ঢাকা ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি আলাওলের জীবন ও সাহিত্য

ফজিলা ফয়েজ
মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি আলাওলের জীবন ও সাহিত্য

মধ্যযুগের কিংবদন্তি হিসাবে সমাদৃত ও উজ্জ্বল নক্ষত্র অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন কবি আলাওল। তাকে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের কবিদের মধ্যে বিশেষত মুসলমান কবিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচনা করা হয়। তার পাণ্ডিত্যের পটভূমি শতাব্দী ধরে মুগ্ধ করেছে মানুষকে। তার জন্মস্থান নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে নানান মতবিরোধ অনেকের মতে ১৬০৭ খ্রিষ্টাব্দে ফরিদপুর জেলার ফতেয়াবাদ পরগনার জামালপুর গ্রামে। আবার অনেকে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারি উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন বলেও দাবি করেন। একবার জলপথে নৌকাযোগে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে আলাওল ও তার পিতা পর্তুগিজ জলদুস্যুদের আক্রমণের শিকার হন। এই ঘটনায় তার পিতা জলদস্যুদের হাতে নিহত হন। অতঃপর জলদস্যুরা আহত আলাওলকে বন্দি করে ক্রীতদাস হিসাবে আরাকানে (বর্তমান মিয়ানমারের একটি রাজ্য) নিয়ে যায়। তখন তার বয়স কম ছিল। তার জীবনের অধিকাংশ সময় আরাকানেই কেটেছে। সেখানে ভোগ করেছিলেন অশেষ দুর্গতি, কবি তার বিখ্যাত ‘সিকান্দারনামা’ কাব্যে ভাগ্য বিড়ম্বনার চিত্র তুলে ধরেন এভাবে। মন্দকৃতি ভিক্ষাবৃত্তি জীবন কর্কশ, দারাপুত্র সঙ্গে অঙ্গ হৈল পরবশ। কবি আলওয়াল ছিলেন বহু বিদ্যায় বিদ্যান তার রচনা থেকে পাওয়া যায় যে, তিনি যোগশাস্ত্রে অনেক পারদর্শী ছিলেন। আরবী, ফারসী, মৈথলি, প্রাকৃতপৈঙ্গল ব্রজবুলি এবং বাংলা ও সংস্কৃতসহ অনেক ভাষা তার আয়ত্তে ছিল। এছাড়াও তিনি অনুবাদে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কাব্যধারায় কবিদের কবিত্ব বৈশিষ্ট বিচারে আলাওয়াল সে যুগের শীর্ষস্থানীয় কবির মর্যাদা পান। নিশ্চিত করে বলা যায়- কবিতার প্রতি আলাওয়ালের প্রতিভা ছিল অতুলনীয়। কাব্যতত্ব অলঙ্কার শাস্ত্র ও ছন্দ বিজ্ঞানে ছিলেন পারদর্শী। তার কামশাস্ত্র, অধ্যাত্মবিদ্যা, যোগ শাস্ত্র, ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্মশাস্ত্র, যুদ্ধবিদ্যা, নৌকা ও অশ্ব চালনায় বিশেষ পন্ডিত ছিলেন। তার কবিতাগুলোর মধ্যে গভীর আবেগ চিন্তাভাবনা জাগিয়েছে এবং রূপকে ভরা প্রেম, মানুষের অভিজ্ঞতার প্রাণবন্ত ছবি আঁকা।

অনেক অল্প বয়স থেকেই সৈয়দ আলাওল বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তার কাব্যপ্রতিভার পরিচয় পাওয়া গেলে একসময় তিনি হয়ে পড়েন রাজসভার কবি। তাকে কাব্যচর্চায় বিশেষভাবে উৎসাহিত করেন রাজার একজন প্রধান কর্মচারী মাগন ঠাকুর। কবি সৈয়দ আলাওল ছিলেন মধ্যযুগের সর্বাধিক গ্রন্থপ্রণেতা। তিনি বহুভাষাবিদ এবং শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত কবি ছিলেন পদ্মাবতী, সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামাল, হপ্ত পয়কর, সিকান্দার নামা ও তেয়াফা বা তত্ত্বোপদেশ এর মধ্যে তার প্রথম রচনা। তার প্রতিভার ব্যাপকতা ছিল অতুলনীয়। হিন্দু ও মুসলমান শাস্ত্রেও তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন। আলাওলের রচনা সরল অথচ প্রগাঢ়। ‘পদ্মাবতী’ তার শ্রেষ্ঠ আখ্যায়িকা। আলাওলের কাব্যমালায় মাঝে মাঝে গান বা পদাবলি আছে। আলাওলের প্রধান কাব্য ‘পদ্মাবতী’ যা ছিল কবি মালিক মুহম্মদ জায়সীর হিন্দি কাব্য ‘পদুমাবৎ’-এর অনুবাদ।

আলাওল উক্ত কাব্যে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মানবীয় প্রেমের কাহিনি পরিবেশন করেছেন। ‘প্রেমে বিনে ভাব নাই ভাব বিনে রস/ ত্রিভুবনে যাহা দেখি প্রেম হুনতে বশ/যার হূদে জন্মিলেক প্রেমের অঙ্কুর/ মুক্তি পাইল সে প্রেমের ঠাকুর। সবার আরাধ্য প্রেমের নিমিত্তে কবির কী অসাধারণ কাব্যকথা! প্রেম নিয়ে লেখা এই চারটি চরণ পাঠে প্রেমের অন্তহীন মহিমা এবং মাহাত্ম্য দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। মধ্যযুগীয় ধর্মপ্রচারমূলক বাংলা সাহিত্যধারার রচনাসমূহে এই ধরনের মানবীয় বিষয়ের অবতারণা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বাংলা সাহিত্যে এই কাব্যটির বিশেষ মূল্য রয়েছে। কাহিনি ও কাব্যগুণের জন্যে ‘পদ্মাবতী’ হিন্দু মুসলমান উভয় সমাজেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল বাংলা ভাষার রোমান্টিক কাব্য ধারার অন্যতম বিশিষ্ট কাব্য।

দোনা গাজী চৌধুরী, আলাওল, ইব্রাহিম ও মালে মুহম্মদ এই প্রেমকাহিনী অবলম্বনে কাব্য রচনা করেছিলেন। তন্মধ্যে আলাওলের কাব্যই সমধিক পরিচিত। সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল কাব্যের কাহিনির আদি উৎস আলিফ লায়লা বা আরব্য উপন্যাস। প্রেমমূলক কাহিনি কাব্য হিসেবে এর পরিচয়। রচনাকাল প্রায় ১৬৬০ খ্রি:-এর আগে। মহাকবি আলাওল তার বিখ্যাত সপ্ত পয়কর কাব্যে রাসুল বন্দনার প্রসঙ্গে লিখেছেন : ‘আদ্যেতি নিরুপ ছিল প্রভূর নির্বাকার/চেতন স্বরুপ যদি হইল প্রচার।/

অতি ঘোরতর তমঃআকার বর্জিত/ মহা জ্যোতিমংয় হৈল আল্লার-ঈঙ্গিত।/ জ্যোতি সমুদ্রে আদ্যি নুর মহাম্মদ/ জগৎ বিজয়ী হৈতে পাইল সম্পদ।/ সপ্ত স্বর্গ উদ্যানের আদ্য নব ফুল/

বৃদ্ধি বাক্যে শিরোমণি ভূবনে অতুল।/ সেই পুস্প হৈতে আদ্যে আদম উজ্জল/ সকল কদর্মপূর্ণ সে-ই নির্মল।’ কবি আলাওল দৌলত কাজির অসমাপ্ত কাব্য সতীময়না ও ‘লোরচন্দ্রানী’ গ্রন্থে মোহাম্মদের ‘সিফত’ বয়ান করেছেন এভাবে : আহাদ আছিল এক মিম হন্তে পরতেক। যে মিমেত জগৎ মোহন... মধ্যযুগের একজন কবির শব্দচয়ন, ভাবনার বিস্তার এবং বাক্যগঠন আজও সচেতন পাঠকমহলে সমাদৃত।

কবির যেমন সুর, তাল, লয় জ্ঞান আছে, তেমনি আছে শুদ্ধ ছন্দ ও মাত্রা জ্ঞান। আলাওলের ভেতর যে সত্যিকারের একজন কবি লুকিয়ে আছে তা মাগন ঠাকুর আগেই টের পেয়েছিলেন। আলাওয়ালের খ্যাতি দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ায় তিনি জনগণের কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। খ্যাতি অর্জন সত্ত্বেও, আলাওয়াল একজন নম্র এবং বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে রয়ে গেছেন। মধ্যযুগের একজন বিশিষ্ট কবি আলাওল আরবি ও ফারসি উভয় সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তার রচনাগুলো সাংস্কৃতিক প্রভাবের একটি অনন্য মিশ্রণকে প্রতিফলিত করে, যা তার কাব্যিক ফর্ম এবং থিমের উপর দক্ষতা প্রদর্শন করে যা ভাষাগত সীমানাজুড়ে অনুরণিত হয়। পরিশেষে বলা যায়, আলাওলের কবিতায় ইসলামী সংস্কৃতির প্রভাব ছিল গভীর ও সুদূরপ্রসারী। প্রেম এবং আধ্যাত্মিকতার বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে আরবি ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য, ইসলামী সংস্কৃতি আলাওলের কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গির গঠন তৈরি করেছে। তার রচনাগুলো পাঠকদের তাদের নিরবধি সৌন্দর্য এবং মানব অভিজ্ঞতার গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অনুপ্রাণিত করে, যা সাহিত্যের জগতে ইসলামী সংস্কৃতির স্থায়ী উত্তরাধিকারকে প্রতিফলিত করে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত