ঢাকা ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কৃষি নিয়ে ভাবনা

এসএম চন্দন
কৃষি নিয়ে ভাবনা

বিকাল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। গ্রামের এক হাটে কৃষকের আনাগোনা, শোরগোল। ভ্যানে তুলে বস্তাবোঝাই আলু এনে আশানুরূপ দাম না পেয়ে হতাশ তারা। বলছিলেন, কৃষিকাজই বাদ দিয়ে দেবেন। তারা যে আলু বিক্রি করেন কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকায়, সেই আলুই ভোক্তার হাতে যায় ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। মাঝের এই মূল্য বৃদ্ধির পথ পাড়ি দিতে আলুকে পোহাতে হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের নানা কারসাজির ধকল। একটা সময় চোখ বন্ধ করে একজন কৃষকের চেহারা কল্পনা করলে মনের মধ্যে ছেঁড়া গেঞ্জি পরা, মাথায় মাথাল দেয়া একজন মানুষের মুখ ভেসে উঠত, যার চামড়া রোদে পুড়ে কালো হয়ে গেছে। কিন্তু যুগের বিবর্তনে এখন সেই চেহারা আর সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। এখন বিভিন্ন কর্পোরেট এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বীজ সরবরাহ আর নিজস্ব খামার গড়ে তুলে নিজেদের কৃষক বলে প্রচার করছে। ধানসহ কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণেও এখন সেসব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা মুখ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সেই দেশে খাদ্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে দিশাহারা জনগণ। দ্রব্যমূল্যের এই অসহনীয় অবস্থার কারণটাও অজানা। বিগত সরকার এবং ব্যবসায়ীরা প্রায় একই সুরে কথা বলেছে। কখনো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের খরচ বহন করার হাস্যরস তৈরি হয়েছে, কখনো মুদ্রাস্ফীতির অজুহাত, আবার কখনো বন্যা-খরা-করোনাসহ নানা কারণ। দিনের শেষে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের পকেট খালিই হয়েছে, সমাধানের স্থায়ী পথের দেখা মেলেনি। আলুর দাম এক বছর ধরে ৫৫-৬০ টাকা। অথচ এই সবজি বাংলাদেশেই প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়, বিদেশ থেকে আনা লাগে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, কৃষি অর্থবছর ২০২৩-২৪ সালে দেশের ৪ লাখ হেক্টর জমিতে ১০৬ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। বিগত প্রায় ১৬ বছর আলুর আবাদ অনেক বেড়ে যাওয়ায় সেটি রপ্তানির ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। তারপরও কেন আলুর দাম এত বেশি তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। এ কথা ঠিক যে বছর বছর কৃষি আবাদের খরচ বাড়ছে। সার, বীজ, ডিজেল, কীটনাশক, বালাইনাশকের দাম বাড়লে সমানুপাতিকভাবে পণ্য আবাদের ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়। যদিও সরকার সারের ওপর ভর্তুকি দেয়, তথাপি এর খরচ বেড়েছে। বাংলাদেশে সব ধরনের সার উৎপাদনের পরিমাণও পর্যাপ্ত নয়, তাই বিদেশ থেকে আমদানির খরচ আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আশানুরূপ না হওয়ায় খেতে পানি সেচের খরচ বেড়েছে। মোট কথা, কৃষির উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু তারপরও বাজারে পণ্যের যে দাম, সেটি কৃষকের হাতে পৌঁছায় না। বাজার নিয়ন্ত্রণে মূল বাধা বড় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট। এটি ভাঙা জরুরি। চালের দামের সঙ্গে ধানের দামের অসংগতি চোখে পড়ে প্রতিবছরই। ধান বিক্রির ক্ষেত্রে কৃষকের নানা বিড়ম্বনা রয়েছে। তারা সরকারি দামে সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে পারেন না, আবার ধানে কতটুকু পানি আছে (আর্দ্রতা) সেটাও বিবেচ্য বিষয়। সাধারণত ১৪ শতাংশের বেশি আর্দ্রতা থাকলে সেই ধান কেনা হয় না। ফলে কৃষক বাধ্য হয়ে ফড়িয়া-দালালদের কাছে ধান বিক্রি করেন। এসব মৌসুমি ব্যবসায়ী ধান বিক্রি করেন চালকলের কাছে। চালকলের মালিকরা আবার ঠিকই সরকারি গুদামে সরকারি দামেই চাল বিক্রি করেন। কয়েক বছর আগে নীলফামারীর এক কৃষক বলছিলেন, প্রতি বস্তা ধানে তাঁর ১০০ টাকা লোকসান হয়েছে। সেই বছরই ঠাকুরগাঁওয়ের এক চালকলমালিক জানালেন, তিনি সে বছর সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ করে সাড়ে তিন লাখ টাকা লাভ করেছেন। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, মূল উৎপাদক থাকছেন বঞ্চিত। ধান কিনতে হবে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে। ইউনিয়ন পর্যায়ে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার ব্যবস্থা করতে হবে। বোরো ধানের গ্রহণযোগ্য আর্দ্রতা ন্যূনতম ১৪ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা ও ধান শুকানোর যন্ত্রের ব্যবস্থা করে তা দিয়ে গুদামেই ধান শুকিয়ে নেওয়ার উদ্যোগও নেয়া দরকার।

পথে পথে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। এতে পণ্যের পরিবহন ব্যয় কমে আসবে। হাট-বাজারে খাজনা বা তোলা আদায়ের নামে ইজারাদারদের স্বেচ্ছাচারিতা ও জুলুমবাজি বন্ধ করতে হবে, হাটের খাজনা নির্ধারণে সমন্বয় করতে হবে। সেচকাজের জন্য সারা দেশের সব নদ-নদী খননের মাধ্যমে এই পানির ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। সেচকাজের বিদ্যুৎ এবং ডিজেলের দাম কমাতে হবে। প্রতি জেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক অথবা জেলা প্রশাসনের অধীনেই ‘কৃষি উৎপাদন ও বিপণনসংক্রান্ত সর্বদলীয় কমিটি’ গঠন করা যেতে পারে। সব কৃষক সংগঠন ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই কমিটির তত্ত্বাবধানেই কৃষি বাজার মনিটরিংয়ের কাজ করা সম্ভব হবে। সরকারি দলের প্রভাব না কমালে এই কমিটির কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। টমেটো দ্রুত পচনশীল একটি সবজি। জাতভেদে এটি ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে পচে যায়। তাই এর দ্রুত বাজারজাতকরণ জরুরি। কিন্তু বৃষ্টি-বাদলা বা পরিবহন সংকট, কিংবা পার করে আসা করোনার মতো কোনো মহামারি-অতিমারিতে সৃষ্ট জাতীয় দুর্যোগ পরিস্থিতিতে টমেটো ঘরে রাখা চাষির জন্য মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। সে কারণে এটি সংরক্ষণের জন্য হিমাগার থাকা দরকার। শুধু টমেটো নয়, পচনশীল সব ফসল সংরক্ষণের জন্য হিমাগার নির্মাণ করার উদ্যোগ নিতে হবে।

দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ৬টি বন্ধ থাকায় আখ চাষিদের ভাগ্যেও বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে।

আধুনিকায়নের মাধ্যমে বন্ধ চিনিকলগুলোও চালু করা জরুরি। কৃষি উপকরণ সরবরাহে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। মনে রাখা দরকার যে বাংলাদেশ এখনো কৃষিপ্রধান দেশ। বিগত করোনার সময় বিশ্বের বহু দেশ অর্থনীতিতে হোঁচট খেলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রেখেছিল এ দেশের অবারিত কৃষি খাত। সেই খাতটির সামগ্রিক উন্নয়ন না হলে, কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম নিশ্চিত করা না গেলে সার্বিক অর্থনীতির ওপরই সেটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত