ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন। যে জোয়ার আমরা তার প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা করেছিলাম, সেই জোয়ার দেখা গেল ট্রাম্পের পক্ষে। এ ফল ডেমোক্র্যাটদের জন্য একটি বিশাল ধাক্কাই বলা চলে। কারণ সব পূর্বাভাস পাশ কাটিয়ে কমলা হ্যারিসকে বড় ব্যবধানে পরাজিত করেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। রিপাবলিকান প্রার্থীর জয় বিশ্বের জন্য যে ধরনের বার্তা দিচ্ছে, বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। যুক্তরাষ্ট্র এতদিন যেভাবে পরিচালিত হতো, ট্রাম্পের নেতৃত্বে সেখানে বেশ পরিবর্তনই হয়তো আমরা দেখব।
আমেরিকার মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে এবং যারা বন্ধু নয় তাদের সঙ্গেও সম্পর্কে কেমন পরিবর্তন আসে, সেটিও দেখার বিষয়। অর্থনৈতিক দিক থেকে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে আগের মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্প নানা ট্যারিফ বা শুল্ক আরোপ করেছিলেন। চীন থেকে পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে আমদানির ক্ষেত্রে আরোপিত সেই শুল্ক বাইডেন প্রশাসনও চালু রেখেছিল। পুনরায় যখন ট্রাম্প আসছেন তখন এই শুল্ক যেমন কমতে পারে, তেমনি বাড়তেও পারে। নির্বাচনী প্রচারণায় শিকাগোর ইকোনমিক ক্লাবে ভক্তদের উদ্দেশে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, আমার দৃষ্টিতে, অভিধানে সবচেয়ে সুন্দর শব্দ হচ্ছে ‘ট্যারিফ।’ এই ট্যারিফ বাড়লে এর প্রভাব কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, সারা বিশ্বেই দেখা যাবে। যেমন গত মেয়াদে তিনি যখন স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক আরোপ করেন, তখন দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত ও কানাডার মতো অনেক বন্ধু দেশেও তার প্রভাব পড়ে। তিনি যদি ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে শুল্ক আরোপ করে দেন এবং এখন তাইওয়ানকেন্দ্রিক যে উত্তেজনা আছে, সেটি যদি বাড়তে থাকে তবে মেরুকরণ আরো বাড়বে। এতে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক আরো গভীর হবে। ফলে বিকল্প একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ার জন্য তারা খুব বেশি আগ্রহী হয়ে উঠবে। কাজেই সেখানে আরেকটি রাজনৈতিক মেরুকরণ দেখা যেতে পারে।
অর্থনৈতিকভাবে ট্রাম্প কেমন নীতি গ্রহণ করেন, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় সাহায্যকারী দেশ। ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি বিশ্বব্যাপী সহায়তা কমিয়ে দেন, তাতে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাহায্যও কমে যেতে পারে। তার মানে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জলবায়ু পরিবর্তনগত দিক থেকেও পরিবর্তন দেখা যেতে পারে।
অভিবাসন নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ। এ বিষয়ে তিনি বরাবরই শক্ত কথা বলে আসছেন। যদিও গোটা বিশ্ব থেকেই মানুষ অভিবাসী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাস করছে। সেখানে নিয়মিত তথা ডকুমেন্টেড অভিবাসী যেমন রয়েছে, তেমনি অনিয়মিত অভিবাসীর সংখ্যাও কম নয়। তিনি যদি অনিয়মিত অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেন, তার প্রভাব পড়বে বিশ্বব্যাপী।
মার্কিন অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ এসব মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। তারা বের হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের চাঙ্গা অর্থনীতিতে প্রভাব পড়তে পারে। নির্বাচনে জিতলে ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধের অঙ্গীকার করেছিলেন। বিজয় ভাষণেও তিনি বলেছেন, কোনো যুদ্ধ শুরু করবেন না; যুদ্ধ থামাবেন। এমনকি তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, এর আগে তিনি যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন নতুন করে যুদ্ধ বাধাননি। প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক থাকা উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নেও চেষ্টা চালান। তিনিই ছিলেন প্রথম ক্ষমতাসীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি উত্তর কোরীয় নেতা কিম জন উনের সঙ্গে সিঙ্গাপুরে ঐতিহাসিক এক বৈঠক করেন ও তার সঙ্গে করমর্দন করেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন সময় ক্ষমতায় আসছেন, যখন মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধও অনেক দূর বিস্তৃত। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের বাইরে ইরান ও লেবানন সরাসরি এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই যুদ্ধ তিনি থামাতে পারবেন কিনা কিংবা আদৌ থামাতে চাইবেন কিনা-তাও দেখতে হবে। এর আগে এক নিবন্ধে বলেছি, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। ব্যবসা-বাণিজ্য, ভূকৌশলগত ইত্যাদি দ্বিপক্ষীয় যে সম্পর্ক, তাতে খুব একটি ছেদ পড়বে বলে আমি মনে করি না। কারণ দুই দেশের পারস্পরিক বাণিজ্য অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই কম। এদিকে তিনি খুব একটা মনোযোগী হবেন বলে মনে হয় না। তবে ভূরাজনৈতিক কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিশ্চয়ই ট্রাম্প প্রশাসনের নজর থাকবে।
বাংলাদেশে এখন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ভালো কাজ করার চেষ্টা করছেন। সবাইকে নিয়ে তিনি রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা আশা করি, একটি টেকসই রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করে তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশকে নিয়ে যাওয়ার জন্য গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন।
বাংলাদেশের সফল গণতান্ত্রিক উত্তরণ যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা। বিশেষ করে, এ দেশ অস্থিতিশীল হোক, সেটি নিশ্চয়ই ট্রাম্প প্রশাসন চাইবে না। এটি সত্য, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বৈশ্বিক একটি ইমেজ আছে। তিনি যদি প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে পারেন, সেটি আরো ভালো হবে। তবে এটিও বলে রাখা ভালো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠান বা দেশকে বেশি গুরুত্ব দেয়। সেজন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশ কী করছে বা করবে, সেটিই সবাই দেখবে।
আঞ্চলিক স্বার্থগত দিক থেকে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ রয়েছে। ২০২২ সালে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বা আইপিএস কৌশল ঘোষণা করে বাইডেন প্রশাসন। সেখানে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এক অবাধ, মুক্ত, সংযুক্ত, সমৃদ্ধ এবং সুরক্ষিত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কথা ঘোষণা করেন। আমরা জানি, মূলত চীনের অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব ঠেকানোই এ কৌশলের মূল লক্ষ্য। সেজন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পও এ কৌশল বজায় রাখতে সচেষ্ট হবেন। আমাদের স্বার্থের আলোকে যার সঙ্গে যেভাবে সম্পর্ক রাখা দরকার সেভাবে কৌশল সাজাতে হবে।
আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত কিছু বিষয় আছে, যেখানে খুব একটি নড়চড় হয় না। অন্তত বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে অগ্রাধিকার, সেটি ডোনাল্ড ট্রাম্পও হয়তো বজায় রাখবেন। যুক্তরাষ্ট্র সবসময় বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ দেখতে চেয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনও সেটি চাইবে। এই লক্ষ্যে আমাদের যেসব উদ্যোগ রয়েছে এবং অন্তর্বর্তী সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো সফলভাবে সম্পন্ন করে একটি প্রগতিশীল ও টেকসই বাংলাদেশ গড়তে হবে। তাতে যুক্তরাষ্ট্রে যে সরকারই আসুক, আমাদের কোনো অসুবিধা নেই।