দেশের সমুদ্রসীমা ও ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনাময় পরিক্ষেত্রে সেন্টমার্টিন দ্বীপ অন্যতম আলোচ্য বিষয়। প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন নিয়ে বিগত সরকার রাজনৈতিক বক্তৃতাবাজি করলেও এর রক্ষণাবেক্ষণ, দূষণ প্রতিরোধ ও উন্নয়নে তেমন কিছুই করেনি। অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সেন্টমার্টিনের নিরাপত্তা ও উন্নয়নের বিষয়গুলোকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছে সরকার। গত ২২ অক্টোবর ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ ও নিরাপত্তার নাজুক অবস্থার চিত্র বেরিয়ে আসে। সে প্রেক্ষাপটে দ্বীপটিতে পর্যটন নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নভেম্বরে পর্যটকদের সেন্টমার্টিনে রাত্রিযাপন বন্ধ রাখাসহ আগামী চার মাস পর্যটক সংখ্যা দিনে দুই হাজারে সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সেন্টমার্টিন যেতে পর্যটকদের রেজিস্ট্রেশন করা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেককে বিরূপ মন্তব্য করতে দেখা গেছে। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি বছরের পর বছর ধরে ভয়াবহ ভাঙ্গন ও দূষণের শিকার হলেও সেদিকে সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। বিগত সরকার শুধু সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে অহেতুক রাজনৈতিক প্রপাগান্ডায় লিপ্ত ছিল। সেন্টমার্টিন ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের গোপন সমঝোতার দাবি করেছিলেন শেখ হাসিনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট তা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছিল। এক রিপোর্টে জানা যায়, গত কয়েক বছরে সামুদ্রিক ভাঙ্গনের কবলে সেন্টমার্টিন দ্বীপের অর্ধেকের বেশি সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির সাথে সাথে সামুদ্রিক ঢেউয়ের অবিরাম আঘাতের মুখে সেন্টমার্টিন এখন প্রবাল পাথরের উপর দাঁড়িয়ে থাকলেও চারপাশের ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে না পারলে দ্বীপটির অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। বিগত সরকার সেন্টমার্টিন দ্বীপের পর্যটন থেকে বছরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করলেও দ্বীপের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টি উপেক্ষা করেছে। অথচ দ্বীপটি নিয়ে মনগড়া কনস্পিরেসি থিউরি বানিয়ে রাজনৈতিক বয়ান হাজির করেছে। সেন্টমার্টিনে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ, রাত্রিযাপন ও এবং প্লাস্টিক দূষণ রোধের অর্ন্তবর্তী সরকারের উদ্যোগ এই প্রেক্ষাপটে খুবই ইতিবাচক। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা প্রবাল দ্বীপের ভাঙন রোধে কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুধুমাত্র পর্যটনের আয় বৃদ্ধি করতে সেন্টমার্টিনে অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও দালানকোঠা নির্মাণের কারণে ভাঙনের সাথে সাথে অতিরিক্ত চাপে দ্বীপটি নিচের দিকে দেবে যাচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। অতীতের অবহেলা ও ভুলের কারণে বর্তমান দূষণ ও ভাঙন চরম আকার ধারণ করেছে। এ বিষয়ে আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকলেও তা রক্ষা করা হয়নি।
যেখানে বঙ্গোপসাগরে নতুন জেগে ওঠা ভূমি দেশের জন্য নতুন স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে, সেখানে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যময় প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের ধ্বংসের চিত্র বড় দুশ্চিন্তা ও আশঙ্কার বিষয়। চলমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ও সমুদ্র সম্পদ নিয়ে বিপুল সম্ভাবনার সাথে সাথে বিরূপ আশঙ্কারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সাগরে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের পাশাপাশি সেন্টমার্টিন নিয়ে মিয়ানমারের শ্যেনদৃষ্টি লক্ষ্য করা গেছে। অনেক আগেই সরকারিভাবে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে গণ্য করা হলেও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ ও বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্টদের অনীহা ও দায়িত্বহীনতার কারণে ত্রিমুখী সংকটের সম্মুখীন হয়েছে সেন্টমার্টিন। দ্বীপটির ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের কারণেই এ নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনীতিতে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের আলোচনা টেনে এনেছিলেন। এসব কারণে সেন্ট মার্টিন নিয়ে দেশের মানুষের আগ্রহ ও কৌতুহল অনেক বেশি। অর্ন্তবর্তী সরকার এবং আগামি নির্বাচিত সরকার সেন্টমার্টিনের ভাঙন রোধ ও পরিবেশ দূষণ রোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে, এটাই সকলের প্রত্যাশা। কোনো গুজব ও অপপ্রচার কাম্য নয়। সেন্ট মার্টিনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে মানুষ জানতে চায়। দেশের অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের ভাঙ্গন রোধ, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত নিরাপত্তার প্রয়োজনে টাস্কফোর্স ও বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করার উদ্যোগ নিতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত পর্যটন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পরিবেশগত সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সেন্ট মার্টিন সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা ও অস্বচ্ছতা দূর করতে সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সাথে সমুদ্র সম্পদ বা ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা কাজে লাগানোর বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়