সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের আড়াইশ’ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেছিল আরেকবার। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড চার বছর ক্ষমতায় থাকার পর ১৮৮৮ সালে হেরে যান। ঠিক চার বছর পর ১৮৯২ সালে আবার নির্বাচনে জিতে তিনি হোয়াইট হাউজে ফেরেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাত ধরে ১৩২ বছর পর সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখাল যুক্তরাষ্ট্র। ২০২০ সালে জো বাইডেনের কাছে হেরে হোয়াইট হাউজ ছাড়তে হয়েছিল ট্রাম্পকে। চার বছর পর আবার বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে তিনি ফিরছেন ওয়াশিংটনে ক্ষমতার মসনদে। নিজের বিজয়ের ব্যাপারে প্রথম থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন এই প্রেসিডেন্ট। বয়স যে কোনো বাধা নয়, আশির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সেটাই আবারো প্রমাণ করলেন।
মার্কিন মুলুকের নির্বাচন মানেই বিশ্বের সব হিসাব নিকাশের ওলট-পালট হওয়া। সব জরিপ-টরিপ যে আসলে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারে না সেটাও প্রমাণিত হয়েছে।
এমনকি জোতিষীদের আগাম বাণীও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন- স্লোগান নিয়ে প্রথমবার তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। তারপর পরাজিত হন বাইডেনের কাছে। তারপর ফলাফল মেনে না নেয়া এবং ক্যাপিট্যাল হিলে তাণ্ডব যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। তিনি এমন এক সময় ক্ষমতায় এসেছেন যখন বিশ্বজুড়ে চলছে যুদ্ধের দামামা। এমনকি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও ঘরের দরজায় কড়া নাড়ছে। একটু এদিক সেদিক হলেই বা সিদ্ধান্তে কোনো ভুল হলেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংস অনিবার্য পৃথিবীর। যদিও ট্রাম্পের আগে অনেকবারই উচ্চারণ করেছেন তিনি ক্ষমতায় থাকলে যুদ্ধ বন্ধ হতো। বিজয়ী ভাষণে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ক্ষমতায় এলে তিনি কোনো যুদ্ধ শুরু করবেন না; বরং যুদ্ধ থামাবেন। অর্থনীতি আর অভিবাসনকে ‘ট্রাম্প কার্ড’ করেই এবার নির্বাচনি প্রচার চালিয়েছেন ট্রাম্প। নির্বাচনের ফলাফলেও তারই প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
প্রশ্ন অনেক। সম্ভাবনাও অনেক। ইউক্রেনের সাথে যে রাশিয়ার যুদ্ধ চলমান রয়েছে সেটি কোন দিকে মোড় নিবে। কারণ বাইডেন প্রশাসন এতদিন ইউক্রেনকে আর্থিক এবং অস্ত্র সব দিক থেকে সাহায্য করেছে। এখন সেই নীতির কি হবে? এখনও কি ইউক্রেনকে সাহায্য অব্যাহত রাখবে না যুদ্ধ বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিবেন? মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের হিসাব নিকাশ রয়েছে সবচেয়ে আগে। ইসরায়েলের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব গভীর। ট্রাম্পের সময়েও এর কোনো ব্যতিক্রম হবে না। সেক্ষেত্রে ইরানকে ট্রাম্প কীভাবে সামলাবেন সেটাও প্রশ্ন। প্রথম মেয়াদে জলবায়ু ইস্যুকে ট্রাম্পের পাস কাটানো ছিল অন্যতম আলোচিত বিষয়। এবং পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তার প্রথম মেয়াদেই। ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তির বিষয়টি এখনো অমিমাংসীত রয়েছে। এবং সামনেই কপ-২৯ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
এবার জলবায়ু তহবিলে যুক্তরাষ্ট্র কি ভূমিকা পালন করবে বা পৃথিবীকে জীবাশ্ম জ্বালানিমুক্ত করতে কতটুকু এগিয়ে আসবে সেটাও প্রশ্নের মুখে। জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমনের মতো ইস্যুতে তিনি খুব গুরুত্ব দেননি। ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ পছন্দ করে সম্ভবত ট্রাম্পের এই আমেরিকা ফার্ষ্ট নীতিতে জোর দেওয়ার কারণেই। এছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক বিশেষত চীনের সাথে সম্পর্ক কেমন হবে সেটাও নির্ভর করছে। প্রথম মেয়াদের পুরোটা সময় ধরেই চীনের সাথে কেটেছে বাণিজ্য যুদ্ধে। সেসময় বাণিজ্য যুদ্ধ ছিল আলোচনায়। এ নিয়ে উত্তেজনাও কম হয়নি। আবার উভয় দেশের সম্পর্ক একেবারে খারাপ পরিস্থিতিতেও পৌছেছিল। এ কথা তো প্রশ্নাতীত যে ট্রাম্প গত মেয়াদে যে পৃথিবীতে এই আমেরিকাকে রেখে গিয়েছিলেন এখন সেই পৃথিবী অনেকটাই বদলেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রও।
কারণ এর মধ্যেই পৃথিবী করোনা ভাইরাস নামের এক মহামারি পাড়ি দিয়েছে। যার আঁচ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বাদ যায়নি। তারপর রাশিয়ার ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পর থেকে যে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে তা পৃথিবীকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে সে কেউ বলতে পারে না।
এছাড়াও দেশে দেশে নির্বাচন হয়েছে। রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন যেমন বিশ্বের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল সেভাবেই বিশ্বের পরিস্থিতিও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নিঃসন্দেহে গত কয়েক দশক থেকে বর্তমানের পরিস্থিতি ভিন্ন। চীন ও রাশিয়ার সাথে প্রতিযোগিতা, নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখা, করোনা ও যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিও দুঃসময়ে, বেকারত্ব প্রভৃতি নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমেরিকার। তবে আমেরিকার আভ্যন্তরীণ নীতিতে খুব বেশি পরিবর্তন আসে না সে প্রেসিডেন্ট যেই হোক না কেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে পুরোদমে। যা থামার কোনো লক্ষণ নেই। এই যুদ্ধ ইউক্রেন করলেও প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি প্র্যাস্টিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও ট্রাম্প একসময় বলেছিলেন, আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র বিদেশে কোনো যুদ্ধ করবে না। কোনো মার্কিন সেনাকেও আর যুদ্ধের জন্য বিদেশে পাঠানো হবে না। এখন দেখার বিষয় আদৌ সেটা করেন কি না। কারণ সেটি করতে হলে এই যুদ্ধ থামাতে হবে। যুদ্ধ না থামিয়ে ইউক্রেনকে সাহায্যও বন্ধ করলে বড় বিপদে পড়বে ইউক্রেন।
তিনি গাজা সংঘাত নিয়েও সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শাসনামলে যতগুলো আন্তর্জাতিক সংকটে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, সেসবের প্রত্যেকটির সমাধান করবেন তিনি এবং এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেবেন ইউক্রেন। প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তিগুলোর সাথে কূটনৈতিক দক্ষতায় এগিয়ে থাকা এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণে আমেরিকার ভূমিকা শক্তিশালী করার নীতিও আগামী নির্বাচনে ফ্যাক্ট হয়ে কাজ করবে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সেক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের একাধীপত্য প্রশ্নের মুখে। বিশ্ব খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এখন বিশ্ব বহুমুখী ব্যবস্থায় অগ্রসর হচ্ছে। কোনো দেশ একক কোনো দেশের কতৃত্বের বদলে একাধিক দেশের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। সেক্ষেত্রে একসময় দ্বন্দ্ব থাকলেও তারা এখন পারস্পরিক সহযোগীতার সম্পর্ক গড়ে তুলছে। একদিকে রয়েছে মৌলিক কিছু বিষয়ে দ্বন্দ্ব আবার অন্যদিকে রয়েছে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঐকমত্য। এভাবেই এগিয়ে চলেছে বিশ্ব। সেই বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার রাখতে হবে।
নির্বাচনে ট্রাম্প জয়ী হলে যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের চীন নীতিতেও পরিবর্তন আসতে পারে। যদিও সেটা সামান্যই। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রই থাকে। গণমাধ্যমের সংবাদ অনুসারে, ট্রাম্প নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর যে, চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে বোদ্ধাদের নতুন করে ভাবতে হবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, ডোনাল্ড ট্রাম্প এরই মধ্যে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন, যা নতুন করে আরো একটি বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা করতে পারে। তিনি মার্কিন রিয়েল এস্টেট ও অবকাঠামো খাত, বিশেষ করে শক্তি ও প্রযুক্তি খাতে চীনা মালিকানা লাভের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চান। তাইওয়ান সম্পর্কেও ট্রাম্প তার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন আমেরিকান ও তাইওয়ানি কূটনীতিকদের মধ্যে সম্পর্ক বাড়িয়েছিলেন, যা চীনের ক্ষোভের কারণ হয়েছিল। তাইওয়ান আক্রান্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে হস্তক্ষেপ করবে কি না-এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে গত বছর ট্রাম্প এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। আরো বেশি কিছু বিষয়ই রয়েছে ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার পর যা পরিবর্তন হবে বা হতে পারে বলেই অনুমান করছেন বিশেষজ্ঞগণ। বিশেষত ইন্দো প্যাসিফিক ইস্যুতে ট্রাম্পের অবস্থান এবং মিত্রদের সাথে কৌশল নির্ধারণেও ভাবতে হবে। এর আগে দেখা গেছে, ট্রাম্প বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় নিয়ে অসন্তুষ্ট এবং মিত্রদের ওপর তার কিছুটা দিয়েছেন। এমনকি ন্যাটো নিয়েও ট্রাম্পের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে। দেখা যাক কোন নীতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে এগিয়ে নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট