ষোলো বছরের সরকারবিরোধী টানা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল বিএনপি। চলতি পথে নিঃস্ব, রিক্ত কখনোবা ছন্নছাড়া মনে হয়েছে দেশের প্রধান এই রাজনৈতিক দলকে। নরমণ্ডগরম সব ধরনের কর্মসূচিতে দৃশ্যমান টেকসই সাফলতা না পাওয়ায় নিষ্ঠুর রসিকতার শিকার হয়েছে তারা। ফেসিস্ট সরকারের কঠোর দমনপীড়ন, ক্ষমতাসীন দলের উসকানিমূলক উপহাস নেতাকর্মীদের ক্লান্ত করেছে। কোটি কোটি সমর্থক হতাশ হয়ে অলৌকিক শক্তির সাহায়তা কামনা করেছে। কিন্তু রণে ভঙ্গ দেয়নি বিএনপি। রাজপথের স্থায়ী বিরোধীদলের পরিচিতি নিয়েও বাধ্য হয়ে মাঝেমধ্যে এনজিওর মতো সুশীল সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে ব্যস্ত থেকেছে। সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার সমালোচনা না করে আন্দোলনে ব্যর্থতার জন্য দলটিকে জনতার কাঠগড়ায় তুলেছে তথাকথিত বিশ্লেষকরা। অথচ তারা অবগত ছিলেন কর্তৃত্ববাদী সরকারের সক্ষমতা সম্পর্কে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অভিভাবকত্বে দেশের আনহোলী চক্র দিয়ে দুর্লঙ্ঘনীয় ব্যূহ রচনা করেছিল হাসিনা সরকার। হাজার চেষ্টা করেও দীর্ঘদিনের অলাভজনক দলটি ভাঙতে পারেনি তারা। দেশি-বিদেশি চরদের মাধ্যয়মে শুধু শুধু কোটি কোটি টাকা চুরি হয়েছে বিএনপি ভাঙার লস প্রজেক্টে।
গত দেড় দশকে নির্বাচন নামের প্রহসনে যোগ দিয়েছে এবং বয়কটও করেছে বিএনপি। অথচ, দুই কারণেই তুলাধোনার শিকার হয়েছে গণতন্ত্রকামী দলটি। আন্দোলন ও নির্বাচন কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় তাদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে বত্রিশটি রাজনৈতিক দল। তাদের মধ্যে জামায়াত ছাড়া অন্য কারও তেমন কোনো প্রভাব নেই ভোটে বা মাঠে। কিন্তু ভাগবাঁটোয়ারার আগাম পরিকল্পনায় জিন-পরীর মতো হিস্যা দাবি করেছে তারা। একসময়ের আন্দোলনের সাথী আওয়ামী লীগের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা জামায়াত স্বনামে দাঁড়াতেই পারেনি রাজপথে। কিন্তু ভাগের বেলায় বিএনপির সামনে মুড়ির মতো ফুলেফেঁপে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। গুম-খুন-হামলা-মামলা-আটকে জেরবার দলটির নেতারা মানবাধিকার প্রশ্নে ধরনা দিয়েছে বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে। এ নিয়েও তাদের বাক্যবাণে জর্জরিত করেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষমতায় থাকা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সম্প্রতি তাদের দোসর জাতীয় পার্টি এবং আসরের অতিউৎসাহী খেলোয়াড় জামায়াত দৌড়ঝাঁপ করছে বিদেশি কূটনৈতিকপাড়ায়। এ নিয়ে তেমন কোনো সমালোচনা নেই বিশেষজ্ঞ মহল্লায়। অবশ্য বেশিরভাগ সমালোচকই এখন পলাতক প্রায়। গত দেড় যুগে ইস্পাতকঠিন ঐক্য নিয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মতোই আপসহীন প্লাটফর্ম হিসেবে দেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বিএনপি। ফলে তাদের নিজেদের গোলায় ভরতে চাইবে আন্দোলনের ফসল। অন্য কোনো সোনার তরীতে ঠাঁই পাবে না সোনার ধান। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স প্রায় ৯০ দিন। প্রথম দিন থেকেই জনপ্রত্যাশা ও আওয়ামী হতাশার বহুরূপী চাপে ব্যস্ত তারা। ১৫ বছরের টানা রুটিনে অভ্যস্ত সরকারি কর্মচারীদের অসহযোগিতায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে প্রশাসন। অভিজ্ঞ ডাকসাইটে কর্মকর্তারা পগারপার হয় ও কারাগারে যায়। তাদের শূন্যতা পূরণে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় সরকার।
এসব নিয়োগে চোখ পড়ে আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোর। সচিবালয়, বিভিন্ন অধিদপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতালে দেদার নিয়োগ চলছে। এ প্রক্রিয়ায় পিছিয়ে পড়ে বিএনপি। আওয়ামী লীগের দেড় দশকে বিএনপিপন্থি পেশাজীবীরা ছিল দৌড়ের ওপর। তাদের পদোন্নতি, প্রশিক্ষণ আটকে ছিল বছরের পর বছর। অনাকাঙ্ক্ষিত বদলি, ওএসডি এবং চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে। পটপরিবর্তনের পর দক্ষ ও যোগ্য লোকের হঠাৎ ঘাটতি দেখা দেয়। এ ফাঁকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ঢুকে পড়ে জামায়াত, হেফাজত সমর্থক পেশাজীবীরা। এর সঙ্গে যোগ হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনপুষ্ট বিভিন্ন পাঠচক্রের প্রতিনিধিরা। মজার ব্যাপার হলো, বিএনপি ছাড়া সুবিধাভোগী অন্য পেশাজীবীদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে ৫ আগস্টের আগে তেমন কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। বরং, এতদিন রাজনীতিবিমুখ ভদ্রলোক এবং নামাজি ও ভালো মানুষের তকমা উপভোগ করেছে তারা। কিন্তু প্রশাসনের গতি দৃশ্যমান না হওয়ায় দ্রুত মোহভঙ্গ হচ্ছে পরিবর্তনপ্রত্যাশীদের। তারা বলছে, যার হয় না নয়ে; তার হয় না নব্বইয়ে।
স্মরণকালের ভয়াবহ দলীয়করণের ফলে হাসিনা প্রশাসনের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের কর্মী হয়ে যায়। প্রথমদিকে নিয়মনীতির কথা বলায় অনেককে বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ লাগিয়ে নাজেহাল করা হয়। একপর্যায়ে প্রতিবাদ করার আর কেউ থাকে না। তখন শক্তির ধর্ম অনুযায়ী সবল আওয়ামী লীগ দুর্বল আওয়ামী লীগকে পর্যুদস্ত করে। কেননা, শক্তির বিনাশ নেই। কোথাও না কোথাও খরচ করতে হবে। সে সময় ত্যাগী ও হাইব্রিড নামে দুই ধরনের আওয়ামী লীগ সমর্থক কর্মচারীদের দেখা মেলে। হাসিনা সরকারের পতনের পর হাইব্রিড কর্মচারীরা তাদের গডমাদারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পালিয়ে যায়। ত্যাাগী বলে যারা আহাজারি করত রাতারাতি তারা নিজেদের বঞ্চিত বলে পরিচয় দেয়া শুরু করে। এই শ্রেণির অনেকেই ড. ইউনূস সরকারের সময় বেশ গুছিয়ে নিয়েছে। মাঝেমধ্যেই এ ধরনের খবর গণমাধ্যমে বেরোয়। ‘১৫ বছর সুবিধা ভোগের পরও বহাল তবিয়তে অমুক’ ছবিসহ শিরোনাম হয়। আর কিছু হয় না। সব ম্যানেজ হয়ে যায়। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে অভিযোজন প্রক্রিয়া খুবই শক্তিশালী। আওয়ামী লীগ শাসনামলে সুবিধা পেলেও আত্মীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জড়িত থাকায় টিকে যায়। বাধ্য হয়ে স্বৈরাচারের দোসর হতে হয়েছে বলে রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ চায়। সুবিধা নিশ্চিতে মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তাও দোষের কিছু নয়। না হলে বঙ্গবন্ধুর নাতনির বিয়ে হয় নুরু রাজাকারের নাতির সঙ্গে! এ যেন আবহমান বাংলা সিনেমা।
দীর্ঘ সংগ্রামের পর ক্ষমতার কাছাকাছি এসে সংকটে পড়েছে বিএনপি। সফল গণঅভ্যুত্থানের পর তাদের পূর্ণ সমর্থন জানাতে হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারকে। এর আগে বিশেষ পরিস্থিতিতে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে। এবার চলছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরই মধ্যে মুখে মুখে নাম হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ক্ষমতা গ্রহণের দিক দিয়ে বিপ্লবী হলেও নিয়মিত সরকারের বৈশিষ্ট অর্জনে সচেষ্ট তারা। সংসদ ভেঙে দিলেও সংবিধান স্থগিতের ঘোষণা নেই। নির্বাচিত সরকারের হাতে যৌক্তিক সময়ে ক্ষমতা ছাড়ার অঙ্গীকার থাকলেও ধীরগতির সংস্কারে ঝোঁক বেশি। তবে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। অনভিজ্ঞ উপদেষ্টা পরিষদের ভুলত্রুটির সমালোচনা গিয়ে পড়ছে বিএনপির ওপর। অথচ সরকারে নেই বিএনপি। আবার জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সরকারের সব কাজে প্রশাসনের পাশে দেখা যায় বিএনপি-জামায়াতকে। কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগবিরোধী অন্যান্য ইসলামী দল সাধ্যমতো সরকারের অংশ বলে পরিচয় দিচ্ছে। অন্তর্বর্তীর পর কে পরবর্তী সরকার? এ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। এদিকে বসে নেই পলাতক আওয়ামী লীগ। ইউনূস বা বিএনপি নয়, তারা চায় ক্ষমতা নিক অন্য কেউ। একসময় বিএনপি যেমন বলত অন্তত আওয়ামী লীগ নামুক।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে একযোগে বেরিয়ে আসে বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা। দীর্ঘ বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত কর্মীদের কেউ কেউ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হয়। তাদের সম্পদ দখলে নামে। নিজেদের বিজয়ী এবং সরকারের অংশ মনে করে বিএনপি নেতাকর্মীরা। এ সময় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের। তীরে এসে তরী ডোবার ঝুঁকি মোকাবিলা করেন তিনি। যদিও শেখ হাসিনা পালাতে বাধ্য হয় ছাত্র-জনতার দুই মাসের দুর্বার আন্দোলনের রক্তাক্ত পরিণতিতে। কিন্তু বিএনপি মনে করে; সরকার পতনের আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করেছে তারা। ফ্যাসিস্ট সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দিনের পর দিন রাজপথে ছিল বলেই সবাই সাহস করে নেমেছে। গত দেড় দশকে শত শত নেতাকর্মীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বৈরাচারীর বিদায় লেখা হয়েছে সবার অলক্ষ্যে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দিয়েছে। এর নেপথ্যে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধন রয়েছে বলে দোষারোপ করেছে। দাবি যৌক্তিক ও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে বিএনপি। সরাসরি অন্য কোনো দল তখন আন্দোলনের কৃতিত্ব দাবি করেনি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বলেই পরিচিতি পায়। কোটা থেকে একদফার আন্দোলনে শামিল হয় দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। পরে বিএনপির পাশাপাশি নিজ নিজ দলের শহীদের তালিকা নিয়ে হাজির হয় অনেকে। তবে যে কোনো আন্দোলনই সফলতা পায় ছাত্র-জনতা তথা সাধারণ মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে। আর সে সফলতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে প্রয়োজন হয় সুসংগঠিত, অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দলের। সংবিধান মেনে বিপ্লব হয় না। আবার সংবিধান ছাড়া বেশি দিন দেশ চলে না। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা পথ দেখান। পদাতিক হন রাজনীতিবিদরা। তবে জনগণ পথ হাঁটার অনুমোদন দেয় নির্বাচনের মাধ্যমে। যত তাড়াতাড়ি সেটা সম্ভব, ততই দেশ-জাতির মঙ্গল। কেননা, রক্তে কেনা ফসল আর কোনো বর্গিকে দিতে চায় না জনতা।