জলবায়ু পরিবর্তনে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে
আফতাব চৌধুরী
প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
পৃথিবীর বুকে মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবাঞ্ছিত চাপ পড়তে শুরু করে। তবে এ সময় জনসংখ্যার স্বল্পতা, বনাঞ্চলের ভরপুরতা, কৃষিকেন্দ্রিক জীবিকা তথা জীবাশ্ম জ্বালানির অপ্রচলন আদি কারণ হেতু প্রাকৃতিক পরিবেশে লক্ষ্যণীয় প্রতিকূল প্রভাব পড়েনি। যৎসামান্য হানিকর প্রভাব পড়লেও প্রাকৃতিক নিয়মে তার সংশুদ্ধি ঘটে যায়। তাই তখন পরিবেশ নিয়ে ভাবিত হবার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু মানব সভ্যতার অগ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। পরিবেশের উপর প্রতিকূল প্রভাবের মাত্রা বৃদ্ধি ক্ষিপ্রতা লাভ করে। পশ্চিমা দেশে শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে পরিবেশের ওপর মানব কর্মকাণ্ড সৃষ্ট চাপ অসহনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়, যার ভয়াবহতা ক্রমে আমাদের উদ্বেগের স্তর অতিক্রম করে প্রাণীকূলের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে এক অশনি সংকেতরূপে প্রকটিত হয়। শিল্পায়ন-নগরায়নের চাকা যে হারে অগ্রসর হতে লাগল সে হারে বনাঞ্চলের প্রাচুর্য হ্রাস হলো। কলকারখানা ও যানবাহনের আকস্মিক সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে জীবাশ্ম জ্বালানির দহনের মাত্রা ক্রমাগত বাড়তে থাকল। জীবাশ্ম জ্বালানির ক্রমবর্ধমান দহন বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রার উত্তরোত্তর সংযোজনে সহায়ক ভূমিকা পালন করল।
অপরদিকে ক্রম হ্রাসমান বনাঞ্চল বায়ুমণ্ডল থেকে ক্ষতিকারক কার্বন-ডাই-অক্সাইডের যথাযথ বিয়োজনে অপারগ হয়ে পড়ল। ফলস্বরূপ বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড জমা হতে লাগল। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ধর্ম তাপ ধারণ তাই পুঞ্জীভূত এ গ্যাসের প্রভাবে বায়ুমণ্ডল উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হতে লাগল। বিশেষ করে উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রাবৃদ্ধি নাটকীয় রূপ ধারণ করে। ‘গ্রিন হাউজ গ্যাস’ আখ্যাত এ কার্বণ-ডাই-অক্সাইড গোলকীয় উষ্ণায়নের মুখ্য ঘটক। বুড়িগঙ্গা বাঁচবে ঢাকা বাঁচবে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রখর সূর্যকিরণ, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, পৃথিবীর কক্ষপথ, সমুদ্রস্রোত এবং আরো কিছু প্রাকৃতিক কারণে পৃথিবীর উষ্ণতার তারতম্য তথা জলবায়ু পরিবর্তন ঘটে থাকে, যা আমাদের এ পৃথিবী নামক গ্রহের সৃষ্টিলগ্ন থেকে চলমান রয়েছে। তবে বর্তমানে উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এত উদ্বেগ এবং এত আলোচনার কারণ ভিন্ন। তা হলো, কোনো প্রাকৃতিক উপাদান নয় বরং মানুষের নানাবিধ কাজকর্মের ফলস্বরূপ বিগত বহু বছর ধরে বায়ুমণ্ডলের ক্ষতিকারক গ্যাস বিশেষ করে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রার সঙ্কটজনক বৃদ্ধি গোলকীয় উষ্ণায়নের প্রধান কারণ। বর্তমানে মানুষের বিভিন্ন কাজকর্মের ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা এককথায় অস্বাভাবিক ও ভয়াবহ।
শিল্প বিপ্লবের সূচনালগ্ন থেকেই মানুষের জীবনশৈলী, পরিবেশ ও জলবায়ুর আকস্মিক পরিবর্তন আসে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ ঘটে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, কলকারখানা, যানবাহন চালনা ইত্যাদির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ব্যাপক মাত্রায় শুরু হয়। অপরদিকে পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে বনভূমি নিধন। মানুষের বিভিন্ন কাজকর্মের ফলে বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড জমা হয়, তার শতকরা ৭৫ ভাগ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে আসে। বায়ুমণ্ডলে এ মারাত্মক হারে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রাবৃদ্ধিতে ‘গ্রিন হাউজ গ্যাস এফেক্ট’ নামক প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পায়।
শিল্প বিপ্লবের পর এক শতকের অধিক সময় অতিবাহিত হয়। ঐ দীর্ঘ সময়কালে পরিবেশ নিয়ে আমাদের উদ্বেগ তেমন প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। বিশ্ব পরিবেশ নিয়ে আমাদের উদ্বেগের আনুষ্ঠানিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭২ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে জাতিসংঘের বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনে। পরিবেশ সম্পর্কে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিময়ের সুযোগ ঘটে ওই সম্মেলনে।
সম্মেলনে উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে সুদীর্ঘ পর্যালোচনার পর যে বিষয়ে মতৈক্য সৃষ্টি হয় তা হল, গোটা পৃথিবীর পরিবেশ বর্তমানে তীব্র সঙ্কটাপন্ন এবং এর থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে আশু কার্যকরী ব্যবস্থা গৃহীত না হলে অনতিকালের মধ্যে অবস্থা নিয়ন্ত্রণ অযোগ্য হয়ে পড়বে। এ গুরুতর সতর্কবাণী উচ্চারিত হবার পর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিবেশ নিয়ে নানা আলোচনা তথা সেমিনার, বিতর্ক, পদযাত্রা ইত্যাদির মাধ্যমে উদ্বেগ প্রকাশের পালা শুরু হয়।
পরিবেশ সচেতনতাকে জাগ্রত ও উন্নততর করার লক্ষ্যে প্রতি বছর ৫ জুন দিনটিকে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ রূপে পালন করার প্রথা চালু হয়।
পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, ব্রাজিলের রাজধানী রিও-ডি-জেনিরিও-তে ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলন। স্থ’ূল কলেবরের এ সম্মেলনে বিশ্বের ১৬০ টি দেশের প্রায় ৮ হাজার প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। পরিবেশ সম্পর্কে এত দীর্ঘ ও বিস্তৃত আলোচনা ইতোপূর্বে আর হয়নি। উক্ত সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিরা পরিবেশ রক্ষার্থে যেসব বিষয়ে সহমত পোষণ করেন তা অতি তাৎপর্যপূর্ণ ও নজিরবিহীন। এর মধ্যে অন্যতম হলো পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ।
সাম্প্রতিককালে উষ্ণায়ন এবং তৎসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জি-আট সম্মেলনে বিষয়টি আলোচ্য সূচিতে গুরুত্ব পায়। ১৯৭২ সালের স্টকহোম সম্মেলনের পর দীর্ঘ চার দশক অতিক্রান্ত। এ সময়কালে পরিবেশ রক্ষায় প্রভাবী পদক্ষেপ গ্রহণে আমরা কতটুকু সমর্থ হয়েছি বা বিভিন্ন সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলো কতটুকু অনুসৃত হয়েছে সে ব্যাপারে আত্মতুষ্টির তেমন অবকাশ না থাকলেও ইত্যবসরে যে ইতিবাচক দিকটি ধরা পড়েছে তা হলো পরিবেশ চিন্তা আজ সারা বিশ্বে এক সর্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণ ও তার সফল রূপায়নে এ উপলব্ধি অবশ্য সহায়ক হবে। কেননা যে কোনো গভীর সমস্যা সমাধানের প্রাক শর্ত হলো সমস্যা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানার্জন।
উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে এক গোলকীয় সমস্যার রূপ ধারণ করেছে। মানব জীবনের কোনো দিক যে এর কুণ্ডপ্রভাব মুক্ত থাকতে পারবে না তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এর কুণ্ডপ্রভাবে নিত্যনতুন স্বরূপ উন্মোচিত হচ্ছে। উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব বিষয়ে ইতোমধ্যে যেসব তত্ত্ব ও তথ্য আমাদের গোচরে এসেছে তা একজন পরিবেশ সচেতন মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নেবার পক্ষে যথেষ্ট।
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে নাটকীয়ভাবে বাড়তে শুরু করে। দেখা গেছে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ১৮৫০ সালের পিপিএম ২৯০ (পার্টস পার মিলিয়ন) থেকে বেড়ে ১৯৭৯ সালে দাঁড়ায় ৩৩৪ পিপিএম। ঊর্ধ্ব এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সাল নাগাদ বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ১৯৭৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণ হবার সমূহ সম্ভাবনা বিদ্যমান। ফলস্বরূপ গোলকীয় উষ্ণায়নের মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে, যার ভয়াবহ প্রভাব থেকে মানুষসহ গাছপালা, পশু পাখি কিছু রেহাই পাবে না। বলাবাহুল্য, উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের এ ভয়াবহতা ইতিমধ্যে আমরা উপলব্ধি করতে শুরু করেছি।
উষ্ণায়ন মানুষ তথা অন্যান্য প্রাণীকূলের শরীর ও স্বাস্থ্যে মারাত্মক রকমের প্রতিকূল প্রভাব ফেলে থাকে। প্রত্যক্ষভাবে উষ্ণায়ন সৃষ্ট হিটওয়েভ বা তাপ প্রবাহের কবলে পড়ে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর হার দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া এর পরোক্ষ ফল হিসেবে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে চলেছে। উষ্ণায়নের ফলে চর্ম, ফুসফুস সম্বন্ধীয় বিভিন্ন জটিলতা ও রোগ সৃষ্টি হতে পারে। গোলকীয় উত্তাপ বিশ্বে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু থেকে শুরু করে বিভিন্ন দূরারোগ্য রোগের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করবে বলে বিজ্ঞানীরা অনেক পূর্বে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। দেখা যাচ্ছে, যত দিন যাচ্ছে তত উষ্ণায়ন সৃষ্ট ব্যাধির কথা প্রকাশ্যে আসছে।
সম্প্রতি টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, আসন্ন বছরগুলোতে উষ্ণায়নের পরিণতিস্বরূপ এক বিরাট সংখ্যক আমেরিকাবাসী কিডনি স্টোনের সমস্যায় ভুগবেন। প্রখর উত্তাপের ফলে শরীর থেকে অত্যধিক ঘাম বেরিয়ে যাওয়া এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান না করার জন্য কিডনিতে পাথর হতে পারে। গবেষকদের মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ কিডনি স্টোন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বর্তমান ১৬ লক্ষ থেকে বেড়ে ২২ লাখ পর্যন্ত হতে পারে যার ফলে চিকিৎসা বাবদ ব্যয় হবে অন্যূন এক বিলিয়ন ডলার।
গবেষকদের এ তথ্য আমেরিকাণ্ডসমন্ধীয় হলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশও যে অনুরূপ সমস্যায় জর্জরিত তা বলাবাহুল্য।
শুধু মানুষ নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীও গোলকীয় উষ্ণায়নের বিরূপ প্রভাবে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রভাবিত। জীববৈচিত্র সম্পর্কিত গবেষণা থেকে জানা যায়, ফসিল রেকর্ড রয়েছে এমন যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে দ্রুতবেগে বিভিন্ন প্রজাতি বিলুপ্ত হচ্ছে। জীববৈচিত্র্যের এ দ্রুত বিনাশ নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত।
গোলকীয় উষ্ণায়নের বিরূপতায় প্রাণীকূলের মতো উদ্ভিদকুলও সমানভাবে অপকৃত। উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও প্রজননে জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল পরিলক্ষিত হয়। অনেক উদ্ভিদ পরিবর্তিত অবস্থা মানিয়ে নিতে পারে না। বিষয়টির গভীরতা উপলব্ধি করতে একটি উদাহরণের উপস্থাপনা প্রাসঙ্গিক হবে। সাম্প্রতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, বিভিন্ন ফুলের মনমাতানো আকর্ষণীয় সুগন্ধ দিন দিন কমে আসছে। হয়তো এমনো দিন আসবে যখন ফুলের গন্ধ একেবারে হারিয়ে যাবে। সুগন্ধ সুবর্ণবিহীন ফুল কি তখন আর মানুষের মনে রোমান্স জাগাতে পারবে?
‘ফুল কে না ভালোবাসে’-কথাটি কি অর্থহীন হয়ে পড়বে না অথবা ‘ফুলে গন্ধ সে তো ভাবতে পারি না’ গানটি কি প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না? ফুলের গন্ধহীনতা ফুল ও পতঙ্গ উভয়কে সমস্যায় ফেলেছে। গন্ধের সাহায্যে ফুলের সন্ধান করে মধু আহরণে সমস্যায় পড়ছে মৌমাছি, ভ্রমর আদি কীটপতঙ্গ। ফলে মৌমাছিসহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গের জীবনধারণ প্রণালীতে ব্যাঘাত ঘটছে। অপরদিকে কীটপতঙ্গের আনাগোণা কমে যাওয়ায় ফুলের পরাগ সংযোগও বিঘ্নিত হচ্ছে যা ফুল-ফল-বৃক্ষের বিকাশ অনুক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে উদ্ভিদকুলের ভবিষ্যৎকে সঙ্কটাপন্ন করে তুলছে।
উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের আর্থ-সামাজিক প্রভাব কত ভয়াবহ ও সুদুরপ্রসারী তার ধারণা অত্যন্ত দূরূহ। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ুর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জলবায়ুর অবাঞ্ছিত পরিবর্তনের ফলে কোথাও প্রচন্ড খরা আবার কোথাও প্রবল বর্ষণ ও বন্যা ভয়ংকর প্রাকৃতিক ও মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব লক্ষিত হচ্ছে খাদ্যশস্য উৎপাদনে। খরা-বন্যা দুয়ের ফলে কৃষির উৎপাদন সরাসরি ব্যাহত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ত্রাণ ও পুনর্বাসনে সরকারি কোষাগারের সংকোচন ঘটছে-বিঘ্নিত হচ্ছে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের রূপায়ণ। কৃষিজ সামগ্রীর উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিল্পের উপর, কেননা অধিকাংশ শিল্প-কারখানা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল।
এমতাবস্থায় অদূর ভবিষ্যতে ভয়ংকর খাদ্যসঙ্কট সৃষ্টি হবার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। উল্লেখ্য, নেপাল, বাংলাদেশ, উত্তর কোরিয়াসহ অনেক দেশে খাদ্যাভাব ইতিমধ্যে সঙ্কটজনক পরিস্থিতি ধারণ করেছে। এমনকি আমেরিকার মতো উন্নত দেশ যে অদূর ভবিষ্যতে খাদ্য সঙ্কটের ছায়ামুক্ত থাকতে পারবে না, এমন আশঙ্কা ওই শক্তিধর দেশটির বিজ্ঞানীরাও ব্যক্ত করেছেন।
অনেক পূর্বে আশঙ্কা করা হয়েছিল যে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বিগলিত হয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে উত্তর মেরুবরফমুক্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু উত্তর মেরুতে যেভাবে বরফ গলতে শুরু করেছে তাতে বিজ্ঞানীরা হতবাক। আগামী ২০ বছরের মধ্যে তাদের আশঙ্কা সত্যে পরিণত হবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আর্কটিক সাগরে বর্তমানে বরফের তেমন চিহ্ন নেই। তাই নৌকা নিয়ে সোজা মেরুর বুকে পাড়ি দেয়া যায়। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের এমন মারাত্মক উদাহরণ যে ২০১৮-২০১৯ সালে প্রত্যক্ষ করা যাবে, তা বিশ্বের কোনো বিজ্ঞানীর কল্পনাতেও ছিল না। মেরুবিশেষজ্ঞ, গবেষক, বিজ্ঞানীরা এখন থেকে বলে দিচ্ছেন, অচিরেই বরফহীন উত্তরমেরু অবলোকিত হবার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশের অধিক।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মেরুপ্রদেশের বরফ বিগলনের মারাত্মক প্রভাব পড়বে বিশ্বের পরিবেশের উপর। তারা বলছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যত বরফ গলে যাবে, বরফ চাদরবিহীন উন্মুক্ত সমুদ্র তত বেশি তাপ শোষণ করবে এবং পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকবে স্থানীয় তাপমাত্রা যা বরফ গলনের হারকে দ্রুততর করবে।
আর্কটিক অঞ্চলে বরফের নিচে প্রচুর পরিমাণে কার্বন মজুত রয়েছে। ওই অঞ্চলের বরফস্তর যত বিগলিত হবে তত সে কার্বন বায়ুমণ্ডলে অন্তর্ভুক্ত হবার আশঙ্কা রয়েছে, যা গ্রিন হাউজ এফেক্টকে আরো ভয়াবহ করে তুলবে। অনুমান করা হচ্ছে, আর্কটিক অঞ্চলে বরফাচ্ছাদিত যে কার্বন রয়েছে তার পরিমাণ আমাদের বায়ুমণ্ডলের মোট কার্বনের প্রায় এক ষষ্ঠমাংশ।
বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা যে হারে বেড়ে চলেছে তার ফলে এ শতাব্দীর মাঝামাঝি বা তার পূর্বে তাপমাত্রা ১.৫ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমতাবস্থয় সমুদ্র, এন্টার্কটিকা, গ্রীনল্যান্ড তথা হিমবাহের বরফাচ্ছাদন গলে সমুদ্রের পানিপৃষ্ঠের উচ্চতা ০.৫ থেকে ২.৫ মিটার অবধি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমন ঘটনা সন্দেহাতীতভাবে এক অবর্ণনীয় সুদূরপ্রসারী বিপর্যয় বয়ে আনবে। উপকূলীয় অঞ্চল ও অনেক দ্বীপমালাকে সমুদ্র গ্রাস করে ফেলবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দ্বীপের বৃহদাংশ পানিহীন হয়ে গেছে। উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহে সাধারণত জনঘনত্ব বেশি। নগরায়ন-শিল্পায়নের ব্যাপ্তি সেখানে অধিক। এমতাবস্থায় বিপর্যয়ের ভয়াবহতা যে অকল্পনীয় হবে তা মোটেই কল্পনার বিষয় নয়। এর ফলে ভূভাগের অন্য সব অঞ্চলে মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পাবে বেকারত্ব, দারিদ্র, জাতিদাঙ্গাসহ নানা সমস্যা।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, উষ্ণায়নের ফলে হিমালয় পর্বত মালার হিমবাহ ও বরফ দ্রবীভূত হয়ে যাবে এবং গলিত বরফধারা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি করবে। ফলস্বরূপ উপকূলবর্তী নগর-বন্দর-গ্রামসহ বিস্তীর্ণ জনপদের বিলয় ঘটবে। সমুদ্র প্রসারিত হবে এবং স্থলাঞ্চলের ক্রম সংকোচন ঘটবে। আক্রান্ত অঞ্চল থেকে আমাদের দেশের অন্যান্য অঞ্চলে প্রব্রজনকারী মানুষের স্রোত বইতে শুরু করবে। এমন পরিস্থিতি যে এক মারাত্মক মানবিক সঙ্কটের সৃষ্টি করবে, তা নিশ্চিত। অনেক পূর্বে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে যে এ শতকের মাঝামাঝি সময়ে হয়তো বাংলাদেশের ২০-২৫ শতাংশ ভূভাগ সমুদ্র গ্রাস করে ফেলবে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশের ২০ শতাংশ জমি হাতছাড়া হবার পরিণাম যে কত মারাত্মক ও বহুমুখী হবে তার ধারণা করা কঠিন। দেশটিতে বেকারত্ব ও খাদ্যসঙ্কট চরম আকার ধারণ করবে। দেখা দিবে দুর্ভিক্ষ, বাড়বে সামাজিক অস্থিরতা।
উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশের উপর যে প্রতিকূল প্রভাব দৃশ্যমান, তাতে শুধু পরিবেশবিদরাই উদ্বিগ্ন নন- সমানভাবে উদ্বিগ্ন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হেতু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে ভয়াবহ সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে, এমন আশঙ্কা প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভুত মারাত্মক সঙ্কট সমাধানে এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ গৃহীত ও অনুসৃত না হলে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বযুদ্ধ চলতে পারে বছরের পর বছর ধরে- এরূপ সতর্কবাণী ব্রিটেনের বিখ্যাত প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ‘দ্য রয়েল ইউনাইটেড’-এর। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, পৃথিবীর জলবায়ুর এ পরিবর্তন বিভিন্ন মহাশক্তি বা জোটের মধ্যে লড়াই বাঁধিয়ে দিতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং তার ফলে তলিয়ে যাওয়া ভূভাগের আক্রান্ত মানুষের যথেচ্ছ প্রব্রজন-সমস্যা বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষভাব সৃষ্টি করে রাজনৈতিক অস্থিরতার বাতাবরণ তৈরি করতে পারে। ইতিমধ্যে পরিবেশ নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী অনেক দেশকে একে অন্যের উপর দায়ভার চাপানো তথা পারস্পরিক দোষারোপের তিক্ত বিতর্কে লিপ্ত হতে দেখা গেছে। আমেরিকাসহ শিল্পোন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশেষভাবে চীন, ভারত ও বাংলাদেশের মতো জনবহুল উন্নয়নশীল দেশকে অধিক দায়ী বলে প্রচার চালিয়ে আসছে। এ ধরনের অবস্থা বিভিন্ন দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক তিক্ততার পরিমণ্ডল তৈরি করে ভবিষ্যৎ যুদ্ধের আশঙ্কা তীব্রতর করে তুলতে পারে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে যে সত্যটি প্রতিভাত হয় তা হলো উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে নিছক এক পরিবেশ সমস্যা নয়, তা আমাদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রতিরক্ষা, জনস্বাস্থ্য আদি যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার (১ম) স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত।