প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৮ নভেম্বর, ২০২৪
প্রথাগতভাবে দারিদ্র্যের আলোচনায় আয়-দারিদ্র্যই প্রাধান্য পায়; বিশ্লেষণাত্মক বিতর্ক ও পরিমাপেও। কিন্তু এ কথা আজ সর্বজনস্বীকৃত, দারিদ্র্যবিষয়টি একরৈখিক কিংবা একমাত্রিক নয়। আয়বহির্ভূত বিষয়গুলোতেও বঞ্চনা থাকতে পারে। যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, সুপেয় পানি কিংবা কর্মনিয়োজনে। আয়ের ঘাটতি সবসময় এসব বঞ্চনা প্রতিফলিত করতে পারে না।
যেমন একজন ব্যক্তি অত্যন্ত ধনশালী হতে পারেন। তিনি অশিক্ষিত হলেও আয়-দারিদ্র্যে দরিদ্র নন; কিন্তু শিক্ষা মাত্রিকতায় তিনি বঞ্চনার শিকার। কিন্তু কোনো মাত্রিকতায় বঞ্চনা সবচেয়ে তীব্র বা চরম, তা বস্তুনিষ্ঠ, অনপেক্ষভাবে নির্ধারণ করা যায় না- বিষয়টি আপেক্ষিক এবং সেই সঙ্গে মানসিকও বটে।
একেক মানুষের কাছে একেক ধরনের বঞ্চনা অগ্রাধিকার পাবে। এটিও মনে রাখা দরকার, মানব উন্নয়ন শুধু মানুষের বস্তুগত কুশলের ওপরে নির্ভর করে না; তার কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা, তার অংশগ্রহণের অধিকার, মানুষ-পরিবেশ ভারসাম্য ইত্যাদির ওপরেও নির্ভর করে। বস্তুগত কুশল অর্জন করার পরও মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নাও থাকতে পারে। অথবা ব্যক্তিগত কুশল অর্জনকারী মানুষকে যদি গাত্রবর্ণের কারণে বিভিন্ন সামাজিক স্থান বা অনুষ্ঠানে প্রবেশাধিকার দেয়া না হয়, তাহলে সে ঘাটতিও তার বঞ্চনা। সুতরাং, চূড়ান্ত বিচারে মানব-দারিদ্র্য একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক।
বহুমাত্রিক এ দারিদ্র্য পরিমাপে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি এবং অক্সফোর্ড দারিদ্র্য ও মানব উন্নয়নের যৌথ প্রচেষ্টায় বেশ কয়েক বছর আগে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক গঠিত হয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবনযাত্রার মানের ১১টি সূচক (পুষ্টি, বিদ্যালয়ে উপস্থিতি, সুপেয় পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি) নিয়ে সমন্বিত সূচক গড়ে উঠেছে। সূচকটি সম্পর্কে তিনটি পর্যবেক্ষণ প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত, সূচকটি দারিদ্র্য পরিমাপের একরৈখিক মানদ- নয়। যেহেতু বঞ্চনার অন্যান্য দিকও ধর্তব্যের মধ্যে আনে, তাই এটি বহুমাত্রিক। দ্বিতীয়ত, যদিও বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক আয়-দারিদ্র্যের তুলনায় একটি ব্যাপ্ত পরিমাপ। যেহেতু এই সূচকে আয় অন্তর্ভুক্ত নয়, সুতরাং এটি মূলত আয়বহির্ভূত দারিদ্র্যের ওপরেই নজর দেয়। ফলে আয়-দারিদ্র্যের আপাতন বুঝতে হলে আলাদা করে আয়-দারিদ্র্যের পরিমাপের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
তৃতীয়ত, বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক শুধু মানুষের বস্তুগত কুশলকেই আমলে আনে। কিন্তু মানুষের কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা, তার অংশগ্রহণের অধিকার, মানুষ-পরিবেশ ভারসাম্যের ব্যাপার সে সূচকের অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং এটি বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকের তাৎপর্যপূর্ণ সীমাবদ্ধতা। গত সপ্তাহে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকের ওপরে সাম্প্রতিকতম বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছে। বিভিন্ন সময়ের উপাত্ত নিয়ে বিশ্বের ১১২টি দেশের জন্য সূচকটি নির্মিত। বাংলাদেশও সেই সমীক্ষায় আছে; উপাত্তের সমীক্ষাকাল ২০১৯। সেই সমীক্ষাবর্ষের উপাত্তকে সম্মুখ প্রাক্কলনের মাধ্যমে ২০২২ সালের উপাত্ত গড়ে তোলা হয়েছে। প্রতিবেদন ফলাফলে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৬৩০ কোটির মধ্যে ১১০ কোটি মানুষ (১৭ শতাংশ) বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। এই বহুমাত্রিক দরিদ্র মানুষের ৯৬ কোটি (৮৪ শতাংশ) আবার গ্রামে বাস করে। অন্যদিকে বহুমাত্রিক দরিদ্রদের মধ্যে অর্ধেক সংখ্যকই শিশু-কিশোর। অর্থাৎ প্রায় ৫৪ কোটি শিশু-কিশোর বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। সুতরাং বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের তাৎপর্যপূর্ণ গ্রামীণ ও তারুণ্য মাত্রিকতা আছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট ফলাফলের দিকে তাকালে দেখি, বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের আপাতন ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ এদেশে প্রতি চারজনে একজন বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। সামগ্রিক সংখ্যার দিক থেকে ২০২২ সালে দেশের ৪ কোটি ১৭ লাখ লোক বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে বসবাস করেছিল। এ দেশের সাত শতাংশ লোক চরম বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে আক্রান্ত। ১৮ শতাংশ লোক বহুমাত্রিক দারিদ্র্য-নাজুক; যারা এখনও বহুমাত্রিক দরিদ্র নয়, কিন্তু সংকট ঘটলে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য-ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা আছে।
বাংলাদেশের বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের ৪৫ শতাংশই জীবনযাত্রার মানের বঞ্চনা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। শিক্ষা-বঞ্চনা সামগ্রিক বঞ্চনার ৩৮ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য বঞ্চনা ১৭ শতাংশে অবদান রাখে। সুতরাং বহুমাত্রিক দারিদ্র্য হ্রাসে শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মানে জোর দিতে হবে। বহুমাত্রিক দারিদ্র্যকে যদি এ দেশের আয়-দারিদ্র্যের সঙ্গে তুলনা করি, বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের আপাতন যেখানে ২৫ শতাংশ, সেখানে আয়-দারিদ্র্যের আপাতন ১৯ শতাংশ (জাতীয় দারিদ্র্য রেখা অনুসারে)। অর্থাৎ বাংলাদেশে যত লোক আয়-দরিদ্র, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ বহুমাত্রিক দরিদ্র। সুতরাং আয়ের ঘাটতি দিয়ে এ দেশের মানুষের সব বঞ্চনাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। বিশ্বব্যাংকের চরম আয়-দারিদ্র্যের নির্ণায়কে (ক্রয়ক্ষমতার সমতাভিত্তিক দিনপ্রতি দণন দশমিক ১৫ ডলার পরিমাপে) বাংলাদেশের পাঁচ শতাংশ লোক চরম আয়-দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। যেহেতু এ দেশের সাত শতাংশ লোক চরম বহুমাত্রিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, এটি পরিষ্কার- চরমভাবে দরিদ্র মানুষের মধ্যে আয়ের বঞ্চনার চেয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার বঞ্চনাই বেশি তীব্র।
বহুমাত্রিক দারিদ্র্য বিষয়ে বাংলাদেশে দুটি সমীক্ষা হয়েছিল ২০১৪ ও ২০১৯ সালে। সময়ের ধারাবাহিকতায় বিচার করলে দেখা যায়, ওই পাঁচ বছরে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের আপাতন ৩৮ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশ কমেছে। সামগ্রিক সংখ্যার দিক থেকে ২০১৪ সালে যেখানে প্রায় ছয় কোটি লোক বহুমাত্রিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, পাঁচ বছর পরে ২০১৯ সালে সেটি চার কোটিতে নেমে আসে।
আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে যদি দেখি, বাংলাদেশের বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক মোটামুটিভাবে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের সঙ্গে তুলনীয়। বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ মানুষ যেখানে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে বাস করে, দক্ষিণ এশিয়ায় তা ২১ শতাংশ। চরম বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের আপাতন বাংলাদেশে যেখানে ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশ, দক্ষিণ এশিয়ায় তা ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় বহুমাত্রিক দারিদ্র্য-নাজুক মানুষের হার সমান- ১৮ শতাংশ। সুতরাং বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার চেয়ে খারাপ নয়।
বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়াতেও জীবনযাত্রার মান ও শিক্ষার বঞ্চনা বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের তিন-পঞ্চমাংশ ব্যাখ্যা করতে পারে। তবে আয়-দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক অবস্থান থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে। তাই আয়-দারিদ্র্যের আপাতন দক্ষিণ এশিয়ায় ২৩ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে ১৮ শতাংশ; আঞ্চলিক চরম আয়-দারিদ্র্যের আপাতন যেখানে ১১ শতাংশ, বাংলাদেশে তা পাঁচ শতাংশ।
বাংলাদেশে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য হ্রাসে পাঁচটি বিষয় অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রথমত, যেহেতু বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের ৮০ শতাংশের বেশির ভাগ জীবনযাত্রার মান ও শিক্ষার বঞ্চনা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, তাই বহুমাত্রিক দারিদ্র্য দূরীকরণ নীতিমালায় এগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যেমন জীবনযাত্রার মানের ব্যাপারে সুপেয় পানি, বিদ্যুৎ, গৃহ-সংস্থানকে প্রাধান্য দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রবৃদ্ধির প্রকৃতি ও প্রক্রিয়া এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালাকে সাম্যভিত্তিক, দরিদ্রবান্ধব ও পরিবেশ-সংবেদনশীল হতে হবে। তৃতীয়ত, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যমুখী হতে হবে। চতুর্থত, উপাত্ত সংগ্রহের কাজ আরো সংহত করতে হবে। উপাত্ত কাঠামোকে আরো মজবুত করতে সম্পদ আহরণ ও অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পঞ্চমত, বহুমাত্রিক দারিদ্র্য নিরসনে সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। মানবিক সহায়তা প্রদান ও দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রচেষ্টা এ প্রয়াসের অংশ হবে। এর মাধ্যমে বজায়যোগ্য অগ্রগতির পথ সুগম হবে।
বৈশ্বিক সম্প্রদায়কেও একত্রে কাজ করতে হবে, যাতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার মানুষের জন্য মুক্তির পথযাত্রা তৈরি করে দেয়া যায়। দেখতে হবে যাতে দারিদ্র্য নিরসন পথযাত্রায় কোনো মানুষই পেছনে পড়ে না থাকে।
ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।
