নভেম্বর মাস হচ্ছে ফুসফুসের ক্যান্সার সচেতনতা মাস ২০২৪। ইহা আমাদের সচেতন করে যেন প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার শনাক্ত করতে পারি এবং তার প্রতিরোধ করতে পারি।
ফুসফুসকে সুস্থ রাখার দিকে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের। এর কারণ হলো, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার অন্যতম অঙ্গ এই ফুসফুস। বিশ্বব্যাপী ফুসফুসের ক্যান্সারের ক্রমবর্ধমান প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যেই নভেম্বর মাসটিকে ফুসফুসের ক্যান্সার সচেতনতা মাস হিসাবে পালিত হয়।
আমাদের দেশেও সেমিনার ও সিমপোজিয়ামের মাধ্যমে এই মাসের তাৎপর্য তুলে ধরা হয়ে থাকে। মানবদেহে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে ফুসফুসের। ফলে দেখা দিচ্ছে শ্বাসকষ্টের সমস্যা। আর ফুসফুস ক্যান্সার একটি মারাত্মক ব্যাধি।
এটি প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা বেশ কঠিন। কারণ অন্যান্য ক্যান্সার শনাক্তকরণে যে স্ক্রিনিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তা ফুসফুস ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ততটা কার্যকরী ভূমিকা পালন করে না। তাই আর্লি স্টেজ পার হলে কিংবা ইন্সিডেন্টাল ফাইন্ডিংয়ের মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়। যেমন অনেক সময় দেখা যায়, আক্রান্ত ব্যক্তি কোনো কারণে ফুসফুসের এক্স-রে করেছেন, সেখান থেকে সন্দেহজনকভাবে পরবর্তী সময়ে ফুসফুস ক্যান্সার শনাক্ত করে চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে পুরুষদের ক্ষেত্রে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। মৃত্যুঝুঁকির প্রসঙ্গ আসলে বলতে হবে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্যান্সারে মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
ফুসফুস ক্যান্সার দুভাবে হতে পারে: এক. ফুসফুসে ক্যান্সার যখন শুধু ফুসফুসেই সীমাবদ্ধ থাকে।
বলা যায় কাশি, জ্বর, গলার স্বর পরিবর্তন, কাশির সঙ্গে রক্ত কিংবা শ্বাসকষ্ট ফুসফুসে ক্যান্সারের কিছু সাধারণ উপসর্গ, যেগুলো ফুসফুসে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে। দুই. ফুসফুস ক্যান্সার ফুসফুসে সীমাবদ্ধ না থেকে ফুসফুস থেকে অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়ে; যেমন হাড়ে ছড়িয়ে পড়লে প্রবল ব্যথা অনুভব হতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রে ফুসফুস ক্যান্সার মস্তিষ্কেও ছড়িয়ে যেতে পারে, এমনকি অনেক সময় আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করতে অজ্ঞান অবস্থাতেও নিয়ে আসতে হতে পারে। এটি লিভারে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এ ক্ষেত্রে পেটে ব্যথা কিংবা জন্ডিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই রোগটি কোন স্তরে আছে সেটির ওপর নির্ভর করেই চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। অন্যান্য ক্যান্সারের মতো ফুসফুস ক্যান্সারকেও চারটি স্তরে ভাগ করা যেতে পারে।
আর্লি স্টেজে এটি শনাক্ত করা খুবই কঠিন। তবে কিছু ইন্সিডেন্টাল ফাইন্ডিংসের মাধ্যমে এটি শনাক্ত করা হয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে ফুসফুসের লোকাল সমস্যা নিয়ে রোগী আসতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে ফুসফুস ছাড়িয়ে এটি অন্য কোথাও এমনভাবে চলে যায় যে সেসব অঙ্গে ক্ষতির লক্ষণ নিয়ে যখন রোগী পরামর্শ নিতে আসে, তখন ফুসফুস ক্যান্সার ধরা পড়ে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৫%-৯০% ফুসফুসে ক্যান্সারের জন্য দায়ী হলো ধূমপান। আমাদের দেশে বিভিন্ন স্থানে পানিতে আর্সেনিক রয়েছে, এটিও ক্যান্সারের একটি অন্যতম কারণ। এ ছাড়া পারিবারিক সূত্রেও কিংবা বার্ধক্যজনিত অন্যান্য রোগের কারণেও অনেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। তাই ফুসফুসে ক্যান্সারের উপসর্গ দেখামাত্রই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
ক্যান্সার কী? : বহুকোষী প্রাণীর শরীর অসংখ্য ছোট ছোট কোষের সমন্বয়ে তৈরি। এই কোষগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর মৃত্যুবরণ করে। আর এই পুরোনো মৃত কোষগুলোর স্থানে নতুন তৈরি হওয়া কোষ এসে জায়গা করে নেয়।
সাধারণভাবে কোষগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং নিয়মমাফিক বিভাজিত হয়ে নতুন কোষের জন্ম দেয়। তবে যখন এই কোষগুলো ক্যান্সার সহায়ক অনকোজিন সক্রিয় হওয়ার কারণে অথবা ক্যান্সার দমনকারী জিন নিষ্ক্রিয় থাকায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেতেই থাকে; তখনই সেই স্থানে মাংসের দলা অথবা চাকা দেখা যায়। যাকে বলা হয় টিউমার। এই টিউমার বিনাইন কিংবা ম্যালিগন্যান্ট হতে পারে। ম্যালিগন্যান্ট টিউমারই ক্যান্সার নামে পরিচিত। অর্থাৎ নিওপ্লাস্টিক বা টিউমার কোষ উচ্চহার বিশিষ্ট আক্রমণাত্মকতা, মেটাস্টাসিস এবং শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা সম্পন্ন হলে তাকে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বা ক্যান্সার বলে অভিহিত করা হয়।
ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণ : বিশ্বব্যাপী পুরুষের মৃত্যুর প্রথম কারণ ফুসফুসের ক্যান্সার, আর নারীদের ক্ষেত্রে এটি দ্বিতীয় কারণ। গ্রামের চেয়ে শহরবাসীরাই ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন বেশি। অবশ্য এর পেছনে যথাযথ কারণও বিদ্যমান- গ্রামের চেয়ে শহরে যানবাহন ও কল-কারখানার কালো ধোঁয়া, বায়ুদূষণ, ধুলাবালি সবকিছুই অনেক বেশি।
অজৈব পদার্থের ক্ষুদ্র কণা বা আঁশ যেমন- এসবেস্টস, নিকেল, ক্রোমিয়াম এবং জৈব পদার্থ যেমন- বেনজিন, বেনজোপাইরিন ইত্যাদি বায়ুর সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করে ফুসফুসের ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। ফুসফুসের ওপর প্রতিনিয়ত অত্যাচারই এর জন্য দায়ী। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ রোগীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপায়ী ও তামাকসেবী।
দিনে ২০টি করে ৪০ বছর সিগারেট খেলে ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা অধূমপায়ীর তুলনায়প্রায় ২০ গুণ বেশি। নিয়মিত ধূমপায়ীদের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্মল সেল ক্যান্সার হতে দেখা যায়। ফুসফুসের অন্যান্য ক্যান্সারের তুলনায় এটি বেশি মারাত্মক এবং অপেক্ষাকৃত দ্রুত শরীরের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।
ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণ : ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম লক্ষণ হলো কাশি। কাশি যদি আট সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় সঙ্গে বুকে ব্যথা থাকে তাহলে সাবধান হতে হবে। দুই-তৃতীয়াংশ রোগীর ক্ষেত্রে ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে কাশি দেখা যায়। তবে কাশির সঙ্গে কফ তৈরি হবেই, এমন কোনো কথা নেই। কারণ খুশখুশে কাশিও হতে পারে ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণ। কাশির সঙ্গে রক্ত ওঠা ফুসফুস ক্যান্সারের আরেকটি লক্ষণ। ধূমপায়ী পুরুষ রোগীদের ক্ষেত্রে এ লক্ষণটি আরও বেশি দেখা যায়। এ ছাড়াও ক্যান্সার কোষ শ্বাসনালির কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই দেখা দিতে পারে শ্বাসকষ্টও। তদুপরি দীর্ঘদিন গায়ে গায়ে জ্বর থাকা, হঠাৎ করে ডায়েট বাবা ব্যায়াম ছাড়াই প্রায় ৫ কেজি বা তার বেশি ওজন কমে যাওয়া, ঘনঘন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া, দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কর্কশ বা খসখসে হয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বর বা কণ্ঠস্বরে হঠাৎ পরিবর্তন, দীর্ঘ সময়ব্যাপী ক্লান্তি বা অবসাদবোধ, দুর্বলতা, ক্ষুধামান্দ্য প্রভৃতিও হতে পারে ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণ।
পরামর্শ : ফুসফুসের ক্যান্সার প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ধূমপান না করা ও তামক সেবন থেকে বিরত থাকা। এমনকি ধূমপায়ীর নিকটে অবস্থান করা থেকেও বিরত থাকতে হবে। শিল্প কারখানা ও গাড়ির কালো ধোঁয়া নির্গমন গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা জরুরি। বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ যেমন- ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, অ্যাসবেস্টস ইত্যাদি এড়িয়ে চলাও বুদ্ধিমানের কাজ।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।