ঢাকা ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি জরুরি

অলোক আচার্য
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি জরুরি

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্তর্জাতিক সংস্থার র‌্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে থাকা বা না থাকা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা চলতেই থাকে। কারণ মাঝে মধ্যেই বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি সেরা তালিকা প্রকাশ করা হয়। এবং অধিকাংশ সময়ই আমরা দেখেছি যে, দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এতে প্রথম কয়েকশ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও স্থান পায়নি। আবার খুব কম হলেও থাকে। প্রশ্ন ওঠে এবং এটিই স্বাভাবিক। এখানে অতটা গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই এমন ভাব থাকলেও আসলেই কি তাই? যদি এশিয়ার অন্য দেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় এসব তালিকায় থাকতে পারে তাহলে আমাদের দেশের এত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিও থাকছে না সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। এসবের কোনো সদুত্তর আজ পর্যন্ত পাইনি। বা ঘাটতি পূরণ করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছে বা হচ্ছে কিনা তা জানা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা, গবেষণার পরিবেশ, গবেষণার মান, ইন্ডাস্ট্রি সংযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং করা হয়।

কিন্তু এসব মানদ-ে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক পিছিয়ে। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বর্তমানে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেড় শতাধিক। বিশ্ব বা এশিয়া র‌্যাঙ্কিংয়েও ভালো অবস্থানে নেই এসব বিশ্ববিদ্যালয়। গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিং-২০২৫ এর তালিকার সেরা ৮০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান পায়নি বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া এশিয়ার সেরা ৩০০টির তালিকায়ও নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। এশিয়ার মধ্যে অন্যতম প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন এই তালিকার উপরের দিকে থাকে না বা নেই সেই প্রশ্নও স্বাভাবিক। আমাদের শিক্ষার মান কেন আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে না, কেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণাক্ষেত্র হয়ে উঠছে না এসব প্রশ্ন কার কাছে করবো। শিক্ষার মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যতরকম পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয় পৃথিবীতে এই উদাহরণ সম্ভবত কম। এরা এক ধরনের গিনিপিগ। এক বছর এক পদ্ধতি তো অন্য বছর আরেক পদ্ধতি। কারো পরীক্ষা থাকছে কারো থাকছে না। সর্বগ্রহণযোগ্য উদ্যোগে একটি সিস্টেম চালু করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলে এই সমস্যায় পড়তে হতো না। এক তরফা কোনো কিছু বাস্তবায়ন করতে গিয়েই এই সমস্যা। এতে কিন্তু শুধু ছাত্রছাত্রীরা পিছিয়ে পরছে না; পিছিয়ে পরছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাও। যার বাতাস লাগছে উচ্চস্তরে। এই ব্যর্থতার কাদের? আমরা কেন এই দায় নেব না?

আমরা তো আশা করছি না যে আমাদের দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম তিনশ’র মধ্যে থাকতে হবে। অন্তত একটি বা দুটি হলেও আমরা বলতে পারি। এটি কি আন্তর্জাতিকভাবে দেশের শিক্ষা নিয়ে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না? উন্নয়নের একটি সেরা ক্ষেত্র হলো শিক্ষা। এবং বিশ্ববিদ্যালয় হলো সর্বশেষ ক্ষেত্র। যেখান থেকে একজন শিক্ষার্থী একজন পরিপূর্ণ মানুষ ও সম্পদ হয়ে দেশের হাল ধরার যোগ্যতা অর্জন করে থাকে। এ র‌্যাঙ্কিংয়ে সেরা ৮০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতের ২২টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। এই ৮০০-এর তালিকায় আছে পাকিস্তানেরও বিশ্ববিদ্যালয়। তালিকায় দেশটির নয়টি বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা করে নিয়েছে। এবারের র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে আছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) এবং তৃতীয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চমৎকার শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ তৈরিতে আমরা পুরোপুরি সফল হইনি। রাজনীতিকিকরণের মারপ্যাঁচে বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। এখন যদিও অনেক ক্যাম্পাসেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষক নিয়োগে বিভিন্ন সময় দুর্নীতি ও আত্মীকরণের অভিযোগ, দলীয় প্রভাবের অভিযোগসহ দক্ষদের বাদ পড়ার অভিযোগও রয়েছে। এতসব দিয়ে কি আর শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেওয় যায়! শিক্ষাকে শিক্ষার জায়গায় রেখে বাকি সব অন্য জায়গায় সরাতে হবে। সেখানে এমন একটি পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে যেখানে শিক্ষা নিয়েই আলোচনা হবে, মেধাবীরাই উচ্চতর জায়গায় যাবে এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার সাথে মিল রেখে কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

এই তালিকা থেকে দেখা যায় যেসব দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় এই তালিকায় নেই তাদের অনেক দেশের সাথেই আমাদের দেশের কয়েকটি বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে। যেমন পাকিস্তানের কথাই ধরা যাক। তারা অর্থনৈতিকভাবেও আমাদের দেশের চেয়ে দুর্বল। অথচ আমরা জানি বাংলাদেশ শিক্ষা ক্ষেত্রেও এগিয়ে যাচ্ছে। অন্তত দেশে আজ অনেকগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অসংখ্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকলেও অন্তত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে মানুষের ধারণা আজও বেশ স্বচ্ছ। প্রতি বছর এইচএসসি পরীক্ষার পর ছাত্রছাত্রীদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিযোগিতা দেখে সেটা অনুমান করা যায়। একটি আসনের বিপরীতে কত অসংখ্য ছাত্রছাত্রী অংশ নেয়। তালিকায় আমাদের দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় থাকুক আর না থাকুক তাতে খুব বেশি কিছু যায় আসে না। কিন্তু অনেক প্রশ্ন থেকে যায়- কেন এতগুলো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় উপরের দিকে বা ভারত, পাকিস্তান বা মালয়েশিয়ার পাশাপাশি আমাদের দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থাকা প্রায় দুর্লভ হয়ে গেছে। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তাহলে কি কোনো গলদ রয়ে গেছে। থাকলে সেটি কোথায়। তা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। বিষয়টি যদি আমরা ছেড়েও দেই তাহলেও প্রশ্ন বাদ যাবে না। কারণ আমাদের কোথায় সমস্যা সেটি তো খুঁজে বের করতেই হবে। তার আগে শিক্ষা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। সবচেয়ে বড় কথা যে, সবক্ষেত্রে যদি আমরা অন্য দেশকে ছাড়িয়ে যাই তাহলে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকাটা কোনো শুভ লক্ষণ নয়। বরং এই ক্ষেত্রে আমাদের কোথায় ঘাটতি রয়েছে তা নিয়ে গবেষণা করা দরকার। এবং যে জায়গায় ঘাটতি রয়েছে তা পূরণে উদ্যোগ নিতে হবে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের আজকের শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল চাকরি পাওয়া। একটা সার্টিফিকেট আর চাকরি তারপর জীবনে আর কোনো দুঃশ্চিন্তা থাকে না। আমাদের দেশে চলে আসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বহুবার ঘষামাজা করা হয়েছে। কখনো কোনো বিষয় বাতিল করা হয়েছে আবার প্রয়োজনের খাতিরে কোনো বিষয় বাদ দেয়া হয়েছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারে ভূমিকা রেখেছিল ব্রিটিশরা। মূলত ব্রিটিশদের তৈরি করা শিক্ষা ব্যবস্থাতেই কিছুটা পরিবর্তন করে আজও আমাদের দেশে চলছে। ইংরেজ সাহেবদের সেই ইচ্ছার প্রতিফলন আজও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখতে পাই। আমাদের পোশাকে, আমাদের চালচলনে আমরা সর্বদাই সেই সাহেবদের অনুসরণ করার করি। নিজেদের সংস্কৃতিকে গুলিয়ে আমরা পর সংস্কৃতির শিক্ষাই লাভ করতে শিখেছি।

পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে দেশে রীতিমতো যুদ্ধ হয়। আমাদের দেশে অনেক জিনিসই কিনতে পাওয়া যায়। সার্টিফিকেট কেনা বেচা তো হয়ই। রেজাল্ট, সার্টিফিকেট এমনকি মনুষত্ব পর্যন্ত বিক্রি হয়ে যায় এদেশে। আবার যেকোনো শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করেও শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন কেউ কেউ। ভাবা যায় একটি দেশের সর্বোচ্চ মানুষ যারা তৈরি করবে তারা নিজেরাই মনুষত্বহীন! তারা টাকা দিয়ে প্রশ্ন কিনে তারপর শিক্ষক হতে চান। তারা ছাত্রছাত্রীদের কী শিখাতে পারেন? শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার ভুয়া সার্টিফিকেটধারী কত শিক্ষক তো চাকরি হারিয়েছেন। যাদের নিজেদেরই মনুষ্যত্ব নেই তারা আবার ছাত্রদের শেখাবেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত