বৈধ-অবৈধ বাছবিচার না করা, ন্যায়-অন্যায় তোয়াক্কা না করা- সেই জুব্বা-দাড়িওয়ালার চাইতে সৎ প্রশাসক, নীতিবান শ্রমিক, আদর্শ শিক্ষক উত্তম। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত অসৎ ব্যক্তির চাইতে, ওয়াজ-নসিহত করা একজন বেআমলের থেকে কিংবা নকল করে পাস করা একজন পণ্ডিতের চেয়ে নীতিবান মুচি কোটি গুণ ভালো। যে ওয়াদা পালন করে না, আমানত রক্ষা করে না এবং সত্য কথা বলে না তার চেয়েও ঈমানদার পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মর্যাদা বেশি। একজন প্রশাসক যদি সৎ হয়, একজন পুলিশ যদি ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলে তবে সে প্রচলিত পীরদের থেকেও বেশি মর্যাদাবান। একজন ব্যবসায়ী যদি সৎভাবে ব্যবসা করেন তবে তার হাশর নবী-রাসুলের সাথে। সৎ-অসৎ মাপার জন্য সুযোগের মধ্যে থাকা আবশ্যক। যার অসৎ হওয়ার সুযোগ নাই তার সততা এবং যে ক্ষমতার কোলে থাকে, কোটি কোটি টাকা নাকের ডগায় ঘোরাঘুরি করে- তার সততার ওজন সমান সমান নয়! যে ইচ্ছা হলেই কোটি টাকা লোপাট করে দিতে পারে, অনায়াসে কারো অধিকার হরণ করতে পারে কিংবা কাউকে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করতে পারে- ক্ষমতা থাকার পরেও এসব যারা না করে তারাই শ্রেষ্ঠ মানুষ। প্রবৃত্তিকে দমন করে, লোভকে নিয়ন্ত্রণ করে যারা বিবেকের মাপকাঠিতে পরিচালিত হয় তাদের দেখে সমাজের মানুষদের ঈর্ষা হওয়া উচিত। তাদের সহজ-সরল জীবন থেকে অন্যদের শেখা উচিত। আদর্শের দ্বারা পরিচালিত মানুষদের অনুসরণে প্রতিযোগিতা তৈরি হওয়া আবশ্যক। কেননা এই মানুষগুলে দুনিয়াতে যেভাবে সম্মানিত-প্রশংসিত হয়, আখেরাতে তার অধিক পুরস্কৃত হবে।
শত-সহস্র শাসকের মধ্যে সেই শাসকের নাম শুনলে মাথা নত হয় যে নীতির নিয়মের রাজ্য-প্রজা শাসন করেছে। সেই আমলা, সেই কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা সেই রাজনীতির স্মরণে সম্মান বিগলিত হয় যারা নিয়মের বাইরে কাউকে অবৈধ সুবিধা দেননি, নিজেও বাড়তি সুবিধা নেননি এবং কাউকে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেনি। অনেক মানুষের অধিকার-নিরাপত্তার জিম্মাদার মানুষটি যদি নীতিবান হয় তবে তাঁর গন্ডিতে বেহেশতি শান্তির পরশ লাগে। নারী-শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে। সেই সাম্রাজ্যে শুধু মানুষ নয় বরং পশু-পাখিও নিরাপদ বোধ করে। যিনি জ্ঞানত কোনো মানুষের ক্ষতি করেন না, কাউকে ঠকান না এবং দায়িত্বে অবহেলা করেন না তিনি জীবিত ওলি। সৎ শাসক, নীতিবান আমলা, আদর্শ শিক্ষক আল্লাহর বন্ধু। পৃথিবীর সব মানুষের ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা ঘোষণা করা হয়েছে। একজীবনে সৎ থাকা বড্ড জরুরি। অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ ভোগ বাড়াতে পারে কিন্তু সুখ বাড়াতে পারে না। যে ক্ষমতা পেয়ে তা অপব্যবহার করে তার জীবদ্দশাতেই সেটার খেসারত এবং ক্ষতিপূরণ চুকাতে হয়। যে যেখানে দায়িত্বশীল, যে যা পালনে দক্ষ কিংবা যাকে যেখানে মনোনীত করা হয়েছে সে যদি তা সততার সাথে পালন না করে তবে তাকে প্রত্যেক কর্মের জন্য কৈফিয়ত দিতে হবে। মানুষে কথা, কাজ কিংবা দায়িত্ব তার কাছে আমানত। সে যদি আমানত সঠিকভাবে আদায় করে তবে সম্মানিত হবে এবং যদি খেয়ানত করে তবে শাস্তি ভোগ করতে হবে। দুনিয়াতে অসম্মান অর্জিত হলে তারচেয়ে বড় শাস্তি আর হয় না। শাস্তি শুধু জেল-জরিমানা নয় বরং সন্তানের বিপথে যাওয়া, স্বামী-স্ত্রী অবাধ্য হওয়া- এর চেয়ে নিকৃষ্ট দণ্ড আর কিছুই হয় না।
অন্যায় লালনকারীর মানসিক শান্তি নষ্ট হয়ে যায়। যারা বৈধ আয়ের সাথে সুদণ্ডঘুষ মিশ্রিত করে, যারা কারো বৈধ অধিকার হরণ করে মানুষের চোখের জলের কারণ হয়, যারা দুর্বলদের ওপর অত্যাচার করে এবং সবলদের অন্যায় মেনে লয় কিংবা যিনি দায়িত্বশীল হয়েও কাউকে সেবা প্রদান থেকে বঞ্চিত করে অভিশাপ টেনে নেন- তাদের কর্মকাণ্ড বিচারহীন যাবে না। যে কাজের জন্য রব আদেশ করেছেন, যে কাজের জন্য রাষ্ট্র বেতন দিয়েছে এবং যে দায়িত্ব পালনের জন্য কাউকে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে দক্ষ করা হয়েছে সে যদি সেই কাজে ফাঁকি দেয় তবে তাদের জন্য দুনিয়ার জিল্লাতির চেয়ে আখেরাতের পাকড়াও কঠিন হবে। অন্যায়ভাবে অর্জিত বিপুল অর্থকড়ির পাই পাই হিসাব দিতে হবে। কাজেই সৎভাবে একবেলা আহার করে বেঁচে থাকাও অনেক বেশি সম্মানের; ঝুঁকিমুক্ত তো বটেই। সত্য জানার পারে তা লুকানোও পাপ।
পারিপার্শ্বিক চাকচিক্য, কারো সম্পদ দেখে মোহাসক্ত হওয়ার বোধ পোক্তভাবে ধারণ করতে হবে। কেউ দুনিয়াতে এমনি এমনি আসে নাই, কোটি কোটি মানুষের মধ্য থেকে বাছাই করে তাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিশেষ দায়িত্ব এমনি এমনি দেয়া হয়নি। কাজেই কেউ যদি ক্ষমতা পেয়ে, সুযোগ পেয়ে ন্যায়দণ্ড উপেক্ষা করে অন্যায় করে তবে সাধারণ মানুষের চেয়ে দায়িত্বশীলের শাস্তি বেশি হবে।
কেউ দুর্নীতি করলে মানুষ তাকে ঘৃণা করে, সন্তান বিপথগামী হয়, ক্ষমতা ফুরাতেই দুর্দিন চেপে ধরে কিংবা মানসিক অশান্তিতে নির্ঘুম কাটে- এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে? বিবেকহীন অন্যায়কারীদের জন্য, অসৎ শাসকদের জন্য এবং নীতিভ্রম আমলা-পুলিশের জন্য চূড়ান্ত পরিণতি জাহান্নামের লেলিহান অগ্নিশিখা। রিকশাওয়ালা-মজুরের অসততায় কেবল যাত্রী-মালিকের ক্ষতি হয় কিন্তু রাজন্যবর্গের নীতি ভ্রষ্টতার খেসারত পুরো জাতিকে ভোগ করতে হয়। কাজেই যিনি যত বড় দায়িত্বশীল তার সাবধানতা তত উচ্চ পর্যায়ের হওয়া দরকার।