বাংলাদেশের বর্তমানে সবচেয়ে মূল্যবান পেশা দুর্নীতি, চুরি। আমলা, প্রশাসক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীর দুর্নীতি, অনৈতিকতা, নির্লজ্জতা, দুর্নীতির মহাউৎসবে মগ্ন। সমাজে দারিদ্র্য ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি অসহায়ত্ব অনুভূতি অনুভব করছে। বাংলাদেশের সরকার, সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসন সমাজের অন্যদের এবং সমাজে দারিদ্র্য ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে দুর্নীতির সম্মুখীন হওয়া থেকে রক্ষা করে না। সরকারি খাত দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতি হলো সকল প্রকার অনিয়মিত, অনৈতিক এবং বেআইনি লেনদেন। রাষ্ট্র বা সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিদের দুর্নীতি সীমাহীন। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ক্ষমতাশালী শীর্ষ কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে, কেবল মধ্যম ও নিম্নসারির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের ৮৩টি দলিলের সম্পত্তি ও ৩৩টি ব্যাংক হিসাব, পরিবারের সদস্যদের নামের ১১৯টি জমির দলিল, ২৩টি কোম্পানির শেয়ার ও গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেন আদালত। বেনজীর আহমেদ সপরিবার দেশ ছাড়েন। প্রাক্তন স্বৈরাচারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ব্রিটেনে ‘হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের’ সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।
যুক্তরাজ্যে ১৫ কোটি পাউন্ড মূল্যের ২৮০টি সম্পত্তি সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানধীন প্রতিষ্ঠানের নামে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড সম্পদ আছে তার, যা দেশের বৈদেশিক রিজার্ভের এক শতাংশের সমতুল্য। আর বাকিদের কথা নাইবা বললাম। বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কথা জানিয়ে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। আজিজ আহমেদ সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় বা থাকার পর তার আয়ের উৎসবহির্ভূত পন্থায় যে সমস্ত সম্পত্তি তৈরি করেছেন, সে সমস্ত সম্পত্তির ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে, সত্যতা যাচাই করা হচ্ছে। পলাতক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিকের মালয়েশিয়ার ব্যাংকের মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (আরএনপিপি) থেকে ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা) লোপাটের অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। রিমান্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।
তিনি বলেন, ‘নতুন নতুন প্রকল্প বের করার তাগাদা দিতেন শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যরা। নতুন প্রকল্প মানেই বড় অঙ্কের কমিশন। এর সবকিছুই জানতেন শেখ হাসিনা। তবে তিনি কখনো তাতে না করেননি।’ সালমান এফ রহমান জানিয়েছেন, ‘এস আলমের মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হওয়া দেড় লাখ কোটি টাকার অর্ধেকই শেখ রেহানা এবং সজীব ওয়াজেদ জয়কে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এসব অনিয়ম হয়। তবে এসব বিষয়ে কেউ কথা বলার সাহস পাননি। কেবল অর্থ পাচার নয়, দেশের ইস্টার্ন রিফাইনারি, চিনিকল হাতিয়ে নিলেও এস আলমের বিষয়ে সবাই নীরব ছিলেন।’ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি হয়েছে। এবার বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১০তম, যা গতবার ছিল ১২তম। গত এক যুগের মধ্যে বাংলাদেশে দুর্নীতি এবার সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত। দুর্নীতি করে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি হরিলুট হয়েছে। বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবনযাত্রার প্রায় সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতি এক মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই বর্তমানে ব্যাপকহারে দুর্নীতি চলছে। বর্তমানে বাংলাদেশের কোনো সরকারি দপ্তর বিভাগই দুর্নীতিমুক্ত নয়। ঘুষ বা উৎকোচ গ্রহণ, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, অপচয় ও চুরি ছাড়াও ক্ষমতার অপব্যবহার, কাজে ফাঁকি দেয়া, স্বজনপ্রীতি, সরকার সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে প্রশাসনে ব্যাপকহারে দুর্নীতি হয়ে থাকে। ব্যবসায়ী মহল কর্তৃক মজুদদারির মাধ্যমে দ্রব্যবাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মুনাফা আদায়, বিভিন্ন অজুহাতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা, চোরাকারবার, খাদ্যে ভেজাল দেয়া, নকল পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়, ওজনে কম দেয়া, সরকারি রেশনে কারচুপি করা, কর, শুল্ক, খাজনা ইত্যাদি ফাঁকি দেখাসহ এ ধরনের অর্থনৈতিক দুর্নীতি বর্তমানে বাংলাদেশকে গ্রাস করে ফেলছে।
পরীক্ষায় ব্যাপক নকল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, ক্লাসে ভালোভাবে না পড়িয়ে প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিং সেন্টারে পাঠদান, নিয়মিত ক্লাসে না আসা, দলীয় ভিত্তিতে অযোগ্য লোকদের বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়াসহ এ ধরনের অসংখ্য দুর্নীতির কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষার গুণগত মানের চরম অবনতি ঘটেছে। এ দেশে ধর্মকে কেন্দ্র করেও নানা রকমের দুর্নীতি চলছে। জনসাধারণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা স্বার্থসিদ্ধি, অর্থ উপার্জন বা কাজ ধর্মীয় দুর্নীতির পর্যায়ভুক্ত বিভিন্ন ধরনের ধর্মব্যবসা, রোগমুক্তি ও মনোবাসনা পূরণে ধর্মের দোহাই দিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের সাথে ধোঁকাবাজি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে কাজে লাগানোও ধর্মীয় দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে। বেসরকারি খাতেও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে।
শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ার নামে সরকারি সুবিধা ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে সে টাকা বিলাস-বাসন বা অন্য কাজে ব্যবহার এবং বিদেশি ব্যাংকে জমা করা, ব্যাংক ঋণ ইচ্ছাকৃতভাবে পরিশোধ না কর, কর ও শুল্ক ফাঁকি দেয়া শেয়ার মার্কেট কেলেংকারি ইত্যাদি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ঋণখেলাফি বর্তমানে বাংলাদেশে রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতায় থাকাকালীন এবং ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জেনারেল এরশাদের দুর্নীতি নিয়ে নানা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। ১৯৮৬ সালে ব্রিটেনের দ্য অবজারভার পত্রিকা এরশাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। মরিয়ম মমতাজ নামে এক নারী নিজেকে এরশাদের দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করে দ্য অবজারভার পত্রিকাকে বলেন, জেনারেল এরশাদ আমেরিকা এবং সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় এসোসিয়েটেড প্রেস এবং ওয়াশিংটন পোস্টসহ নানা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এরশাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের শিরোনাম হয়েছিল। ক্ষমতাচ্যুত হবার পর দুর্নীতির মামলায় কারাগারেও থাকতে হয়েছে তাকে। বিবিসি’র প্রতিবেদন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত চার দলীয় জোট সরকারের আমলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তার দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদের ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতায় এলেও, দুর্নীতি সরকারের নীতি হয়ে দাঁড়ায়। ‘হাওয়া ভবন’কে রাষ্ট্রক্ষমতার প্যারালাল কেন্দ্রে পরিণত করা হয় এবং এটি হয় দেশের সমুদয় দুর্নীতির কেন্দ্র। বিএনপি-জামাত জোটের মন্ত্রী, সাংসদ, নেতাকর্মী এবং দলীয় প্রশাসনের অকল্পনীয় দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, লুটপাট, চাঁদাবাজি প্রভৃতির ফলে টিআইবি পরপর পাঁচবার বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে।
সর্বক্ষেত্রে সরকারের দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার ফলে উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়ে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট হয়ে ওঠে অসহনীয়। একমাত্র বিদ্যুৎ খাতেই ২০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট ও অপব্যয় হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের কারণে শিল্প ও কৃষি উৎপাদনে সৃষ্টি হয় চরম সংকট। বিদ্যুতের দাবি জানাতে গেলে কানসাটে ২০ জন কৃষককে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্যার ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক আয়করমুক্ত সুবিধা ফিরে পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত আয়করমুক্ত সুবিধা দিয়ে গত বৃহস্পতিবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, প্রতিবছর গ্রামীণ ব্যাংককে শুধু আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কর অব্যাহতি সুবিধা পেয়ে আসছিল।
গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৮৩ বাতিল করে সরকার যখন ২০১৩ সালে আইন করে, তখনও বহাল রাখা হয় এ সুবিধা। কিন্তু ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সুবিধাটি হঠাৎ বন্ধ করে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, নামে ব্যাংক হলেও গ্রামীণ ব্যাংক বাস্তবে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমও পরিচালনা করে। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) থেকে নিবন্ধন নেয়া সব ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানই আয়করমুক্ত। বিশেষ আইনে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংককে এমআরএ থেকে নিবন্ধন নেওয়ার দরকার নেই। তবে সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য এমআরএর প্রতিষ্ঠানগুলোর মতোই। ফলে আয়কর অব্যাহতি পাওয়াটা গ্রামীণ ব্যাংকের ন্যায্য, যা আগে ছিলও। প্রথম আলোর প্রতিবেদন।
আবার দেশবাসীকে অনলাইনে আয়কর দিতে আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা স্যার ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জনগণের দেয়া করই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি উল্লেখ স্যার ড. ইউনূস বলেন, ‘সরকারের কাছে করের টাকা জমা দিতে পোহাতে হয় নানা ঝামেলা। এখন থেকে ব্যাংকে লাইন দিয়ে আয়কর জমা দেয়া বা আয়কর অফিসে গিয়ে রিটার্ন জমা দেয়ার ঝামেলা করতে হবে না। আপনি ঘরে বসেই আয়কর জমা দিয়ে রিটার্ন দাখিল করবেন, এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে গতকাল পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় তিনি এ কথা বলেন। অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার ক্ষেত্রে পরস্পরকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনার আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবকে শিখিয়ে দিন কীভাবে ঘরে বসে অনলাইনে ই-রিটার্ন ও আয়কর জমা দিতে হয়। আমি তরুণ-তরুণীদের এ ব্যাপারে করদাতাদের সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করছি। ভবিষ্যৎ উদ্যোক্তা হওয়ার প্রস্তুতি এখান থেকেই শুরু হতে পারে।’ ধীরে ধীরে অনলাইনে সব কর আহরণের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন সরকারপ্রধান।