প্রবীণের চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও প্রশমন
হাসান আলী
প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
প্রবীণদের বড় একটা অংশ নানান রকমের অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত। অসুখ দমন করার জন্য নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়। রোগের হাত তীব্র হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। ক্ষেত্র বিশেষে চিকিৎসক হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। প্রবীণদের শরীর যখন তখন খারাপ হয়ে যেতে পারে। নানান কারণে প্রবীণরা সন্তানরা চিকিৎসাসেবা যত্ন করার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পারেন না। সন্তানহীন প্রবীণদের সেবা যত্ন, দেখভাল করার জন্য নিকটতম আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সেবাকর্মীর প্রয়োজন হয়। মোট কথা অসুস্থ প্রবীণদের বাসাবাড়িতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাকর্মী নিয়োগ দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হবে। আমাদের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি হলো- বাবা-মার চিকিৎসাসেবা করবে, ছেলে, ছেলের বউ, মেয়ে, মেয়ে জামাই, নাতি-নাতনি। মারাত্মক অসুস্থ প্রবীণ হাসপাতালে ভর্তি হবার সংবাদ শুনে চিন্তার মধ্যে পড়ে যান। দুর্বল চিত্তের প্রবীণরা পরিবার পরিজন, আত্মীয়, আত্মীয় স্বজনের কাছে দোয়ার আবেদন জানান। কেউ কেউ আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের কাছে দায় দাবি ছাড়ান, ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আর ফিরে যেতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে আতঙ্ক সারাক্ষণ অস্থির করে তোলে। আশা-নিরাশার দোলাচালে দুলতে থাকেন। জটিল রোগ সম্পর্কে অনেকের ধারণা অস্পষ্ট। অনেক ক্ষেত্রে জটিল রোগ সম্পর্কে জানানো হয় না। হাসপাতালে নেয়ার পর রোগ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিতে হবে। আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা কতটুকু, চিকিৎসার সম্ভাব্য খরচ, দেশের বাইরে কত খরচ হতে পারে, হাসপাতালে কতদিন থাকতে হবে। উপরের প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর দেয়া খুবই জরুরি। চিকিৎসকের উচিত হবে প্রবীণকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতাল থেকে ছুটির ব্যবস্থা করা। দীর্ঘ সময় ধরে প্রবীণরা হাসপাতালে থাকলে সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অনেক সময় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। প্রযুক্তির ব্যবহার রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনতে পারলে মৃত্যুর ঝুঁকি এবং চিকিৎসা ব্যয় কমে যায়। হাসপাতাল রোগ নিরাময় কেন্দ্র এই বিশ্বাস জোরদার করতে হবে। হাসপাতালের উপর আস্থা কমে গেলে আরোগ্য লাভ বিলম্বিত হবার সম্ভাবনা থাকে। হাসপাতাল থেকে ছুটির পর অনেক ক্ষেত্রে রিহ্যাব বা পুনর্বাসনের আওতায় আনার প্রয়োজন দেখা দেয়। পুনর্বাসন বলতে বুঝায় রোগীর বাসাবাড়ির বাইরে অন্য স্থানে বসবাস করা। সেখানে একজন মানুষকে নিজের দৈনন্দিন জীবন গোছাতে এবং স্বাভাবিক জীবনে জীবনে ফিরে যেতে সাহায্য করে। আবার ডে কেয়ার সেন্টার থেকে ও একই ধরনের সেবা পাওয়া যায়। এখানে চিকিৎসকের পরামর্শে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সেবা কর্মীর সেবা যত্ন, ব্যায়াম, ফিজিওথেরাপি দিয়ে রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। একসময় আমাদের প্রিয়জনদের জন্য একটি রিহ্যাব সেন্টার প্রয়োজন হতে পারে।
পুনর্বাসনের মূল উদ্দেশ্য হলো, রোগীকে আবার স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। কিছু কিছু পুনর্বাসন কেন্দ্রে শুধুই রোগীর সেবা যত্ন করা হয়। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, পরিচিত জনদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসতে উৎসাহিত করা হয়। স্ট্রোকের শুরুতে চিকিৎসা হয় হাসপাতালে। রোগটি স্নায়ুজনিত সমস্যা তাই এর চিকিৎসা দেন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। স্ট্রোক করলে মস্তিষ্কের কিছু কোষ মরে যায়। ফলে তাদের নির্দেশে শরীরের যে কাজ হতো তার ব্যাঘাত হয়। মৃত কোষের চারপাশে যে সমস্ত ঘুমন্ত কোষ থাকে তাদের জাগিয়ে তোলে ট্রেনিং দিয়ে কর্মক্ষম করা। প্রথম চল্লিশ দিন ঘুমন্ত কোষগুলো দ্রুত জেগে উঠতে পারে। কাজ শেখার হার চট পটে হয়। ঠিকভাবে রিহ্যাব চালিয়ে নিলে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে প্রায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভবনা তৈরি হয়। অপারেশন পরবর্তী সময়ে রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক কর্মজীবনে প্রবেশ করার জন্য পুনর্বাসন দরকার হয়। দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আগে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হয়। প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা প্রশমন সেবা হলো- একজন রোগীর জীবনের শেষ ধাপের সেবা। এখানে অনিরাময় যোগ্য রোগের রোগীকে শান্তি পূর্ণ ও স্বস্তি দায়ক মৃত্যু যাত্রায় সহযোগিতা করা। প্রশমন সেবার মাধ্যমে রোগীকে মানসিক, শারীরিক, সামাজিক, আত্মিকভাবে মৃত্যুকে সহজভাবে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত করা।
রোগীর সহায় সম্পদ, টাকা-পয়সা, জমি জিরাত, দালান কোঠা, ব্যবসা-বাণিজ্য বিলি বণ্টনে সহায়তা করা। মৃত্যু পথযাত্রী সন্তানসন্ততির ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন উৎকণ্ঠা তৈরি হলে সেই সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে তাকে চিন্তা মুক্ত করা। রোগীর বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে সর্বাত্মক সহয়তা করা। ক্যান্সার, যক্ষা, লিভার, কিডনি বৈকল্য, ডায়েবিটিস, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, ফুসফুসের রোগসহ আরো কিছু রোগে মানুষের মৃত্যু বেড়ে চলছে। চিকিৎসায় যাদের আর সুস্থ হবার সম্ভাবনা থাকে না, প্রচণ্ড ব্যথা, যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকে, তাদের জন্য প্রশমন কেন্দ্র জরুরি।