নিত্যপণ্যের মূল্য মানুষের সাধ্যের মধ্যে রাখতে হবে
প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিত্যপণ্যের মূল্য কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, ডিমসহ প্রায় সবধরনের পণ্যমূল্য কমার পরিবর্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের নানামুখী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পণ্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রয়েছে। তবে আগাম শীতকালীন শাক-সবজি বাজারে আসায় দাম কমতে শুরু করেছে। যেসব সবজির মূল্য কয়েকদিন আগেও কেজি প্রতি ১০০ বা তার কাছাকাছি ছিল, তা এখন গড়ে ২০-৩০ টাকা কমে ৫০-৬০ টাকায় এসেছে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। সমস্যা হচ্ছে, অন্যান্য পণ্যের মূল্য নিয়ে। বিশেষ করে চাল, ডাল, তেল, ডিম, পেঁয়াজ ইত্যাদির মূল্য বাড়ছেই। এসব পণ্যের বেশিরভাগের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার টিসিবি’র মাধ্যমে ট্রাকে ন্যায্যমূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা অব্যাহত রাখলেও তার প্রভাব সাধারণ বাজারে পড়ছে না। বলা বাহুল্য, শহরভিত্তিক টিসিবির এ ব্যবস্থা গ্রামীণ বাজারে কাজ করছে না। ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই অত্যন্ত কষ্টে জীবনযাপন করছে।
এতে সরকারের প্রতি তাদের অসন্তোষ ও ক্ষোভ বাড়ছে। বলা বাহুল্য, যেকোনো সরকারের প্রতি জনসমর্থনের মিটারের পারদ উঠানামা করে পণ্যমূল্য নাগালের মধ্যে রাখা-নারাখার ওপর। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে স্বস্তি দেয়া। এ কাজটি করতে সরকার এখনও সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেনি। এতে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের যে আকাশচুম্বি প্রত্যাশা তা কিছুটা হলেও ম্রয়িমান হয়েছে। যদিও সরকার পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং, বিভিন্ন পণ্যের শুল্ক ছাড়, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণসহ নানা ব্যবস্থা নিয়েছে, তারপরও এসব পদক্ষেপের সুফল খুব কমই মিলছে। যেমন ডিম ও পেঁয়াজের দাম কমাতে গত মাসে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহর করলেও তার কোনো প্রভাব বাজারে পড়েনি। বরং গত এক সপ্তাহে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়ে ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ডিমের ডজন প্রতি মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও তা ছাড়িয়ে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
এ সমস্যার ক্ষেত্রে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, ডিমের চাহিদা ও উৎপাদনের পরিসংখ্যান নিয়ে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন দৈনিক ডিমের চাহিদা ৫ কোটি পিসের মতো। পোল্ট্রি খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) হিসাব মতে, দেশে দৈনিক ডিমের উৎপাদন ৪ কোটি ৫০ লাখ পিস। অন্যদিকে, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, ডিমের দৈনিক উৎপাদন ৬ কোটি ৩০ লাখ পিস। এ হিসেবে, ডিমের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকার কথা। হিসাবের এই গড়মিল হওয়ার কারণ হচ্ছে, বিপিআইসিসি হাঁস ও কোয়েল ডিমের হিসাব ধরছে না। অথচ এই দুই উৎস থেকে ডিম উৎপাদিত হয়, প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি পিসের বেশি। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, হয় উদ্যোক্তাদের হিসাবে, নতুবা অধিদফতরের হিসাবে গোলমাল রয়েছে। আমরা দেখেছি, বিগত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সময় সব খাতে পরিসংখ্যানের মিথ্যা তথ্য দিয়ে উন্নয়ন দেখাতে। ফলে মানুষের মধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি কোনো ধরনের বিশ্বাস ছিল না। তার বিদায়ের পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, অন্তর্বর্তী সরকার মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করবে। তারা এখনও তা সরকারের মধ্যে দেখতে পাচ্ছে না। তাদের বিশ্বাস ও আস্থা ধরে রাখতে হলে কৃষিপণ্যসহ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঠিক পরিসংখ্যান দিয়ে উৎপাদন ও চাহিদার সমন্বয় ঘটাতে হবে। এখানে ভোজভাজির হিসাব গ্রহণযোগ্য হবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, এখন কৃষিপণ্যসহ পোল্ট্রি খাতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বাজারমূল্য বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। তবে সাধারণ মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির ক্ষেত্রে মুল্য তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখে তাদের স্বস্তিতে রাখার দায়িত্ব সরকারের। এক্ষেত্রে ভর্তুকি, বেশি বরাদ্দ দিয়ে কিংবা অন্য যে উপায়ে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিত্যপণ্যের চেইনশপ রয়েছে। উন্নত বিশ্বের চেইনশপগুলো পণ্যের উপর মূল্যছাড় দিয়ে থাকে। আমাদের দেশের এ ধরনের শপগুলোও এ পন্থা অবলম্বন করতে পারে। এজন্য কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে খাদ্য, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়গুলো যোগাযোগ করে পণ্যমূল্য মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার জন্য তাদের সহযোগিতা চাইতে পারে। এতে কিছুটা হলেও পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। অন্যদিকে, সিন্ডিকেট সবসময়ই ছিল এবং এখনও আছে। সিন্ডিকেটকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে উপায়ও মন্ত্রণালয়গুলোকে বের করতে হবে। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে দায়িত্বে আসা অন্তর্বর্তী সরকারকে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অধিক তৎপর হতে হবে। এর উপর সরকারের জনসমর্থন ধরে রাখা অনেকাংশে নির্ভর করে। সরকারের মেয়াদ তিন মাস হতে যাচ্ছে। এই সময়ে নিত্যপণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা মানুষের কাছে ব্যর্থতা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে কারণ যাই থাকুক না কেন, সাধারণ মানুষ চায়, সরকার সেসব কারণ যেকোনো উপায়ে দূর করে তা তাদের নাগালের মধ্যে রাখবে। আমরাও মনে করি, পরিসংখ্যানের হেরফেরের বিতর্ক না করে, কীভাবে নিত্যপণ্যের মূল্য সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে আনা এবং রাখা যায়, সে পদক্ষেপ সরকারকে জরুরিভিত্তিতে নিতে হবে। মানুষের বেঁচে থাকার উপকরণে যদি ঘাটতি থাকে, তাহলে তার পক্ষে সরকারের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার কোনো কারণ নেই। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য যদি জনঅসন্তুষ্টি দেখা দেয়, তাহলে সরকারের অন্যান্য অপরিহার্য লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন বিলম্বিত ও ব্যাহত হতে পারে, যা আদৌ কাম্য নয়।