প্রাথমিক পর্যায়ে উপনিবেশবাদ ছিল সম্প্রসারণবাদের একটি বিবর্তনীয় রূপ। আসলে এখন পর্যন্ত বিশ্বসভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যুগে যুগে অন্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য, অন্যের সম্পদ ভোগ করার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে নানাভাবে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। একের পর এক সাম্রাজ্য স্থাপন করা হয়েছে, উপনিবেশ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গ্রিক বীর আলেকজান্ডার দিগি¦জয়ী শাসক ছিলেন, আবার ব্রিটিশ উপনিবেশে নাকি কখনো সূর্য অস্ত যেত না। এই পৃথিবীর মাত্র চারটি দেশ ছিল যারা সম্পূর্ণভাবে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার অভিশাপ থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছিল। ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টদশ, ঊনবিংশ কিংবা বিংশ শতাব্দীতে না জাতিসংঘের তথ্য মতে এখনো, এই একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীতে সতেরটি উপনিবেশ রয়েছে এবং এসব অঞ্চলে প্রায় দুই মিলিয়ন জনগোষ্ঠী সরাসরি ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্যে বসবাস করে। আর উপনিবেশ স্থাপনকারী এই দেশগুলো হচ্ছে নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের শুরুর সময় প্রায় সাতশ পঞ্চাশ মিলিয়ন জনগোষ্ঠী ঔপনিবেশিক শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল যা পৃথিবীতে মোট জনগোষ্ঠীর তিন ভাগের একভাগ। আর এই ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে নানাভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নেটিভ জনগোষ্ঠীর সম্পদ লুণ্ঠন করা হয়েছে, নতুন নতুন অনৈতিক ও অমানবিক ব্যবসা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেমনটা হয়েছিল দাস ব্যবসার ব্যবস্থার মাধ্যমে। সাম্প্রতিক সময়ে আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ভারত থেকে দুইশো বছরে প্রায় পঁয়তাল্লিশ ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদ নিয়ে গেছে। ঔপনিবেশিকতার সরাসরি কাঠামোর অবলোপন হলেও ঔপনিবেশিক প্রভাব বলয় সৃষ্টির ধারণা থেকে এই পৃথিবী এখনো মুক্ত হতে পারেনি। রেনেসাঁসের ফলে ইউরোপে যে আধুনিকতার জন্ম হয় তা একসময় সাম্রাজ্যবাদকে ইন্ধন যোগায় এবং পরে উপনিবেশ বিস্তারে মূল্যবান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাম্রাজ্যবাদে শক্তিশালী কেন্দ্র দূরবর্তী কোনো অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব অনুশীলন করে। অপরদিকে উপনিবেশবাদ বলতে বোঝায়, imposition of political control through conquest and territorial expansion over people and places located at a distance from the metropolitan power.
ব্লান্ট উপনিবেশবাদে তিনটি পর্যায়কে চিহ্নিত করেছেন। প্রথম পর্যায় শুরু হয় ষোল শতকে। এসময় ইউরোপীয় শক্তিগুলো বিভিন্ন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে তীব্র আর্থিক সংকটের সম্মুখিন হয়। এ সংকট নিরসনের জন্য প্রয়োজন ছিল প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণ ও রৌপ্য যা পাওয়া গিয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকায়। ফলে স্পেনিয় ও পর্তুগিজরা দলে দলে গিয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় স্থাপনা তৈরি করে যা ক্রমে উপনিবেশে রূপ নেয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে আফ্রিকা থেকে প্রচুর দাস ধরে নিয়ে যাওয়া হয় উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায়, উপনিবেশের অধীনে অমানবিক পরিশ্রমের কাজগুলো সম্পাদন করার জন্য। এসময় বিভিন্ন উপনিবেশে উৎপন্ন কাঁচামাল ও দ্রব্য অন্যান্য উপনিবেশ ও ইউরোপে বিক্রয় করা হত। তৃতীয় পর্যায়ে, দ্রুত শিল্পায়নের ফলে ইউরোপে প্রচুর পরিমাণ দ্রব্য উৎপাদিত হয়; উপনিবেশগুলো ছিল এসব দ্রব্যের বাজার এবং কাঁচামালের উৎস। প্রথমদিকে পর্তুগাল, স্পেন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশগুলোই উপনিবেশিক বাজার বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীতে শিল্পায়িত অন্যান্য দেশগুলোও এ পথ অনুসরণ করে। উপনিবেশ হতে স্বাধীনতা লাভকারী ও দাসপ্রথা বিলুপ্তকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নব্যসৃষ্ট জার্মানি এমনকি প্রাচ্যের দেশ জাপানও বাজার বিস্তারের জন্য উপনিবেশ স্থাপনে তৎপর হয়। আজ উপনিবেশবাদ নেই কিন্তু রয়ে গেছে উপনিবেশী মন এবং এসেছে নব্য উপনিবেশবাদ। কোনো কোনো দৈনিক যখন দেশের আনাচে কানাচে ‘সাদা মনের মানুষ’ খোঁজে তখন মনে পড়ে ইউরোপসৃষ্ট সাদাবর্ণের শ্রেষ্ঠত্বের কথা। যে কোনো ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপন মানেই ‘সাদা’র শ্রেষ্ঠত্বের প্রচার। অবৈধ অর্থকে আমরা এখনো বলি কালো টাকা। উত্তর-উপনিবেশবাদী তাত্ত্বিক ফ্রাৎস ফ্রানোন-এর Black Skin White Masks গ্রন্থে বলা হয়েছে : That, in a white society, such an extreme psychological response originates from the unconscious and unnatural training of black people, from early childhood, to associate blackness with wrongness. That such unconscious mental training of black children is effected ... which are cultural media that instil and affix, in the mind of the white child, the societys cultural representations of black people as villains.’ এভাবেই গড়ে ওঠে অবচেতন আধিপত্যের চেতনা। যেটি নেগ্রিচুড প্রবক্তা এমে সেজেয়ার ও তাঁর শিষ্য ফ্রানোন উল্লেখ করেছেন। উপনিবেশিককালের বর্ণবাদী জ্ঞানচর্চা উপনিবেশ-উত্তরযুগেও অব্যাহত রয়েছে। জর্জ লেমিং একদা অভিমত দিয়েছিলেন, সমসাময়িক বিশ্বের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি ভূখণ্ড সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের দ্বারা প্রত্যক্ষ এবং গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। বিউপনিবেশায়নের শিল্প-সাহিত্য-নির্ভর প্রক্রিয়াসমূহ ইউরোপীয় চিহ্নায়কগুলিকে সমূলে উৎপাটন এবং ইউরোপীয় প্রধান আখ্যানগুলোকে উত্তর-উপনিবেশিক চেতনায় অগ্রাহ্য ও বিলোপ করার কাজে নিয়োজিত থেকেছে। এর সঙ্গে প্রায় সময় যুক্ত হয়েছে, সব ধরনের ঔপনিবেশিক কলঙ্কমুক্ত একেবারে সম্পূর্ণরূপে নতুন বা অতীত থেকে সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধারকৃত ‘বাস্তবতা’র দাবি। নির্মমতার অতিমারি ও সাংস্কৃতিক কালিমা লেপনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে উপনিবেশক ও উপনিবেশিতের মধ্যে সম্পর্কের প্রকৃতি বিবেচনায় নিলে সেরকম দাবি কাঙ্ক্ষিত ও অবশ্যম্ভাবী বটে। কিন্তু এই প্রকল্পে সহজাত স্ববিরোধিতা রয়েছে, যেমন চিনুয়েইজু, জেমি ও মাদুবুইক The Decolonization of African Literature (চিনুয়েইজু ও অন্যান্য, ১৯৮৫)-এ দেখাতে চেয়েছেন যে, সেরকম উপনিবেশপূর্ব সাংস্কৃতিক শুদ্ধতা কখনো সম্পূর্ণভাবে ফিরে পাওয়া যাবে না।
উত্তর-উপনিবেশিক সংস্কৃতিগুলো অবধারিতভাবে সংকরায়িত হয়ে গেছে, কারণ, এই সংকরায়নের পেছনে কাজ করেছে ইউরোপীয় সত্তাতত্ত্ব ও জ্ঞানতত্ত্বের সঙ্গে স্বাধীন স্থানিক আত্মপরিচয় সৃষ্টি করা বা প্রাক্তন আত্মপরিচয়কে ফিরিয়ে আনার আবেগের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। বিউপনিবেশায়নের একটি প্রক্রিয়া, কোনো আগত বস্তু নয়; এটি আধিপত্যবাদী মধ্যপন্থি সিস্টেমস এবং প্রান্তিক অবস্থান থেকে সেগুলোকে অগ্রাহ্য করার চলমান দ্বান্দ্বিকতাকে নির্দেশ করে; একদিকে, ইউরোপীয় বা ব্রিটিশ আখ্যানসমূহ এবং অন্যদিকে, উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে সেগুলোকে ভেঙে ফেলার চেষ্টার মধ্যে এই অগ্রাহ্য করা দ্বান্দ্বিকতা চলতে থাকে। যেহেতু ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের ঐতিহাসিক পরিণাম থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে জাতীয় বা আঞ্চলিক কাঠামো সৃজন বা পুনঃসৃজন করা সম্ভব নয়, তাই দুই বিশ্বের ভেতর থেকে (বা দুয়ের মাঝামাঝি থেকে), একটি প্রাধিকারের অবস্থানে দাঁড়িয়ে, উত্তর-উপনিবেশিক লেখালেখি ইউরোপীয় আখ্যানগুলিকে এবং তাদের আখ্যানগত কৌশলগুলিকে প্রশ্ন করার কর্মকৌশল বেছে নিয়েছে। এবং বিশ্বের অধিকাংশ জায়গায় ইউরোপ উপনিবেশিক আধিপত্য বিস্তারের জন্যে যে-পদ্ধতি চাপিয়ে দিয়েছিল এবং নির্দিষ্ট বিধিমালা দিয়ে তা বহাল রেখেছিল, তার অন্বেষণ করছে উত্তর-উপনিবেশিক সাহিত্য। উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন সাম্প্রতিকতম আবিষ্কারগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে ও সুচতুরভাবে ব্যবহার করে স্যাটেলাইট চ্যানেলের আবিশ্ব পরিব্যাপ্ত যে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে তা বিশাল জনসংখ্যার মধ্যে সমান মানসিকতা ও চাহিদাসম্পন্ন এক বাজার বানিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। মানবচৈতন্যের এই হোমোজিনোইজেসেন প্রক্রিয়া তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলোতে যে নতুন সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তুলতে চাইছে তা সমস্ত ধরনের জাতিগত-কৌমগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের অভিজ্ঞানকে মারাত্মকভাবে আক্রমণ ও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তার ফলে বিশ্বায়ণের যুগে প্রতিটি দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গে নেশন-স্টেট ও বহুজাতিক পুঁজির দ্বন্দ্ব তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ভারতবর্ষে হিন্দু সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের সাম্প্রতিক বিস্তার, চাহিদার চরিত্রকে অভিন্ন করে তোলার মাধ্যমে যে অখণ্ড চাহিদাসম্পন্ন বাজার বানিয়ে তোলার চেষ্টা করছে, তার অনিবার্য পরিণতি হিসেবেও নেশন-স্টেট এবং বহুজাতিক অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠছে। এইভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গ্লোবালাইজেসন ও লোকালাইজেসন-এর দ্বন্দ্ব ক্রমাগত ব্যাপ্ত ও ধারালো হয়ে ওঠছে। এই দ্বন্দ্বের সূত্রে চৈতন্যের ঔপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়াকে প্রত্যাখ্যানের প্রয়োজন আরো বেশি করে অনুভূত হচ্ছে।
আবার এই অনুভবের সূত্রেই আমরা উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বে চৈতন্যের ঔপনিবেশিকরণের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আরও একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য দেখতে পাচ্ছি। ফ্রানজ ফানোন-এর ‘ম্যানচিয়ান অ্যান্টাগনিজম’-এর বিপক্ষে দাঁড়ালে আমরা দেখতে পাই, মাস্টার ডিসকোর্সের আগ্রাসী ভূমিকাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশজ ডিসকোর্সগুলো ধারাবাহিকভাবে ইন্টেরোগেট করছে, তাদের নিজস্ব উচ্চারণের ওপর দাঁড়িয়েই। কিন্তু তার ফলে যে নতুন ডিসকোর্স গড়ে উঠছে তা-ও যে মাস্টার ডিসকোর্সের আধিপত্য থেকে পুরোপুরি মুক্ত তা বলা যাবে না। এই ডিসকোর্সগুলো এডওয়ার্ড সাঈদ-এর ছাঁচে ‘Us’ ও ‘Them’-এ ভাগ করা যায়। তার ফলে এক ধরনের Radical gesture থাকলেও ইউরোকেন্দ্রিকতা ও আধুনিকতার ধারণাসমূহকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যানের অক্ষমতা থেকেই এই নতুন ডিসকোর্সগুলো যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত হলেও কোনো কাউন্টার-ডিসকোর্স নির্মাণ করতে পারছে না। ঔপনিবেশিকতাকে একটি বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে দেখলে একথা বোঝা যায় যে, ভলতেয়ারের চীন একজন আধুনিক নৃতাত্ত্বিকের দেখা প্রাচ্য নয়। বরং তাকে পাশ্চাত্যের এক উদারনৈতিক মানবতাবাদীর অল্টার-ইগো হিসেবেই বিবেচনা করা যেতে পারে। মধ্যযুগে মধ্যপ্রাচ্যে অনেক ইউরোপীয়ই যেতেন এ্যারিস্টটল পড়তে। আবার ওয়ারেন হেস্টিংসয়ের মতো প্রথম প্রজন্মের ঔপনিবেশিক প্রতিনিধিরাও মনে করেছেন, ভারতবর্ষকে তারা যা শেখাতে চান তার তুলনায় তাদের নিজেদেরই অনেক বেশি কিছু শেখার আছে এদেশ থেকে। এর থেকে বোঝা যায় এক বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে ঔপনিবেশিকতা শুধু প্রাচ্যকেই রূপান্তরিত করেনি। সেই সঙ্গে পাশ্চাত্যকেও পরিবর্তিত করে দিয়েছিল। ফ্রাঞ্জ ফ্যাননের The wretched of the Earth (1961) গ্রন্থের মুখবন্ধে জাঁ পল সার্ত বলেছিলেন যে, উপনিবেশবাদ কখনো নিঃশেষ হয় না। নব্য-উপনিবেশবাদের মুখোশ পরে ফিরে আসে। সার্ত কথিত Infernal cycle of colonialism বা ‘ঔপনিবেশিকতার নারকীয় বৃত্তায়ন’।
কিন্তু এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ার পরিসীমার বাইরে, ভারতীয় সিভিল সোসাইটির গভীরে, বহু মানুষ ছিলেন যারা ভারতবর্ষকে অ-পাশ্চাত্য হিসেবে নয়, বরং শুধু মাত্র ভারতবর্ষ হিসেবেই ভাবতেন। ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষরা নিজেকে কখনোই নিজেদের পাশ্চাত্য মানুষের কাউন্টার-প্লেয়ার বা অ্যান্টি-থিসিস হিসেবে ভাবতেন না। তাদের পক্ষে এভাবে ভাবার কোনো কারণও ছিল না। তাদের কাছে ভারতবর্ষ প্রো-মডার্ন বা অ্যান্টি-মডার্ন কিছুই ছিল না। ভারতবর্ষ তাদের কাছে ছিল নিখাদ নন-মডার্ন। আর সেই সূত্রেই প্রকৃতি, সমাজ ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কসমূহের সমগ্রতার যে অবয়বটি সাধারণ চৈতন্যে বেঁচে ছিল তার চরিত্রটি ছিল সম্পূর্ণই দেশজ ও ঔপনিবেশিকতার প্রভাবমুক্ত। আর এই দেশজ চৈতন্যের বিশুদ্ধতার শেকড় ছিল দেশজ প্রকৃতির মধ্যে। ভারতবর্ষের সিভিল সোসাইটির আপাত-স্থানুত্ব-নিশ্চলতা সত্ত্বেও, তার স্ব-কাঠামোর গভীরে যে অন্তর্লীন অমেয় শক্তি ছিল, তার জোরেই সে পলিটিক্যাল সোসাইটির সমস্ত উদ্যোগ ও চৈতন্যের ঔপনিবেশিকরণ প্রতিহত করতে পেরেছিল। সিভিল সোসাইটি প্রতিবাদের এলাকা হিসেবে যে স্বায়ত্ত বজায় রেখেছিল তার বর্মে সজ্জিত হয়েই ভারতবর্ষের সাধারণ নাগরিকদের চৈতন্যে দেশজ শেকড় বেঁচে ছিল প্রকৃতির মতো, সমস্ত ঝড়-জল-ঝঞ্ঝা-তুফানকে উপেক্ষা করতে করতে। উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বেও তৃতীয় দুনিয়ার বাস্তবে দাঁড়িয়ে চৈতন্যের ঔপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করা সম্ভব, তৃতীয় দুনিয়ার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ডিসকোর্সের স্বাধীন অস্তিত্ব ও স্ব-অভিজ্ঞানকে মাথা উঁচু করে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব, শুধুমাত্র স্বদেশের সিভিল সোসাইটির অমেয় শক্তিকে যথাযথভাবে অনুধাবনের মধ্য দিয়েই। তৃতীয় দুনিয়ার সিভিল সোসাইটির অন্তর্লীন শক্তি এতটাই প্রবল যে, গ্যাট ও আইএমএফ নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যাপ্ত জালও তাকে পরাস্ত করতে পারে না। তৃতীয় দুনিয়ার সিভিল সোসাইটির এই অমেয় শক্তিকে অনুভবের মাধ্যমে ও প্রান্তীয় মানুষগুলোর অশেষ সৃষ্টিশিলতাকে শ্রদ্ধার মধ্যে দিয়েই, উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বে, আমরা পায়ের নীচে শক্ত জমি পেতে পারি। আর তার উপরে দাঁড়িয়েই আমরা দেখতে পারি ঔপনিবেশিকতাকে সামগ্রিকভাবে প্রত্যাখ্যানের স্বপ্ন আর উচ্চারণ করতে পারি বিশ্বাসের শব্দগুলোকে।
ইতালীয় মার্কসিয় দার্শনিক ও কমিউনিস্ট পার্টির এক সময়ের সভাপতি আন্তনিও গ্রামসি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ প্রিজনার নোটবুকে মূলত দুই ধরনের বুদ্ধিজীবীর কথা বলেন, অর্গানিক ও ট্রাডিশনাল। ট্রাডিশনাল বুদ্ধিজীবীরা কখনও জনমানুষের মুক্তির লড়াইয়ে অংশ নেন না। আর অর্গানিক বুদ্ধিজীবীরা জনমানুষের কাতারে সামিল হয়ে সবসময় তাদের সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া গ্রামসি আর এক ধরনের বুদ্ধিজীবীর কথা বলেন যারা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ট্রাডিশনাল থেকে অর্গানিক হয়ে ওঠার পথে চলেন। এদের তিনি ট্রানজিশনাল ইন্টেলেকচুয়াল নাম দেন। ভারতীয় উপমহাদেশে যেমন ছিলেন ফকির লালন, নজরুল এবং আরও অনেক পালাকার, যারা ছিলেন নিম্নবর্গীয় বা সেই নীতির আদর্শে আদর্শায়িত। আফ্রিকায় যেমন ছিলেন ফ্রানজ ফানোন, এইমে সেজেয়ার, আমিলকার কাবরাল, লিওপোল্ড সেডর সেংগরসহ আরও অনেকে।
উপনিবেশবাদবিরোধী এসব তাত্ত্বিকদের মধ্যে এইমে সেজেয়ার যা করেছেন তা হলো ঔপনিবেশিক জ্ঞানতত্ত্বের খুঁটি ভেঙে দিয়েছেন তিনি। এইমে সেজেয়ার প্রশ্ন তুলেছেন কী ‘সভ্যতা’ ও ‘সংস্কৃতির’ জন্ম দিয়েছে উপনিবেশকাররা? কী আলোকায়ন ঘটিয়েছে তারা। সেজেয়ার একেবারে সোজাসাপ্টা কথায়, চোখে আঙ্গুল দিয়ে একটার পর একটা প্রমাণ হাজির করে দেখান, উপনিবেশকাররা লুণ্ঠনকারী, ব্যবসায়ী, জাহাজের মালিক, স্বর্ণ-অনুসন্ধানকারী ও খাদক। সেজেয়ার দেখিয়েছেন কীভাবে উপনিবেশকাররা ঔপনিবেশিতদের সভ্যতাহীন, বর্বর এবং অধঃপতিত করেছে। বাধ্য করেছে নিজের চিন্তাচেতনা বলি দিতে; কাজ করেছে শঠতা, সংঘাত, বর্ণবিদ্বেষ ও নৈতিকতার অবক্ষয়ে। সেজেয়ার দেখিয়েছেন ভিয়েতনামে হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ আর মাদাগাস্কারে কী আজব সভ্যতা নির্মাণ করেছিল তারা। সেজায়ারের বয়ান উপনিবেশগুলোতে উপনিবেশকাররা সভ্যতাকে দাঁড় করিয়েছে মরা বাস্তবতায়। সর্বজনীন আদিমতা সেখানে ভর করেছে, গ্যাংগ্রিনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে তা। এবং যেসব মিথ্যা প্রচার করেছে, যেসব মানুষ বন্দী করেছে তারা, যেসব বর্ণবাদী মিথ্যা গৌরব উস্কে দিয়েছে তারা এবং যেসব দাম্ভিকতা দেখানো হয়েছে, সব মিলে ইউরোপের রক্তে বিষের মতো কাজ করেছে তা, যা অনিবার্যভাবে এ সভ্যতাকে অসভ্যতার দিকে নিয়ে যায়। [এইমে সেজেয়ার: ১৯৫৩]
সেজেয়ারের প্রামাণিকতা মুহূর্তেই তাসের ঘরের মতো ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। তিনি বলেছেন, ইউরোপে জন্ম নেয়া নাৎসিবাদ বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, পশ্চিম প্রচারিত মানবতাবাদের মধ্যেই পয়দা হয় নাৎসিবাদ- একেকটি হিটলার। সেজেয়ার বলেছেন, হিটলারের উত্থানের আগে ইউরোপীয়রা যে বর্বরতা চালিয়েছিল উপনিবেশের মানুষের ওপর তাকে মোটেই নাৎসিবাদ মনে হয়নি তাদের। নাৎসিবাদকেই তারা এর আগে সহ্য করেছিল, বৈধতা দিয়েছিল, কারণ তখন তাদের এটি আক্রান্ত করেনি। আগে নাৎসিবাদ চালানো হত অ-ইউরোপীয়দের ওপর, যখনই এটি ইউরোপীয় সাদা মানুষদের ওপর চালানো হলো, তখনই এটি পরিণত হল নাৎসিবাদে, আর হিটলার হলেন নাৎসিজমের জনক। সেজায়ের প্রমাণ করেছেন, ইউরোপীয় সভ্যতা দাঁড়িয়েছিল এবং আছে নাৎসিজমের ওপর। কী রকম নাৎসিজম, বর্বরতা চালানো হত অ-ইউরোপিয় উপনিবেশের ওপর তা তুলে ধরেছেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ডিসকোর্স অন কলোনিয়েলিজম-এ :
আলজেরিয়া জয়ী কর্নেল মন্টগনাকের একটি ছোট্ট লাইন উদ্ধৃত করছি: অনেক সময় একটি মেনিয়া আমাকে জেঁকে বসত যে, চারদিক থেকে আমাকে কে যেন ঘিরে রেখেছে। তখন পুঁইশাকের ডগার মতো আমার চারিদিকে যে মাথাগুলো পেতাম, সব কেটে ফেলতাম, মানুষের মাথা।’ আমরা কি কাউন্ট হ্যারিসনের কথা অস্বীকার করতে পারব, ‘এটা সত্যি আমরা বন্দি এবং শত্রুদের জোড়ায় জোড়ায় পিপাভর্তি কান কেটে নিয়ে এসেছি। [এইমে সেজেয়ার : ১৯৫৩] ‘যে সভ্যতা উপনিবেশবাদকে বৈধ ঘোষণা করে, সে সভ্যতা অসুস্থ, মরণোন্মুখ’- এইমে সেজেয়ার Have you ever felt that the moment you said the world ‘ও’, that ‘ও’ was someone else, not you? That in some obscure way, you were not the subject of your own sentence? Do you ever feel that whenever you speak, you have alreadz in some sense been spoken for? or that when you bear others speaking, that you are only ever going to be the object of their speech? Do you sense that those speaking would never think of trying to find out how things seem to you, from where you are? That you live in a world of others, a world that exists for others? উদ্ধৃতিটিতে ব্রিটিশ উত্তর-উপনিবেশবাদী চিন্তক রবার্ট জে সি ইয়ং কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন। যেখানে ‘আমি’/’অন্য’ দর্শনে নিজস্ব (obscure) সংস্কৃতি-দর্শন-ইতিহাস সম্পর্কে দ্বিতীয় ধারণা বা প্রথাগত চিন্তার বিপরীত ধারণার প্রশ্নটি উত্থাপন করেন। প্রাচ্য প্রাধান্যের বিষয়টিও আসে, যেখানে উর্বর ও উদ্বেগময় সংস্কৃতির অর্থ দীপ্তিময় হয়ে ওঠে। এর গুরুত্ব ‘বস্তুগত উত্তরাধিকার’ ও ‘সাংস্কৃতিক সাফল্য’, যেখানে পৃথিবীর সব মানুষের অধিকার সমান। বণ্টন সমান। বৈষম্য নেই। আধিপত্য নয়। কর্তৃত্ব নয়। সব মানুষ সমণ্ডঅধিকারে মর্যাদাবান। এতে শ্রেণিপার্থক্যও থাকবে না। ‘অপর’কে তুচ্ছ করে ‘আমি’র প্রাধান্য দেয়া নয়। শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক উচ্ছেদ করা। এমে সেজেয়ার কথিত ‘নেগ্রিচুড’ ধারণা আমাদের চেতনাকে আন্দোলিত করে তীব্রভাবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বাস পুনর্নির্মিত হয়, সেখানে সে শুধু তার অধিকার নয়, গণতন্ত্র ও অধিকারের সংস্কৃতির কথা বলে। তা শুধু এই তৃতীয় বিশ্বের নয়, বিশ্বের তাবৎ অধিকারচ্যুত জনতার। যারা স্বেচ্ছাচারির পদাঘাতে পদদলিত, বৈষম্য আর শোষণের করালগ্রাসে জর্জরিত। সেখানে সে নিজ শ্রেণির বিচ্যুতি ঘটিয়ে উঠে আসে গণতন্ত্রের নেতৃত্বদানকারী শক্তি হিসেবে। এই স্থানচ্যুতি বা শ্রেণিবিচ্যুতির শক্তিটি অর্জন করে বৈপরীত্য তত্ত্বে। এ শক্তির ঐক্যে তৈরি হয় বাখতিন কথিত কার্নিভালের। সেটি সংস্কৃতির সূত্রে যূথবদ্ধ। উচ্চস্থানচ্যুতির ফলে সে এ শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়। নারী, তার প্রতিষ্ঠা এখানে আরো জঙ্গমশাসিত। নারীবাদ নয়, নারীর প্রথাগত চিন্তার বিচ্যুতি ঘটে। সে লৈঙ্গিক ধারণার ঊর্ধ্বে অর্জন করে মানুষের শক্তি। সেখানে বৈষম্য নয়, সমণ্ডঅধিকার-সমবণ্টন শ্রমণ্ডউৎপাদন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মর্যাদা যুক্ত হতে সক্ষম হয়। কেন এ নির্বাচন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ‘হোয়াইট মাস্ক’ খুলে ফেলে, সংস্কৃতির ধারাবাহিক হীনম্মন্যতার বিপরীতে এক সংগ্রামশীল অভিঘাত। সে ঘোষণা করে প্রান্তের টান। কেন্দ্রকে অস্বীকার করে। কেন্দ্রচ্যুতিই প্রধান লক্ষ্য। সেটি তৃতীয় বিশ্বের গণমানুষের চিন্তাতত্ত্বে। ব্যাপক অর্থে এটি এশিয়া আফ্রিকা ল্যাতিন আমেরিকার স্থানিক সংস্কৃতির জয়ধ্বজা, ইউরোপীয় কেন্দ্র ধারণাকে অস্বীকার করে। ‘নেগ্রিচ্যুড’ প্রবণতায় ভূমিষ্ঠ সংগ্রামের ঝলক বিচ্ছুরিত, প্রতিবিম্বিত চিন্তার পৈঠা স্যবলটার্ন গোত্রের সংস্কৃতির উৎসবজাত। বঞ্চনা সেখানে বাতিল। শোষক একাকী। শোষিত ঐক্যবদ্ধ। এই ঐক্য একদা শুষে নেয় শোষকের রক্তচক্ষুর প্রতাপ। তুমুল শক্তি অর্জন করে তার সংস্কৃতির ভেতর থেকে। এই সংস্কৃতির উৎসবেই কৌম জীবন এক হয়। স্মর্তব্য, শুধু অধিকার বা মর্যাদাই নয়, সংস্কৃতির লোকায়ত অবয়বটুকুও আসন করে নেয়- উচ্চতা পায়, বুর্জোয়া বা হায়ারার্কি ভেঙে পড়ে। চিরদিনের অভ্যাসের ব্যত্যয়ে প্রান্তের এই স্থানিক বিচ্যুতি শুধু কলোনি-উত্তর ধারণাই নয়, মার্কসীয় চিন্তাতত্ত্বেরও অভিব্যক্ত রূপরেখা। আফ্রিকার চিনুয়া আচেবে, নগুগি ওয়া থিয়োংগো আর বাংলার আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিন্তার মিথস্ক্রিয়া হয় অভূতপূর্ব ঐক্যতানে।
কবি, চিন্তক, গণমাধ্যমকর্মী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গবেষক