজার নিম্নমানের কোম্পানি হাতে চলে যাবে। বিদেশি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তি কর্তৃক সেবা প্রদান সংক্রান্ত বিষয়ে বলা হয়েছে ‘স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে এই আইনের অধীনে প্রণীত বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে বিনামূল্যে বা অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসাসেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে কোনো হাসপাতালে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে বিদেশি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তিকে নিয়োগ করা যাইবে’। এক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশ মেডিক্যাল এবং ডেন্টাল কাউন্সিল’ (বিএমডিসি) থেকে লাইসেন্স প্রাপ্তির প্রয়োজন হবে কি না তা উল্লেখ করা হয়নি। উল্লেখ্য, বিএমডিসির লাইসেন্স প্রাপ্তি ছাড়া কোনো বিদেশি চিকিৎসক মেডিক্যাল ইথিক্স অনুযায়ী রোগীর সংস্পর্শে আসা সমীচীন নয়। ‘স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত অভিযোগ: স্বাস্থ্যসেবার অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সরকার প্রতিটি জেলায় ‘স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষা কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করিবে’ মর্মে একটি উপধারা আছে। কিন্তু, জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষা কমিটি এর মাধ্যমে অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তি আদৌ সম্ভব কি না, তা বিবেচনাযোগ্য। এজন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটি সংস্থা গঠন করতে হবে এবং সার্বক্ষণিকভাবে টেলিফোনসহ বিভিন্নমাধ্যমে অভিযোগ জানানো, অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থাসহ ফিডব্যাক সিস্টেম থাকতে হবে। তা ছাড়া, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ-সুবিধা না বাড়িয়ে এ ধারা সংযুক্ত হলে সেবাপ্রদানকারী হেনস্তার শিকার হতে পারে। অন্যদিকে, রোগীরাও কোনো প্রতিকার পাবে না। ফলে রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক খারাপ হওয়ার ঝুঁকি আছে। আবার, একদিকে যেমন বেশকিছু ধারা এবং উপ-ধারা প্রবিধানে স্থান পাওয়ার যোগ্য সেগুলোর অন্তর্ভুক্তিতে অধ্যাদেশটি ভারবাহী হয়েছে, অন্যদিকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়েছে। যেমন প্রেক্ষাপট, যৌক্তিকতা এবং উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়নি। স্বাস্থ্যকে ‘উন্নয়ন এজেন্ডা’ হিসেবে বিবেচনা করা এবং সে অনুযায়ী গুরুত্ব প্রদান করার বিষয় সংযোজন করা হয়নি। দেশের সব নাগরিকের জন্য বৈষম্যহীনভাবে এবং স্বল্পমূল্যে গুণগতমানের সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা (প্রোমোটিভ, প্রেভিন্টিভ, কিউরেটিভ, রিহ্যাবিলিটেটিভ এবং প্যালিয়াটিভ) নিশ্চিতকরণে বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেসব চ্যালেঞ্জ-এর মুখোমুখি হতে হয়, তা মোকাবিলায় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং অর্থায়ন পদ্ধতির যেসব সংস্কার প্রয়োজন তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। গ্রাম অঞ্চলে সবার জন্য গুণগতমানের প্রমোটিভ, প্রিভেন্টিভ ও কিউরেটিভ সেবা সম্বলিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। শহর অঞ্চলে সবার জন্য গুণগতমানের প্রমোটিভ, প্রিভেন্টিভ ও কিউরেটিভ সেবা সম্বলিত প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের কোনো উল্লেখ নেই। সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবার পরিধি, গুণগতমান, সহজলভ্যতাসহ সার্বিক উন্নয়নের বিষয়ে কোনো ধারায় উল্লেখ করা হয়নি। যদিও অধ্যাদেশে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় রেফারাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রবিধান তৈরি করার বিষয় উল্লেখ আছে, কিন্তু রেফারাল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকরণের জন্য কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত