ব্রিকস কি বৈশ্বিক সংখ্যাগরিষ্ঠের জোট হতে পারবে
এ কে এম আতিকুর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব
প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
গত ২২ থেকে ২৪ অক্টোবর রাশিয়ার কাজান শহরে অনুষ্ঠিত হলো ব্রিকসের ১৬তম শীর্ষ সম্মেলন। ৩৬টি দেশের অংশগ্রহণে এই সম্মেলনে নেতৃত্ব দিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ এল-সিসি এবং ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবিই আহমেদ অংশ নিলেও ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা অসুস্থতার কারণে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈঠকে যোগ দেন। এ ছাড়া সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন তুরস্ক, ভিয়েতনাম, আজারবাইজান, আরমেনিয়া, বেলারুশ, বলিভিয়া, কঙ্গো, লাওস, ফিলিস্তিন, উজবেকিস্তান, ভেনিজুয়েলাসহ প্রায় ২০টি দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানরা। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও সম্মেলনে অংশ নেন। গত বছর জোহানেসবার্গ ব্রিকস সম্মেলনে বাংলাদেশ অংশ নিলেও এবার অংশ নেয়নি। এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্যবিষয় (থিম) ছিল ‘বৈশ্বিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য বহুপক্ষীয়তাকে শক্তিশালী করা’।
আমরা জানি, ব্রিকস জোটটির মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বে শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং সহযোগিতার অগ্রগতি সাধন করা। বিদ্যমান বিশ্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বাস্তবতায় ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো এরই মধ্যে একটি বিকল্প বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা, একটি বহুমুখী বিশ্ব এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্য তাদের সমর্থন ঘোষণা করেছে। কাজান শীর্ষ সম্মেলনে ব্রিকস নেতারা বহুপক্ষীয়তার প্রচার, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং অন্যান্য বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেন। ক্রেমলিন থেকে এই সম্মেলনকে রাশিয়ার মাটিতে ইতিহাসের অন্যতম ‘বড়মাপের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক সম্মেলন’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মতো কাজান সম্মেলন চলাকালেও সাইডলাইনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই সব বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বিষয়াদি ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়েও নেতাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ওই সব আলোচনায় নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যা যেমন প্রাধান্য পেয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক সমস্যা, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিনে ইসরাইয়েলের নৃশংসতা বা লেবাননে ইসরায়েলের আগ্রাসন ইত্যাদিও আলোচনায় উঠে এসেছে।
দুই.
শীর্ষ সম্মেলন শুরু হওয়ার আগে গত ১৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ব্রিকস বিজনেস ফোরামের বৈঠকে প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেন, ‘১৯৯২ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতির ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল জি-৭-এর দখলে, ব্রিকস রাষ্ট্রগুলোর দখলে ছিল মাত্র ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। কিন্তু এখন? ২০২৩ সালে আমাদের জোটের (ব্রিকস) ভাগ এসে দাঁড়ায় ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশে, আর তাদের ২৯ দশমিক ৩।’ আগামী দিনে ব্রিকসের অংশ আরো বাড়বে বলেও পুতিন উল্লেখ করেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, তাদের জোট এবং জোটের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী দেশগুলো নিয়ে হয়তো অচিরেই তারা ‘একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা’ গড়ে তুলতে পারবেন। আর সে রকমটি হলে রাশিয়ার প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের আচরণ অনেকটাই অর্থহীন হয়ে পড়বে। তবে এ কারণে জোটের অনেক সদস্যের, বিশেষ করে ছোট দেশগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের তেমন একটা পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।
তিন.
২৩ অক্টোবর তারিখে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন ২০২৪-এর ‘কাজান ঘোষণা’টি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ঘোষণায় ১৩৪টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। অনুচ্ছেদগুলোতে এমন কোনো বিষয় নেই, হোক সে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত, যা উঠে আসেনি। একটি ব্রিকস কি বৈশ্বিক সংখ্যাগরিষ্ঠের জোট হতে পারবে ন্যায়সঙ্গত এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার জন্য বহুমুখীকরণকে জোরদার করার ক্ষেত্রে যেমন জাতিসংঘের, বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের, সংস্কারের বিষয়সহ তার অন্য অঙ্গসংগঠনগুলো, যেমন- আইএমএফ, ডব্লিউটিও ইত্যাদির কার্যক্রম নিয়ে কথা হয়েছে; তেমনি জলবায়ু পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ছাড়াও বিশ্ব অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ওপর অবৈধ নিষেধাজ্ঞাসহ বেআইনি একতরফা জবরদস্তিমূলক পদক্ষেপের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থাকে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়সঙ্গত করার জন্য বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শাসনসহ আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বর্তমান আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার সংস্কারের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। ঘোষণায় বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ইউক্রেন প্রসঙ্গে সংলাপ ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিদ্যমান সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে পরিস্থিতির অবনতি এবং মানবিক সংকট, বিশেষ করে গাজা উপত্যকায় ও পশ্চিম তীরে সহিংসতার আশঙ্কাজনক বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ এবং নিন্দা জানানো হয়। আরো উল্লেখ করা হয় যে ইসরায়েলি সামরিক আক্রমণের ফলে অসংখ্য বেসামরিক মানুষ নিহত ও আহত হচ্ছে, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ঘটছে এবং বেসামরিক অবকাঠামোকে ব্যাপকভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে। এ ছাড়া দক্ষিণ লেবাননের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে নিন্দা জানানোসহ অবিলম্বে সামরিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়। সন্ত্রাস, অর্থপাচার, মাদকপাচার, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয় নিয়েও গুরুত্বসহকারে আলোচনা হয় এবং এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণে সবার সহযোগিতা কামনা করা হয়।
ঘোষণায় ব্রিকস গ্রেইন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে একটি শস্য (পণ্য) ট্রেডিং প্ল্যাটফরম প্রতিষ্ঠা করা এবং পরবর্তীকালে এটিকে অন্যান্য কৃষি খাতে সম্প্রসারণ করা, ব্রিকস ক্রস-বর্ডার পেমেন্ট সিস্টেম এবং আর্থিক লেনদেনে স্থানীয় মুদ্রার ব্যবহারকে স্বাগত জানানো হয়। নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কর্মকাণ্ডের উন্নয়ন ও পরিধি বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, যোগাযোগব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও গবেষণা, প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, যুব উন্নয়ন, নারীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভূমিকার উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়কেও কাজান ঘোষণায় অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
চার.
গত বছর জোহানেসবার্গ শীর্ষ সম্মেলনে পাঁচটি দেশকে (মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত) সদস্য করার সিদ্ধান্ত হলেও এবার কোনো দেশকেই সদস্য করা হয়নি। তবে ১৩টি দেশ; যথা- আলজেরিয়া, বেলারুশ, বলিভিয়া, কিউবা, ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্থান, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, উগান্ডা, উজবেকিস্তান ও ভিয়েতনামকে এই জোটের ‘অংশীদার রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। ব্রিকসের নীতি ও প্রণীত নিয়মাবলি অনুসরণে এসব দেশকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর হয়তো এ বছরের মধ্যে অথবা আগামী বছরের শীর্ষ সম্মেলনে যেসব দেশকে সদস্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে তার ঘোষণা আসবে। বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। হয়তো বা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে তেমন কোনো প্রচেষ্টা চালানো হয়নি।
পাঁচ.
পুতিন যেমনটি বলেছেন, মস্কো শান্তি উদ্যোগ বিবেচনা করার জন্য উন্মুক্ত এবং ব্রিকস নেতাদের মধ্যস্থতার প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। এ ক্ষেত্রে ভারত হয়তো মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসতে পারে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জাতিসংঘের সনদ, আন্তর্জাতিক আইন এবং সাধারণ পরিষদের রেজল্যুশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ইউক্রেনে ‘একটি ন্যায্য শান্তির’ আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি গাজা, লেবানন ও সুদানে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধেরও আহ্বান জানান। শীর্ষ সম্মেলনে অন্যান্য বিশ্বনেতাও লেবানন ও গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, ‘আমাদের গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ অব্যাহত রাখতে হবে, দুই-রাষ্ট্র সমাধান পুনরায় চালু করতে হবে এবং লেবাননে যুদ্ধের বিস্তার বন্ধ করতে হবে।
ফিলিস্তিন ও লেবাননে আর কোনো দুর্ভোগ ও ধ্বংস হওয়া উচিত নয়।’ প্রেসিডেন্ট শি আশা প্রকাশ করেন, ব্রিকস দেশগুলো ‘শান্তির জন্য স্থিতিশীল শক্তি’ হতে পারে। আমরাও একই ধ্বনি উচ্চারণ করে অবশ্যই ওই সব সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য শান্তিপূর্ণ সমাধান আশা করি।
ব্রিকসের নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্বকে কোন দিকে নিয়ে যায়, তা দেখার জন্য আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুতিন যেমন বলেছিলেন, ‘একটি বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। এটি একটি গতিশীল এবং অপরিবর্তনীয় প্রক্রিয়া।’ সেই প্রক্রিয়া বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থাকে, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করে কতটুকু এগিয়ে যেতে পারে, তা নির্ভর করবে ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা ও বিশ্বাস, আন্তরিকতা, অঙ্গীকার এবং কর্মপরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়নের ওপর। সর্বোপরি ব্রিকসকে একটি বৈশ্বিক সংখ্যাগরিষ্ঠের জোটে পরিণত করতে হবে। তবে পশ্চিমা প্রভাববলয় থেকে মুক্ত হতে ব্রিকসকে অবশ্যই কিছুটা সময় দিতেই হবে।