ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ : যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত
প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ছাত্র-জনতার দাবির মুখে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাহী আদেশে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে। এখন থেকে এ সংগঠনের নামে কোনো প্রকার প্রচারণা ও কার্যক্রম পরিচালনা করা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কার্যত একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। পুরোনো ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করলেও নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের নিষ্ঠুর হামলা, খুন-জখম ও নিপীড়নের ইতিহাস তার গৌরবময় ইতিহাসের চেয়ে অনেক বেশি ভারী। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ড বা পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের আসল রূপ জনসম্মুখে উঠে আসে। সে সময় জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক মানিক তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালন করেছিল। তা রীতিমত সেলিব্রেট করা হয়েছিল। সেই মানিককে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাশে রেখে অনুষ্ঠান করেছিলেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পদক মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে এক নারীর স্বামীকে বেঁধে রেখে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ধর্ষণের পর শরীরে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরা, মাদক ব্যবসা, ক্যাম্পাসে গাঁজার চাষ ইত্যাদি অভিযোগ উঠলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ভয়ঙ্কর সব অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগ আবারো সাংগঠনিকভাবে ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভূত হয়। শিশু শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনীর নির্মম তাণ্ডব। ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনীর রক্তাক্ত হামলার ধারাবাহিকতায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেও ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা দমন করার চেষ্টা করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে বিতাড়িত হয়েছে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে শত শত শিক্ষার্থী-জনতা হত্যার পেছনে দলবাজ পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগকে সশস্ত্র অবস্থায় দেখা গেছে।
আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার আগেই ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তী রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ছাত্রলীগের গৌরবময় ভূমিকা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা এবং ছাত্রলীগের নানা অপকর্ম এবং পরবর্তী সাড়ে চার দশকে ছাত্রলীগ তার ঐতিহ্য হারিয়ে গুম-খুন, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের এক ভয়ঙ্কর চরিত্র হয়ে উঠেছিল। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখানে ভিন্নমতের কোনো সংগঠন, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পরিচয়ে সহাবস্থানের অধিকার রহিত করা হয়েছিল। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল নেতাদের যত্রতত্র ক্যাম্পাসে পিটিয়ে জখম করতে দেখা গেছে। ছাত্রশিবির ট্যাগ দিয়ে যে কাউকে পিটিয়ে হত্যা করাকে ছাত্রলীগ অপরাধ বলে বিবেচনা করত না। লগি-বৈঠার তাণ্ডবে রাজপথে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে লাশের ওপর পাড়া দিয়ে নৃত্য করার দৃশ্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্রশিবির সন্দেহে হিন্দু শ্রমিক বিশ্বজিৎকে নির্মমভাবে পিটিয়ে মারা কিংবা ফেসবুকে ভারতকে কটাক্ষ করে বাংলাদেশের পক্ষে স্টাটাস লেখার কারণে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ছাত্রলীগের পৈশাচিক নির্মমতার উদাহরণ।
গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে ভারতীয় স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছে। আর ছাত্রলীগকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। দেশের পুলিশ বাহিনী, জনপ্রশাসন, শিক্ষায়তন, বিচার বিভাগসহ সর্বত্র ছাত্রলীগের পরিচয়ধারীরা নিয়োগ পাওয়ায় অবক্ষয় ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি রাষ্ট্রকে মহাবিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হাসিনার পতন ঘটলেও ছাত্রলীগসহ স্বৈরাচারের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার নানাবিধ চক্রান্তে মেতে উঠেছে। নির্বাহী আদেশে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের মধ্য দিয়ে অপরাধী ও ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে বিচারের সম্মুখীন করা সহজ হবে বলে আশা করা যায়। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়া ছাত্রলীগ ও স্বৈরাচারের দোসরদের চিহ্নিত ও বিতাড়িত করতে হবে। হাজার শহীদের রক্ত ও দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষের সমর্থনপুষ্ট অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কার ও গণতান্ত্রিক রোডম্যাপ বাস্তবায়নের উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দিতে যারা এখনো সক্রিয় তৎপরতা চালাচ্ছে তাদের প্রতিহত করা এখন সময়ের দাবি। যারা আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের পুরোনো ঐতিহ্যের কথা বলে নিষিদ্ধের বিরোধীতা করছেন, তাদের হিটলার-মুসোলিনীর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার ইতিহাস অতঃপর ফ্যাসিবাদ কায়েম করে ইউরোপে যুদ্ধ ছড়িয়ে পরাজিত হওয়ার পর নিষিদ্ধ হওয়া ও বিচারের সম্মুখীন হওয়ার ইতিহাস স্মরণ করতে হবে। বারবার গণতন্ত্রবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ পার পেয়ে গেলে এদেশ কখনোই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। আওয়ামী লীগ একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের নামে ক্যাঙ্গারু কোর্ট সাজিয়ে জামাত-বিএনপির শীর্ষ নেতাদের জুডিসিয়াল কিলিংয়ের শিকারে পরিণত করেছিল।
গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে সব গুম-খুন, ম্যাসাকার ও গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে তা নিয়ে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল এরই মধ্যে শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। গুম-খুন ও গণহত্যার বিচার থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নেই। এসব অপরাধের বিচারের ধারাবাহিকতায় অপরাধী ও গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগও নিষিদ্ধ হতে পারে। ছাত্র-জনতার যৌক্তিক দাবিকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। নৈরাজ্য ও ষড়যন্ত্র করে পার পাওয়া যাবে না। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের প্রতি সরকার ও ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে সেই বার্তাই দেয়া হলো।