সেন্টমার্টিন আশা ও আশঙ্কা
মাসুমা হক প্রিয়াংকা
প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বঙ্গোপসাগর পৃথিবীর বৃহত্তম উপসাগর। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ভূ-রাজনীতিতে বঙ্গোপসাগর বিশ্বে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত গুরুত্বের কারণে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এই অঞ্চল। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। এটি বিশ্বের বৃহত্তম রপ্তানিকারক এবং দ্বিতীয় আমদানিকারক দেশ। চীনের বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ সমুদ্রপথে হয় এবং তার অধিকাংশ মালাক্কা প্রণালি দিয়েই হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চাইলেই চীনের মালাক্কা প্রণালি দিয়ে বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে পারে। চীন এই মালাক্কা সংকটের কারণে মালাক্কা প্রণালি এড়িয়ে বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক বাণিজ্যপথ সৃষ্টিতে তৎপর। এই লক্ষ্যে চীন মিয়ানমারের কাছ থেকে কোকো আইল্যান্ড লিজ নিয়েছে এবং কায়াকপায়ু গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তি করেছে। অন্যদিকে রাশিয়া নিজেকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। রাশিয়া থাইল্যান্ডের কাছে দাওয়েই দ্বীপে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, যেটি মিয়ানমারের সন্নিকটে। এদিকে ভারত বঙ্গোপসাগরের খুব কাছেই অবস্থিত। অথচ সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বঙ্গোপসাগরে কোনো ঘাঁটি নেই। ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত ‘দি ইন্টারেস্ট অব আমেরিকা ইন সি পাওয়ার’ গ্রন্থে মার্কিন নৌ কৌশলবিদ আলফ্রেড থায়ের মাহান লিখেছেন, ‘সমুদ্র যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তার পক্ষে পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।’ সুতরাং বঙ্গোপসাগরে রাশিয়া, চীন, ভারত তাদের আধিপত্য জোরদার করবে আর যুক্তরাষ্ট্র নীরবে চেয়ে দেখবে, এটা অসম্ভব ঘটনা। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে সেন্ট মার্টিন নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে ও মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম উপকূলের প্রায় ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদের মোহনায় বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন অবস্থিত। দ্বীপটির দৈর্ঘ্য ৯ ও প্রস্থ ০.৫ কিলোমিটার হওয়ায় অনেকেই ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, এই ছোট দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করা অসম্ভব। আসলেই কি দ্বীপটিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন অসম্ভব? সেন্ট মার্টিনের তিন দিকে ভিত্তি শিলা আছে, যেটা জোয়ারে তলিয়ে যায় এবং ভাটায় জেগে ওঠে। এগুলোকে প্রযুক্তির মাধ্যমে অনায়াসে ১৫ কিলোমিটারে রূপান্তর করা যায়। কৃত্রিমভাবে আধুনিক প্রযুক্তির দ্বারা ১৫ কিলোমিটার দ্বীপকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার বানানো সম্ভব। যার জ্বলন্ত উদাহরণ সংযুক্ত আরব আমিরাতে দেখা যায়। সংযুক্ত আরব আমিরাতে দুটি কৃত্রিম দ্বীপ দ্য পাম আইল্যান্ড ও ওয়ার্ল্ড আইল্যান্ড নির্মাণ করা হয়েছে। এমনকি সেখানে সুউচ্চ ভবনও স্থাপন করা হয়েছে। তাই আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে সেন্ট মার্টিনকে সামরিক ঘাঁটির উপযোগী করে তোলা পরাশক্তিগুলোর জন্য মোটেই কঠিন কাজ নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেন্ট মার্টিন নিয়ে সত্তরের দশকের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনও আগ্রহী ছিলেন। সম্প্রতি ইউএস নেভাল ইনস্টিটিউট একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে এবং সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী। অন্যদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এমন প্রচারণাও আছে যে সেন্ট মার্টিনে আমেরিকা ঘাঁটি গাড়তে নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই বিষয়ে তাঁর ওপর চাপের কথা বলেছিলেন। সেন্ট মার্টিনে ব্যাপক পর্যটকের উপস্থিতির কারণে সেখানে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার অভিযোগও নতুন নয়। সে জন্য সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ সম্প্রতি নেওয়া হয়েছিল। এ কারণেও সেন্ট মার্টিন নিয়ে কিছু গুজব ডালপালা বিস্তারের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। অনেকের মনেই জিজ্ঞাসা, সত্যি কি সেন্ট মার্টিন নিয়ে আমেরিকার কোনো গোপন পরিকল্পনা আছে? এই প্রেক্ষাপটে সরকারের উচিত এ বিষয়ে কোনো রাখঢাক না করে জনগণের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা এবং জনগণকে প্রকৃত ঘটনা ওয়াকিবহাল করা। কারণ, রাষ্ট্রীয় যেকোনো বিষয়ে তথ্য জানার অধিকার জনগণের আছে। তা ছাড়া সেন্ট মার্টিন একমাত্র প্রবালদ্বীপ হওয়ায় বাংলাদেশের জনগণের কাছে এটা আগ্রহের একটা স্থান। আবার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে স্থানটির স্পর্শকাতরতার বিষয়টিও উপেক্ষা করার মতো নয়। তাই সেন্টমার্টিন নিয়ে মানুষের মনে কোনো ধরনের সংশয় যাতে তৈরি না হয় সেদিকে নজর রাখা সরকারের কর্তব্য। আমাদের দেশ, দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে সরকারের পদক্ষেপগুলো আশাব্যঞ্জক হোক, সেটাই সবার কাম্য।
লেখক: সমাজকর্মী ও শিক্ষার্থী