পৃথিবীতে সামষ্টিক দারিদ্র্যতার প্রধান কারণ যুদ্ধ
অলোক আচার্য
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
যুদ্ধ ও দারিদ্র্যতা পাশাপাশি বিদ্যমান। পৃথিবীকে যুদ্ধ-সংঘাতমুক্ত করাও যেমন সম্ভব হচ্ছে না, সেভাবেই দারিদ্র্যতামুক্ত বিশ্বও গড়ে তোলা চ্যালেঞ্জের মুখে। কারণ একটি কারণের সাথে অপরটি সম্পর্কযুক্ত। মানুষ মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতেও হিমশিম খাচ্ছে। যুদ্ধাক্রান্ত অঞ্চলগুলোতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। সেখানে মানবিক বিপর্যয় চলছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) প্রকাশিত মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি ইনডেক্স অনুযায়ী, চরম দারিদ্র্য জীবনযাপন করছে বিশ্বজুড়ে ১১০ কোটি মানুষ, তাদের প্রায় অর্ধেকই সংঘাত চলা দেশগুলোতে বসবাস করছেন। জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপির এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
এছাড়া এই গবেষণায় উঠে এসেছে, বিশ্বের চরম দারিদ্যে বাস করা প্রায় অর্ধেক মানুষই ভারতে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে দারিদ্যের স্তর অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এসব দেশে পুষ্টি, বিদ্যুৎ, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বৈষম্য দেখা গেছে। দেশটির ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে ২৩ কোটি ৪০ লাখই চরম দারিদ্র্যে দিন কাটায়। ভারতের পরে রয়েছে পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া ও ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো। দারিদ্র্যে দিন কাটানো ১১০ কোটি মানুষের প্রায় অর্ধেক এই পাঁচ দেশের। আল জাজিরা জানায়, বিশ্বের ১১২টি দেশের ৬৩০ কোটি মানুষের ওপর যৌথ গবেষণা চালিয়ে এই তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৪৫ কোটি ৫০ লাখ মানুষ ‘দ্বন্দ্ব সংঘাতের মধ্যে’ বসবাস করছেন। আর চরম দারিদর্্েয বসবাস করছে ৫৮ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে অধিকাংশ শিশু, যা বিশ্বের মোট শিশুর ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ। যেসব দেশে যুদ্ধ-সংঘাত লেগে আছে সেসব দেশে শিশু মৃত্যুর হার ৮ শতাংশ। যেখানে শান্তিপূর্ণ দেশগুলোতে শিশু মৃত্যুর হার ১ দশমিক ১ শতাংশ।
যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রতিনিয়ত ঘটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় মানুষকে দারিদ্র্যতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যা ক্ষধার্ত মানুষ তৈরি করছে। সাথে প্রাকৃতিক বিপর্যয় তো রয়েছেই। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি- কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা এই কবিতা থেকে ক্ষুধার যন্ত্রণা সম্পর্কে কিছুটা উপলদ্ধি করা যায়। আবার প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন, রুচির রহস্য ক্ষুধায়। যেখানে ক্ষুধা নেই সেখানে রুচিও নেই। ক্ষুধা প্রাণীর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। মানুষ বাঁচার জন্য খায় নাকি খাওয়ার জন্য বাঁচে একজন ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে সে প্রশ্ন অর্থহীন। প্রকৃতপক্ষে ক্ষুধা এমন একটি কষ্ট যা ক্ষুধার কষ্টে না থাকা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অনুভব করতে পারে না। তা সম্ভবও নয়। ব্যাথিতের বেদন শুধু একজন ব্যাথিত হৃদয়ই বুঝতে পারে।
বর্তমান পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। ঠিক সেই সময়ে প্রচুর খাবার নষ্ট হয়। ভারসাম্যহীন এই অবস্থার জন্য আমাদের দায় রয়েছে। একদিকে ক্ষধার্ত মানুষের যন্ত্রণার আওয়াজ অন্যদিকে কোটি কোটি টাকার মারণাস্ত্রের বিকট শব্দ। কত কত আধুনিক অস্ত্রের সাজে সজ্জিত এই ধরণী। এটাই সবথেকে আশ্চর্যের যে মানুষ একমাত্র প্রাণী যারা অন্য মানুষের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য এসব অস্ত্র কিনছে। সেসব অস্ত্র বানাতেও কোটি কোটি ডলার ব্যয় করছে। পৃথিবীটা ডুবছে দারিদ্র্যতায়। একদিকে গড়ে উঠছে ধনীক শ্রেণি অন্যদিকে গড়ে উঠছে গরিব শ্রেণি। গড়ে উঠছে পুঁজিবাদের নীতি।
যুদ্ধের থাবায় ফিলিস্তিনে দীর্ঘদিন ধরে মানবিক সংকটে ভুগছে। এই মানবিক সংকটের অন্যতম হলো সবার জন্য খাদ্য, চিকিৎসা, নিরাপদ আশ্রয়ের নিশ্চয়তা। যুদ্ধাবস্থা দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকলে যেকোনো দেশেই এই রকম অবস্থারই সৃষ্টি হতে পারে। যারা যুদ্ধ বোঝে না, যারা অস্ত্র বোঝে না যারা দুমুঠো খাবার চেনে। অস্ত্র সেখানে নিরর্থক। যুদ্ধ মানেই অশান্তি, খাদ্যাভাব, পীড়িত মানুষের আর্তনাদ, গৃহহীন হওয়া, আত্মীয়-স্বজনের জন্য চোখের জল ফেলা। উত্তেজনার বশে ক্ষমতার মোহে করা যুদ্ধে এর থেকে বেশি পাওনা আর কি আছে। বাংলাদেশে চরম দারিদ্যের মধ্যে বসবাস করছেন ৪ কোটি ১৭ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ৬.৫ শতাংশ। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ‘বৈশ্বিক বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক ২০২৪ : সংঘাতের মধ্যে দারিদ্র্য’ শিরোনামে বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। বৈশ্বিক বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক ২০২৪ অনুযায়ী, বাংলাদেশে দারিদ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে মানুষের জীবনযাত্রার মান। এক্ষেত্রে দারিদ্র্য সূচকে বাংলাদেশের মান ৪৫.১ শতাংশ। শিক্ষায় ৩৭.৬ শতাংশ ও স্বাস্থ্যে রয়েছে ১৭.৩ শতাংশ। সব মিলিয়ে দেশের চরম দারিদ্যের অতি মানবেতর জীবনযাপন করছেন ৪ কোটি ১৭ লাখ মানুষ। বর্তমানে যেসব অঞ্চলে যুদ্ধরত অবস্থা বিরাজ করছে সেসব দেশের অবস্থা সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে জানলেই দেখা যায়, ফেলে যাওয়া কিছু ধবংসাত্মক অবস্থা ছাড়া আর কিছুই নেই।
সে অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে সময় লেগেছে বহু বছর। কোটি কোটি মানুষের ক্ষুধার চিৎকার আধুনিক অস্ত্রের শব্দের কাছে বড়ই ম্লান মনে হয়। এটাই বুঝি বাস্তবতা। যেখানে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের খাদ্যের অধিকার রয়েছে। কেউ ক্ষধার্ত থাকার কথাও না। এমনকি কোন প্রাণীরও ক্ষুধার্ত থাকার কথা না। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট প্রতিটি জীবই ক্ষধা মেটানোর অধিকার রাখে।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করে ক্ষুধা পেটে রাতে ঘুমাতে যেতে। ক্ষুধার্ত মানুষ কি কি করতে পারে। উত্তরটা এক কথায়। সবকিছু পারে। সে তখন নীতি নৈতিকতার ঊর্ধ্বে থাকে। তাই ক্ষুধার সাথে সমাজের আইনশৃঙ্খলার একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। যত ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়বে প্রত্যেক সমাজে ততই বিশৃঙ্খল অবস্থা বৃদ্ধি পাবে। কারণ প্রয়োজন কোন আইন মানে না। প্রতিটি মুখের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। প্রজাদের অভুক্ত রেখে রাজাদের মুখে মন্ডা মিঠাই খাজা ওঠে কি করে। সেই যে কবিতায় জন্মদিনের পার্টিতে একটি কুকুরের যে খাতির দেখিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়েছিল তা আজও অসহায় মানুষের রূপ। দামি অ্যালসেসিয়ানকে খাওয়াতে যে টাকা খরচ হয়, তার অনেক কম টাকাতেই তো অভুক্তের পেট ভরে। করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে যুদ্ধের ফলে মানুষ বেকার হয়েছে আর বেকারত্ব দারিদ্র্যতা ডেকে এনেছে। মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর এই প্রভাব বেশি পরেছে।
পৃথিবীজুড়ে আঘাত হেনেছে মুদ্রাস্ফীতি। এখান থেকে উত্তরণে সময় প্রয়োজন হবে এবং বিশ্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যই একটি দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। এর পেছনের কারণগুলো সমাধান করা তাই জরুরি। ২০১৫ সালে এন এজেন্ডা ফর দ্য গ্লোবাল ফুড সিসটেম শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এশিয়া বা আফ্রিকাসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যতার বাস্তবতা বিবেচনায় রেখেই ক্ষুধা ও দারিদ্র্যতা মুক্ত বিশ্ব গড়ার এ পরিকল্পনার কথা জানানো হয়।
২০৩০ সালের মধ্যে গোটা বিশ্ব থেকে দারিদ্র্যতা দূর করার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল। আরো উল্লেখ করা হয়, বিশ্বে প্রতিরাতে কমপক্ষে ৮০ কোটি মানুষ পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায়। বিভিন্ন দেশ এ থেকে উত্তরণের জন্য একটি ভালো খাদ্য ব্যবস্থা গড়তে গ্রামাঞ্চলে উন্নত কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নিয়ে যে কেবল আমাদের মত উন্নয়নশীল বা দরিদ্র দেশগুলোই চিন্তিত বিষয়টা এমন নয়। যুদ্ধ সংঘাত বন্ধ হবে কি না, সেটির কোনো স্পষ্ট বার্তা পাওয়া যায় না। কারণ মানুষ মরে যাক আর বেঁচে থাক, তাতে পৃথিবীর কিছু যায় আসে না। এখানে প্রভাব, জয়-পরাজয়ই মুখ্য। এখানে যুদ্ধ টিকিয়ে রাখাও ভালো জীবনযাপনের একটি উত্তমপন্থা! পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যতা বিদায় করতে হলে যুদ্ধ-সংঘাত বন্ধ করতে হবে।
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট