ঢাকা ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গ্রামবাংলার আর্থসামাজিক রূপান্তর

আব্দুল বায়েস
গ্রামবাংলার আর্থসামাজিক রূপান্তর

পা ফেলেই যেন ধাঁধায় পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। কৈশোরে পাঠ্যপুস্তকে পড়া কিংবা বহু যুগ আগের দেখা গ্রাম আর বর্তমান গ্রামের মধ্যে পার্থক্য পর্বতসম। এ গ্রাম তো ঠিক সেই গ্রাম নয়। পানির কলকল ধ্বনি, বর্ষার জলে টইটম্বুর নদী ও পুকুর, পাখির কলরব, সারি সারি ছনের ঘর, কুপির টিমটিমে আলো আজকাল চোখ পড়ে না বললেই চলে। ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’ এখন ভরাট হয়ে সোজাসুজি চলছে। ধুলাবালিতে গড়াগড়ি, গাছের ডাল থেকে দুঃসাহসিক লাফ, পুকুরে দাপাদাপি ও পানির খেলায় মেতে ওঠার ‘মহোৎসব’ আগের মতো নেই; ঐতিহ্যবাহী হাডুডু, গোল্লাছুট এমনকি এক্কা-দোক্কা খেলা আধুনিকতার ধাক্কায় যেন কুপোকাত। পতিত জমিতে পাজামা, পাঞ্জাবি এবং টুপি পরা মাদ্রাসার ছাত্র কিংবা খালি গায়ে একদল শিশু ক্রিকেট খেলছে। গ্রাম থেকে ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে যাত্রা, পালা, জারিগান ও পুথিপাঠ। আর নেবেই না কেন! আজকাল টিভি ও মোবাইল ফোন উপহার দিচ্ছে ডিসকো গান ও ধুমধাড়াক্কা সিনেমা এবং সম্ভবত সেই আফসোস থেকে এ গান গাওয়া- ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম/আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।/গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান/মিলিয়া জারিগান আর মুর্শিদি গাইতাম...।’

স্বাধীনতার শুরুতে কষ্টেসৃষ্টে এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে বড়জোড় উপজেলা সদর পর্যন্ত যাওয়া যেত; এখন পিচঢালা মসৃণ পথে মোটরগাড়িতে বেশ কিছু গ্রামে সরাসরি যাওয়া যায়- চাই কি বাড়ির আঙিনায়। ছনের ঘরের সংখ্যা ব্যাপক কমে আসছে আর কুপির বাতি বিদায়ের প্রহর গুনছে। এমনকি অতীতের মতো নাকে-মুখে রুমাল গুঁজে গ্রামে ঢুকতে হয় না। প্রতিটি গ্রামের ৬০-৭০ শতাংশ ঘরে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা এবং প্রায় প্রতিটি ঘরের জন্য সুপেয় পানির বন্দোবস্ত আছে। বসতবাটি যথাসম্ভব পরিচ্ছন্ন রাখার একটা তাগিদ আমাদের চোখ এড়াল না।

‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’ এমন পরিবেশ যেন সবার কাম্য। অনেক থানায় বিদ্যুৎ সংযোগ এসে গেছে এবং সেই সূত্রে টিভি ও ফ্রিজ। অপেক্ষাকৃত সচ্ছলদের ঘরে রঙিন টিভি ও দামি ফার্নিচার। যেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে পারেনি ( যেমন চরাঞ্চল ও দুর্গম গ্রাম) সেখানে সোলার প্যানেল লাগিয়ে দুধের সাধ ঘোলে মেটাবার প্রাণান্ত প্রচেষ্টাও লক্ষণীয়। তবে টিভি ও ডিশ উন্নত জীবনমানের বাহক হলেও অভিযোগ আছে, সিনেমা, নাটক ও সিরিয়াল কিশোর-কিশোরীদের খোলা মাঠের খেলা কেড়ে নিচ্ছে। টিভির দোষ দিয়েই বা লাভ কী? গ্রামের ঐতিহ্যবাহী খেলার জায়গাগুলোয় গড়ে উঠেছে বসতি, নার্সারি কিংবা ফসলের আবাদ। ‘একশ বিঘার মাঠটাই এই গ্রামের একমাত্র সম্বল’- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেখা সেই গ্রাম আজকাল কেউ দুরবিন দিয়েও খুঁজে পাবে বলে মনে হয় না। ইদানীং গ্রামে নাটক খুব একটা হয় না তবে গ্রামের জীবন নানা নাটকীয়তায় ভরা। চলুন তাহলে এমন এমন কয়েকটি নাটকীয় ঘটনার কথা শুনি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে এবং অব্যবহিত পরে দোকান বলতে গ্রামের কোনো ছোট একটা ঘরে চাল, ডাল, নুন আর তেলের পসরা। অথচ ইদানীং গ্রামগুলোয় গড়পড়তা চার-পাঁচটি দোকান এবং সেই সঙ্গে কোথাও টিভি ও ফ্রিজ। চা, চানাচুর, চিপস, সাবান ও প্রসাধনি, আইসক্রিম, কোমল পানীয় এমনকি প্রক্রিয়াজাত মসলা দেদার বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় হাটবাজারের অবস্থা আরও উন্নত এবং শহরের প্রায় সব দ্রব্য ওইসব দোকানে পাওয়া যায়। নাটকীয়তা এসে গেছে দরিদ্রের জীবনেও। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর একদা যে দিনমজুর সন্ধ্যার পরপর বিছানায় গা এলিয়ে দিত সে এখন চা, পান ও সিগারেট সঙ্গে করে মধ্যরাত পর্যন্ত গ্রামের বা হাটের দোকানে টিভির সামনে বসে থাকে। কোথাও আবার দোকানের এক কোণে ক্যারম বোর্ড পাতা আছে। মাঝে মাঝে দিনমজুর, যুবক শ্রেণি ও বেকার পয়সার বিনিময়ে খেলে কিংবা অন্যের খেলা প্রাণভরে উপভোগ করে।

রোনালদো, নেইমার, মেসি, শচীন টেন্ডুলকার এখন গ্রামে খুব পরিচিত নাম; খুব দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরাও তরতর করে নাম বলে যেন ওরা ওদেরই সহপাঠী। এমনি আগের অচেনা, অজানা পুরো বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ এখন গ্রামে থাকা ওই ছোট দোকানঘরটিতে এক নিমেষে উপস্থিত হয়। সুতরাং কে বলবে এ গ্রাম সে-ই গ্রাম? স্বভাবতই রবীন্দ্র, শরৎ যুগ এমনকি সত্তরের দশকের গ্রাম-ভাবনা নিয়ে বসে থাকলে হতাশ হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তবে অনুমান করতে কষ্ট হলো না যে, শহরভিত্তিক উন্নয়নের ছিটেফোঁটা রাস্তাঘাট ও বাজারের বদৌলতে গ্রাম-গ্রামান্তর উপচে পড়ছে (ট্রিকল ডাউন প্রভাব!); এককালের বিচ্ছিন্ন ও বিযুক্ত গ্রাম শহরের কিঞ্চিৎ রূপ ধারণ করে চলেছে। এ সংযুক্তির সুযোগে খোলা জানালা দিয়ে যেমন নির্মল বায়ু প্রবেশ করছে. তেমন ঢুকছে মশামাছি।

তিন : গ্রামের এ আর্থসামাজিক রূপান্তর গল্পের নায়কের নাম ‘নয়া ধান’, যা সচরাচর সুধীসমাজে ‘সবুজ বিপ্লব’ হিসেবে পরিচিত। বিশেষত সেচের সুবিধা আছে এমন অঞ্চলের গ্রামগুলোয় জমি, লিঙ্গ ও শিক্ষা ভেদে আবালবৃদ্ধবনিতা উফশী (উচ্চফলনশীল) বা নয়া ধানের জয়গান ও উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় পঞ্চমুখ। প্রতি বিঘায় ধান ওঠে ২০-৩০ মণ, ৬-৭ মণের জায়গায়। উচ্চফলনশীল থেকে হাইব্রিড ধান ‘হাইওয়ে টু ফুড সিকিউরিটি’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। হাইব্রিড ধানের চাল মোটা ও ভাত স্বাদহীন- নিন্দুকের এমনতর মনমরা মন্তব্য কৃষক এক কান দিয়ে শোনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। ‘নিন্দুকের কথায় গুলি মারি- বিঘাপ্রতি ৩০ মণ ধান কি যা-তা কথা!’ সুতরাং ভিক্ষার চাল কাঁড়া আর আকাঁড়া অর্থাৎ, পেটে দে মা খেয়ে বাঁচি এই হলো বর্তমান অবস্থা। কৃষক এও জানে, একসময় চীন থেকে হাইব্রিড বীজ আসত বলে ভয়ে মনটা চিনচিনে ছিল; এখন বাংলাদেশেই হাইব্রিড বীজ উৎপন্ন হয় এবং এর বাজারও ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে। সুতরাং নো চিন্তা ডু হাইব্রিড। এমনি করে একসময় ম্যালথুসিয়ান দুঃস্বপ্নের দুয়ারে এবং দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি থাকা গ্রামগুলো তীব্র খাদ্য সংকট থেকে বেরুবার পথ খুঁজে পেয়ে এখন ‘আউট অব দ্য শ্যাডো অব ফেমিন!’ অতএব, নায়করাজ নয়াধান নমস্য। আর্থসামাজিক রূপান্তরের আরও গল্পই আছে। তবে ইদানীং খাদ্য নিরাপত্তাজনিত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসা পুষ্টিহীনতা নিয়ে গ্রামবাসীর যুক্তি অনেকটা এ রকম : একসময় পেট পুরে ভাত খাওয়া ছিল প্রথম প্রার্থনা; পুষ্টি তথা ভারসাম্য খাদ্য তালিকা তখন বিলাসিতামাত্র। সময়ের বিবর্তনে ভাতের অভাব কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে বলে আজকাল ভাতের থালায় যৎকিঞ্চিৎ মাছ, ডাল, শাকসবজি এমনকি কালেভদ্রে মাংস ও ডিম থাকে। গ্রামের মানুষ খুব সোজা সরল প্রকৃতির যারা খাদ্য নিরাপত্তার খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামায় না। শুধু এটুকু বোঝে, নায়করাজ উফশী ধান বা হাইব্রিড তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছে। সুতরাং তোরা যে যা ভাবিস ভাই, আমরা অন্তত না খেয়ে নাই।

চার : সিনেমা কিংবা নাটকে নায়ক একা লড়াই করে না- হোক তা নায়িকাকে কাছে পাওয়া, কোনো বস্তি দখলমুক্ত করা কিংবা অপহৃত শিশুকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার কাজে। নায়কের পাশে থেকে শক্তি জোগায় এক বা একাধিক পার্শ্বনায়ক। নায়ক সবুজ বিপ্লবের পার্শ্বনায়ক হচ্ছে অবকাঠামো যথা পাকা রাস্তা, সেতু, স্কুল, বিদ্যুৎ ও সেচ সুবিধা। আমাদের দেখা গ্রাম যে সুদূর অতীতের সেই গ্রাম নয়, তার অন্যতম প্রধান কারণ রাস্তাঘাট ও বিদ্যুৎ আসার ফলে গ্রামের চেহারা একদম পালটে গেছে। ‘কী অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী’, সম্ভবত ঠিক সেই অপরূপ রূপে পল্লীজননী আজকাল আর ধরা দেন না- সেকাল আর নাই। কালের অনেক পরিবর্তন ঘটিয়াছে। মাঠের বুক চিড়িয়া রেললাইন পড়িয়াছে। তার পাশে টেলিগ্রাফ তারের খুঁটির সারি। বিদ্যুৎ শক্তিবহ তারের লাইন। মেঠো পথ পাকা হইয়াছে। তাহার উপর দিয়া উর্ধ্বশ্বাসে মোটরবাস ছুটিতেছে। নদী বাঁধিয়া খাল কাটা হইয়াছে। লোকে হুক্কা ছাড়িয়া বিড়ি সিগারেট ধরিয়াছে। কাঁধে গামছা, পরনে খাটো কাপড়ের বদলে বড় বড় ছোকরারা জামা, লম্বা কাপড় পরিয়া সভ্য হইয়াছে।

ছ-আনা দশ-আনা ফ্যাশনে চুল ছাঁটিয়াছে। ভদ্র গৃহস্থের হাল-চাল বদলাইয়াছে। (তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রাইকমল)। কথিত পার্শ্বনায়ক রাস্তাঘাট পাকা, সুপ্রশস্ত ও সুবিন্যস্ত হওয়ার ফলে গ্রাম-শহর দূরত্ব দ্রুত হ্রাস পেয়েছে এবং বৃদ্ধি পেয়েছে অভিবাসন। এর ফলে উৎপাদন ও উপকরণ বিনিময় সহজ ও ব্যয়সাশ্রয়ী হতে পেরেছে; গ্রামে না হলে শহরে গিয়ে অন্নের সংস্থান করা যাচ্ছে; কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সম্প্রসারণ এমনকি এনজিওর উপস্থিতি ত্বরান্বিত হয়েছে। সুতরাং কেউ বলতেই পারে- এ কি কেবলই সড়ক! একটা নতুন জীবনেরো রাস্তা-সুখ আর সমৃদ্ধির। রাস্তা দিয়া তরিতরকারি যায়, এমনকি থানকুনি পাতা এখানে বনে বাদাড়ে আজন্ম জন্মায় কেউ ফিরিয়াও দেখে না, শহরে তাহাতেও পয়সা। ধীরে ধীরে গ্রামের সব বস্তুই শহরমুখী হয়। অধিক অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ে; গ্রাম-শহর দৌড়াদৌড়ি লেগে যায়। (শামসুদ্দিন আবুল কালাম, পথ জানা নেই)। নায়কের ওপর মহানায়ক থাকে। গ্রামের রূপান্তরের প্রধান রূপকার যে সরকার এ কথাটা প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে ধরা পড়ে। বলা যেতে পারে সরকার হচ্ছে ‘মহানায়ক’ কিংবা গ্রামীণ রূপান্তর নাটকের পরিচালক। সরকার না থাকলে নায়ক ও পার্শ্বনায়ক আদৌ কোনো ভূমিকা রাখতে পারত কি না কিংবা কতটুকু রাখতে পারত তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে এরা যে সরকার নামক পরিচালকের সৃষ্টি তা নিয়ে সন্দেহ নেই। রূপান্তরের কিংবা নতুন বাংলাদেশের ভার সরকারের ওপর ন্যস্ত করে জনগণ। কিন্তু বারে বারে প্রতারিতও হয়। তবু আশায় আশায় বুক বাঁধে।

অর্থনীতিবিদ ও সমাজ-বিশ্লেষক। সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত