ঢাকা ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গণতন্ত্রের স্বার্থে এ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে

গণতন্ত্রের স্বার্থে এ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে

গত শুক্রবার ঐতিহাসিক জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বিএনপি তার বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে নিয়ে এক শোভাযাত্রার আয়োজন করে। বিএনপির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার পথ পর্যন্ত এ শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। শোভাযাত্রার প্রাক্কালে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র থেমে নেই। এখনো চলছে। তিনি বলেছেন, স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণকে একটি বিষয় আবারও স্মরণ করিয়ে সতর্ক থাকতে অনুরোধ জানাতে চাই, আমি নিজেও সতর্ক থেকে বলতে চাই, গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র থেমে নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা দেশে-বিদেশে, শাসনে-প্রশাসনে এখনো সক্রিয়। ফলে গণতন্ত্রের স্বার্থে এ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে। আজকের এই মিছিল দেশের স্বার্থ রক্ষার মিছিল, নিজের ভোট প্রয়োগের অধিকার রক্ষার মিছিল। তারেক রহমানের এ বক্তব্য যথার্থ এবং সময়োপোযোগী। আমরাও বারবার বলেছি, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ষড়যন্ত্র থেমে নেই। অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ ও ফেলে দেয়ার জন্য হাসিনা ও তার প্রভু মোদি একের পর এক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে চলেছেন। জুডিশিয়ারি ক্যু, বিভিন্ন দাবির অজুহাতে পুলিশ ও জনপ্রশাসনে থাকা তার দোসরদের আন্দোলন, ১৫ আগস্ট রাজধানীতে পতিত আওয়ামী লীগের ১০ লাখ লোক সমাগম করে অচল করে দেয়ার আস্ফালন, হিন্দুদের দিয়ে আন্দোলন, আনসার বিদ্রোহ ইত্যাদি নানা ধরনের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত তারা করেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছে। তারা অরাজকতা সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারকে ব্যর্থ করে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলার হেন কোনো অপচেষ্টা নেই, যা করছে না। অন্তর্বর্তী সরকার সাফল্যের সাথে এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেছে এবং করছে।

ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার গণবিপ্লব কেন হয়েছিল? এর মূল লক্ষ্য কি ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর সবসময় আমাদের স্মরণে রাখতে এবং স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, শেখ হাসিনার নিষ্ঠুর শাসন থেকে দেশের মানুষকে মুক্ত এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। বিগত প্রায় ১৬ বছর দেশে কোনো গণতন্ত্র ছিল না। মানুষের ভোটাধিকার, মানবাধিকার, সুশাসন, ন্যায়বিচার, বাকস্বাধীনতা বলতে কিছু ছিল না। শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিজমের মাধ্যমে মানুষের সব মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন। জনগণকে দাসে পরিণত করে নির্মমভাবে জুলুম করেছেন। বছরের পর বছর ধরে নিষ্পেষণের শিকার ছাত্র-জনতা জীবন দিয়ে রক্তাক্ত বিপ্লবের মাধ্যমে তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছে। বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মাধ্যমে হাসিনার ফ্যাসিজমকে চিরতরে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। দেশের মানুষ এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণের পথ রচনা করে দিয়েছে। এ পথ যে সহজ নয়, তা ছাত্র-জনতা জানে। তারা অতন্দ্র প্রহরী হয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে আগলে রেখেছে। দেশের বৃহত্তম দল বিএনপি ও তার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ সরকারের সূচনালগ্ন থেকেই অকুণ্ঠ সমর্থন এবং কেন ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না, তা বারবার বলেছেন ও বলছেন। এতদসত্ত্বেও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা, তার প্রভু মোদি এবং তাদের দোসরদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। এ ষড়যন্ত্রের মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার এগিয়ে চলেছে। আমাদের মনে রাখা দরকার, ছাত্র-জনতার বিপ্লব পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, জনপ্রশাসন বা কোনো বাহিনীর দ্বারা হয়নি। বরং তারা ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে রক্ষা করতে ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করেছিল। সেনাবাহিনীও শুরুতে ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালিয়েছিল। পরে ছাত্র-জনতার পালস বুঝতে পেরে এ বাহিনী ছাত্র-জনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এক্ষেত্রে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিতে তাকে নিয়ে নানা গুঞ্জন-গুজব থাকলেও এখন পর্যন্ত তার অবস্থান সঠিক রয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। অন্যদিকে, সেনাবাহিনীর মধ্যে থাকা হাসিনার দোসরদের অপসারণ না করা নিয়েও তারা উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করছেন। এরইমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশ, জনপ্রশাসনসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ফ্যাসিস্টের দোসরদের অপসারণের মাধ্যমে সংস্কারের কাজ চলমান রয়েছে। পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশে সংস্কার হয়েছে। সেনাবাহিনীর মধ্যে এ ধরনের সংস্কার হয়নি বললেই চলে। এ ব্যাপারে সেনাপ্রাধানকে আরও সচেষ্ট ও সক্রিয় হওয়া উচিত বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। সম্প্রতি ভারতের সেনাপ্রধানের সাথে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের কী ধরনের কথা হয়েছে, তাও জনসম্মুখে প্রকাশ করা সময়ের দাবি বলে তারা মনে করেন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা, মোদি ও তার দোসররা ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় যারপরনাই খুশি। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের এক কর্মীর সাথে হাসিনার ফোনালাপে ট্রাম্পের ছবিসহ রাজধানীতে বেনামে গণজমায়েত ও পদযাত্রার কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে তার আভাস পাওয়া যায়। এ কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হলে তারা নিজেরাই ট্রাম্পের ছবি ছিঁড়ে ও ভিডিও করে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার হীন ষড়যন্ত্রের কথা উঠে এসেছে। এসব যে হাসিনাকে দিয়ে ভারত করাচ্ছে, তা জনগণের বুঝতে বাকি থাকে না। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকলে এসব ষড়যন্ত্রে কোনো কাজ হবে না। আগস্টের গণঅভ্যুত্থান তার প্রমাণ। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যকোনো দেশ বিপ্লব করে দেয়নি। ছাত্র-জনতাই করেছে। তখন ভারতের কোনো পদক্ষেপই হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে পারেনি। এখন যতই ষড়যন্ত্র হোক না কেন, তাতে কাজ হবে না। কারণ, জনগণ মাঠে ছিল, আছে এবং থাকবে। জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসে লাখ লাখ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে শোভাযাত্রার মাধ্যমে বিএনপি তা দেখিয়ে দিয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, অন্তর্বর্তী সরকারকে টিকিয়ে রাখা ও সমর্থন দেয়া একা বিএনপির দায়িত্ব নয়। জামায়াতে ইসলাম, জাতীয় পার্টি, বিভিন্ন ইসলামী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকেও ঐক্যবদ্ধ হয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে, যাতে ফ্যাসিস্ট হাসিনা, মোদি ও তার দোসরদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়া যায়। আমাদের মনে রাখা দরকার, ’৭৫ সালে সিপাহী-জনতার যে বিপ্লব হয়েছিল, তা নস্যাতে প্রতিবিপ্লবও হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সিপাহী-জনতার ঐক্যই সফল হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারকেও প্রতিবিপ্লবের ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যবদ্ধ থেকে সতর্ক থাকা অপরিহার্য।

ছাত্র-জনতার বিপ্লবের অন্যতম মূল আকাঙ্ক্ষা ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে উৎখাত করে দেশকে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করানো। এ যাত্রার পথপ্রদর্শক হয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আমরা চাই, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরেই দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্রের সূচনা হোক। মানুষের ভোটাধিকার, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, সুশাসন, বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত হোক। বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মত ও পথ যতই ভিন্ন হোক না কেন, জনগণের এই মৌলিক অধিকার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মতো কমন ইস্যুতে তাদের এক ও অভিন্ন থাকতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের হটকারিতা করা যাবে না। তাদের মনে রাখতে হবে, ছাত্র-জনতার চূড়ান্ত বিজয় এখনো হয়নি। তারা বিজয়পথ তৈরি করে দিয়েছে। চূড়ান্ত বিজয় সেদিনই হবে, যখন গণতন্ত্র ও জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। তারেক রহমান বারবারই এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে দেশের মানুষকে সচেতন ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন এবং তার দলকে সেভাবেই পরিচালিত করছেন। একইভাবে ফ্যাসিস্টবিরোধী সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যেও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার প্রভু মোদির ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় ইস্পাত কঠিন ঐক্য থাকতে হবে। তাদের মধ্যকার কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের সংঘাতের কারণে যাতে গণবিপ্লবের চেতনা হারিয়ে না যায়, এ ব্যাপারে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত