বাংলাদেশের অর্থনীতির সিংহভাগ আবর্তিত হয় ব্যাংক খাত নিয়ে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সমৃদ্ধি ও দুর্বলতা অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। অর্থ মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাই ব্যাংক খাতের গতি প্রকৃতি জীবন ও জীবিকাকে প্রভাবিত করে। বিগত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার ব্যাংক খাতের যে ভয়াবহ ক্ষতি করে গেছে তা দেশের ব্যবসায়ী ও আমানতকারীসহ কারও বুঝতে বাকি নেই। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ব্রিটিশ প্রভাবশালী গণমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা তার শাসনামলে ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ সরিয়েছেন।
তিনি আরো জানান, এর মধ্যে এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম) ও তার সহযোগীরাই নিয়েছেন অন্তত ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলার। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দফতরের (ডিজিএফআই) সাবেক কিছু কর্মকর্তা শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক দখল করতে সহায়তা করেছেন। তিনি জানান, এসব ব্যাংক দখল করে আনুমানিক ২ লাখ কোটি টাকা (১ হাজার ৬৭০ কোটি ডলার) বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। এভাবে ব্যাংক ও আর্থিক খাত ভয়াবহ খাদের কিনারায় পতিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বিরাট শূন্যতা দেখা দিয়েছে। বেড়ে যায় খেলাপি ঋণ। ক্যান্সার হিসেবে পরিচিত খেলাপি ঋণ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের উৎপাদনমুখী সব শিল্প খাতে। ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকের বেশিই তথা ৫৪.৩২ শতাংশ রয়েছে পোশাক, টেক্সটাইল, চামড়া, জাহাজ নির্মাণসহ উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন-২০২৩ পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭২২ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮.৯৪ শতাংশ। প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৫৬ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে ৭২ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ৫৪.৩২ শতাংশ। আর ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে উৎপাদনমুখী শিল্প খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬০ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, খেলাপি ঋণ প্রথমবারের মতো ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৪ সালের জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। শুধু তাই নয়, গত ১৬ বছরের মধ্যে বিতরণ করা ঋণ ও খেলাপি ঋণের সর্বোচ্চ অনুপাত এটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এতদিন যা স্বার্থান্বেষী মহলগুলোর কারসাজিতে চাপা পড়েছিল। আর একটি বিষয় হলো পুনঃতফসিল যা খেলাপি ঋণ হিসেবে রিপোর্ট হয় না অথচ ব্যাংক বিনিয়োগের এটি ভয়াবহ ক্যান্সার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে জানা যায়, দেশের শিল্প উদ্যোক্তারা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন। ২০২৩ সালের শেষে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ স্থিতির ২৬ দশমিক ৪ শতাংশই ছিল শিল্প খাতের।
দ্বিতীয় স্থানে ছিল বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাত। এ খাতের উদ্যোক্তারা ২০ দশমিক ৯ শতাংশ ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন। এছাড়া পুনঃতফসিলকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৩ শতাংশ চলতি মূলধন (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল), ব্যবসায়িক (ট্রেডিং) ১১ শতাংশ, আমদানি ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, ৬ দশমিক ৫ শতাংশ নির্মাণ, ৫ দশমিক ২ শতাংশ কৃষি খাতে এবং ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অন্যান্য খাতে। ব্যাংকগুলো ২০২৩ সালে ৯১ হাজার ২২১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। এছাড়া ২০২৩ সালের শেষে ব্যাংক খাতের মোট পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। পুনঃতফসিল করা ঋণের সঙ্গে খেলাপি ও অবলোপন করা ঋণ যোগ করলে মন্দ ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫ লাখ কোটি টাকারও বেশি। এর সঙ্গে অনেক ব্যাংকের পরিচালকদের নেয়া ঋণ বিবেচনায় নিলে প্রকৃত পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
বিগত সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। ফলে শিল্প উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। আবার দাম বাড়ানোর পরও চাহিদামতো সরবরাহ মেলেনি। উদ্যোক্তারা বলছেন, এর ফলে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ পড়ে ব্যবসায়ীদের ওপর। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিলেও অনেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় শতভাগ উৎপাদন না হলেও জ্বালানি ও জনবলের ব্যয় ঠিকই মেটাতে হয়েছে। আর দিন শেষে তা মালিকের মূলধন থেকেই যাচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের সে সক্ষমতাও কম। এ অবস্থায় তারা খেলাপি হচ্ছেন।
সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষ পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলেছে। পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি আয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এছাড়া নির্মাণ শিল্প ও কৃষি উৎপাদন খাতসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি অনেক শিল্প রয়েছে, যেগুলো শিল্প খাতের কাঠামোকে ধারণ করে। দুর্ভাগ্য হলো এসব খাতে ও খেলাপি ঋণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে তৈরি পোশাক, চামড়া, নির্মাণ ও বাণিজ্যিক খাতে। যদিও সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণের হারে শীর্ষে আছে চামড়াশিল্প। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে জাহাজ নির্মাণ ও তৈরি পোশাক খাত। এসব খাতে খেলাপির হার প্রায় ১৪ থেকে ২১ শতাংশ পর্যন্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন-২০২৩ পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির বিষয়টি হঠাৎ করে সৃষ্ট কোনো সমস্যা নয়। বরং দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা সমস্যারই ধারাবাহিকতা। কারণ কয়েক বছর ধরে প্রতি প্রান্তিকেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। অথচ এ সময় ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠনসহ সব ধরনের সুবিধার দরজা উন্মুক্ত করা হয়েছে। কোনো সুবিধাই খেলাপি ঋণ কমাতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন থেকে খাতভিত্তিক ঋণ বিতরণ এবং এর বিপরীতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার জানা যায়।
এতে দেখা যায়, উৎপাদনশীল শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ হয়েছে তৈরি পোশাক খাতে। ২০২৩ এর শেষে এ খাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৬৩ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ২২ হাজার ৭০২ কোটি টাকা বা ১৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এক বছর আগেও এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ১২ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক বছরে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালে এ খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল আরো বেশি, প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।