কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ
প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে ভয়ংকর সব অবরাধে জড়িয়ে পড়ছে শিশু-কিশোররা। বর্তমান সময়ে এ প্রবণতা বেড়েছে। গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলের পাড়া-মহল্লøায় অনেক শিশু-কিশোর অপরাধে জড়িয়ে ভয়াবহ সব ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। কিশোর গ্যাং কালচার এর জন্য দায়ী। সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে শিশু-কিশোরদের অপরাধের ধরন দেখলেই এর সত্যতা মিলবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্য মতে, বাংলাদেশে পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশু-কিশোরের সংখ্যা চার কোটি। এদের মধ্যে কিশোর বয়সি অনেকে নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এদেরই একটি অংশ কিশোর গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, পরিবারের আর্থিক অভাব, প্রাচুর্য, শিক্ষার অভাব, শাসনহীনতা, অভিভাবকের উদাসীনতা, মূল্যবোধের সঙ্কট, পরিবারের ভেতরে অপরাধীর বা অপরাধের উপস্থিতি শিশু-কিশোরদের বিপথগামী করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বন্ধু-বান্ধবরা তাদের অপরাধ জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের খাবার ও আশ্রয়ের কথা বলে অপরাধীরা তাদের এ জগতে টেনে নেয়। এছাড়া সমাজের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্যও শিশু-কিশোরদের অপরাধী হিসেবে গড়ে তোলে। অপরাধে লিপ্ত শিশু-কিশোরদের ৮০ শতাংশ জানে যে, তারা অপরাধ করছে।
একসময় আমাদের সমাজে শিশু-কিশোরদের অন্যের গাছের ডাব, আম, লিচু, পেয়ারা ইত্যাদি মালিকের অনুমতি ছাড়া পেড়ে খাওয়াকে দুরন্তপনা হিসেবে ধরা হতো। প্রাপ্তবয়স্কদের অনেকে শিশু-কিশোরদের এসব কাজে মৃদু ভর্ৎসনা করতেন। তবে অভিভাবকরা এসব কাজকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতেন না; কিন্তু দেশের পরিবর্তিত সমাজ বাস্তবতায় সেই বিষয়গুলো এখন নেই।
বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের বিষয়টি মাঝে মধ্যে সামনে আসে। যখন এদের অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায় তখন গণমাধ্যমে খবর হয়। সম্প্রতি একটি সহযোগী দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ বেড়েছে। হত্যা, মাদক ব্যবসায়, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমি দখল থেকে শুরু করে নারীদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনাও ঘটছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের মাধ্যমে। গত কয়েক মাসে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সংঘটিত ১০ খুনের ঘটনার বেশিরভাগে কিশোর গ্যাং জড়িত। আর রাজধানীতে গত ১০ বছরে কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধে ৮৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। সারা দেশে ২৩৭টি কিশোর গ্যাং রয়েছে, যার সদস্য সংখ্যা দুই সহস্রাধিক।
কিশোর অপরাধ বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ঘটনা হলেও অন্য অনেক দেশে বেশ পুরোনো। ১৯৩০-এর দশকে আমেরিকা, ব্রিটেনসহ ইউরোপের দেশগুলোতে কিশোর অপরাধ বাড়তে থাকে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি আরো ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। এর কারণ ছিল কিশোর শ্রম বৃদ্ধি, স্কুল বন্ধ হওয়া, পরিবারে ভাঙন প্রভৃতি। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিবেশ ইউরোপ ও আমেরিকার সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই কিশোর গ্যাং অপরাধ নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য খুব বেশি কঠিন নয়। এ কাজে অতীতে তারা নানা জায়গায় বেশ সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে; কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে এ অপরাধ সাময়িক নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও সমাজ থেকে এ অসুখ নির্মূলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন পারিবারিক সচেতনতা। একই সাথে সরকার, রাজনৈতিক শক্তি ও সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ কিশোর গ্যাং নির্মূলে নানা আঙ্গিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।