চলতি মাসের শুরুতেই তাবলিগ জামায়াতের একটি গ্রুপ মাওলানা জোবায়ের পন্থি ৫ তারিখ সোহরাওয়র্দী উদ্যানে বিশাল সমাবেশ করে। পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে এই সমাবেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেত, শাহবাগ পর্যন্তও ছড়িয়ে পড়ে। এই সমাবেশের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারিতে টঙ্গিতে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। তাদের দাবি এবার ইজতেমা দুটি নয়, একটি করতে হবে। মাওলানা সাদপন্থিদের কোনো আলাদা ইজতেমা করতে দেয়া হবে না এবং মাওলানা সাদকে ঢাকায় আনা যাবে না। পরের দিন জাতীয় প্রেসক্লাবে সাদপন্থিরাও একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। প্রায় হাজারে ওপরে অনুসারিরা পুরো প্রেসক্লাব ভর্তি করে ফেলে। বেশ কয়েক বছর ধরেই তাবলিগ জামাত দু’ভাগে বিভক্ত। এটি এমন আকার ধারন করেছে যে, প্রতিটি মসজিদেও দুভাগে বিভক্ত হয়ে দুু‘পন্থির অনুসারিরা তাদের ঈমান আমলের বয়ান করছেন। এতে সাধারণ মুুসল্লিরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ২০১৮ সালে দিল্লি থেকে মাওলানা সাদ ঢাকায় আসার পর জোবায়ের পন্থিরা পুরো এয়ারপোর্টের রাস্তায় বিক্ষোভ করেন। তখন পুলিশি পাহারায় মাওলানা সাদকে নিয়ে যাওয়া হয় কাকরাইল মসজিদে। এ বছর আবার মাওলানা জোবায়ের এবং সাদপন্থিদের পাল্টাপাল্টি হুমকি সরকারকে ভাবিয়ে তুলবে, বিব্রত করবে।
সাধারণ মানুষের প্রশ্ন তাবলিগ জামাতের দ্বন্দ্বের মূল কারণ কি? দিল্লির মাওলানা সাদকে নিয়ে বাংলাদেশে কেন তাবলিগে বিভাজন, বিতর্ক? বিভিন্ন দাওয়াত ও তাবলিগের সংকট যেসব কারণে প্রকট আকার ধারণ করে, তার অন্যতম হলো, মাওলানা সাদ সাহেব সেখানে ঐতিহ্যবাহী শুরা ভেঙে আমিরতন্ত্র কায়েম করেছেন। এ বিষয়ে তার একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি তোমাদের আমির। যে আমাকে আমির মানবে না, সে জাহান্নামে যাবে। আসলে এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি তাবলিগের মধ্যে পরিবারতন্ত্র ও আমিরতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছেন।
যদিও এ ঘটনার সূত্রপাত আরো বহু আগে। ১৯৬৫ সালে মাওলানা এনামুল হাসানকে আমির নির্বাচনের পর কিছু মেওয়াতি (ভারতে অবস্থিত তাবলিগের কেন্দ্রস্থল) ওই সময় বিরোধিতা করেন। তারা মাওলানা সাদের বাবা মাওলানা হারুনকে আমির বানানোর দাবি জানান। মেওয়াতিরা বেশিরভাগই অশিক্ষিত ও সহজ-সরল।
তারা দাবি করেন যে, তাবলিগের এ কাজ যেহেতু মাওলানা ইলিয়াস শুরু করেছেন, সুতরাং যোগ্য হোক অযোগ্য হোক, আমাদের এই বংশ থেকেই হতে হবে। পরে অবশ্য মাওলানা হারুন (রহ.) এনামুল হাসান (রহ.)-কে আমির হিসেবে মেনে নেন। কিন্তু ১৯৯৫ সালে এনামুল হাসান (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর ফিতনা অঙ্কুরিত হয় এবং মাওলানা জোবায়ের হাসান (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তা প্রকাশ্যরূপ লাভ করে।
ফিতনার আশঙ্কা মাথায় রেখেই মূলত এনামুল হাসান (রহ.) যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও নিজের একমাত্র ছেলে মাওলানা জোবায়েরুল হাসান (রহ.)-কে তার পরবর্তী আমির নির্বাচন না করে, সারা বিশ্বের এই কাজ সামলানোর জন্য তিন দেশের যোগ্যদের সমন্বয়ে ১০ জনের ‘শুরা’ (পরামর্শ বোর্ড) বানিয়ে যান। ওই ১০ জন সর্বপ্রথম যে পরামর্শসভায় বসেন, সেখানে এটাই সিদ্ধান্ত হয়, একক কোনো আমির নয়, তিনজনের ফয়সালায় নিজামুদ্দিন পরিচালিত হবে। আর নিজামুদ্দিনে বায়াত বন্ধ থাকবে। তিনজন হলেন- ১. মাওলানা ইজহারুল হাসান, ২. মাওলানা জোবায়েরুল হাসান ও ৩. মাওলানা সাদ। এভাবেই প্রায় ১৯ বছর হজরতজি (রহ.)-এর বানানো শুরা বিশ্ব তাবলিগের কাজ পরিচালনা করতে থাকে। অন্যদিকে হজরতজির বানানো শুরা কর্তৃক মনোনীত শুরা সদস্যরা নিজামুদ্দিনের পরিচালনাকার্য শুরু করার পর ১৯৯৬ সালে মাওলানা ইজহারুল হাসান (রহ.) ইন্তেকাল করেন। তার ইন্তেকালের পর ওই শূন্যপদ পূরণের জন্য বারবার চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু মাওলানা সাদ তা বাস্তবায়ন করতে দেননি।
২০১৪ সালে মাওলানা জোবায়েরুল হাসান ইন্তেকাল করেন। তার ইন্তেকালের পর কোনো পরামর্শের ব্যবস্থা না করে মাওলানা সাদ একক আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন। মেওয়াত থেকে তার অনুসারিদের নিজামুদ্দিন মারকাজে জড়ো করে রাখেন। তার একক কর্তৃত্বে কাজ করার জন্য নিজামুদ্দিনের মুরব্বিদের ওপর বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। এর ফলে ২০১৫ সালের আগস্টে দোয়ার পর মোসাফাহা করাকে কেন্দ্র করে নিজামুদ্দিন মারকাজে প্রথম হাঙ্গামা হয়। অতঃপর ২৩ আগস্ট নিজামুদ্দিন বস্তির তাবলিগের জিম্মাদার সঙ্গীদের সঙ্গে মাশওয়ারার কক্ষে মাওলানা সাদের বাগিবতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে ওই মজলিসে মাওলানা সাদ নিজেকে আমির দাবি করেন। এতে পুরো বিশ্বের শান্তিপ্রিয় তাবলিগের সাথিরা অশান্ত হয়ে ওঠেন।
এরপর কয়েকবার নিজামুদ্দিন মারকাজে মারধরের ঘটনা ঘটে। এমনকি একপর্যায়ে নিজামুদ্দিন মারকাজে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, সারা বিশ্বের হেদায়েতের মারকাজে পুলিশ অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করে এর আশু সমাধানকল্পে নিজামুদ্দিন মারকাজ, দারুল উলুম দেওবন্দ ও বিশ্বের অন্য মুরব্বিরা উদ্যোগী হন। অতঃপর ২০১৫ সালের নভেম্বরে রায়বেন্ড ইজতেমায় একত্রিত হয়ে নিজামুদ্দিনের মুরব্বিরা মারকাজের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন এবং হজরতজি ইনামুল হাসান (রহ.) কর্তৃক গঠিত শুরাকে পূর্ণাঙ্গ করার প্রস্তাব দেন। দীর্ঘ পর্যালোচনার পর বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে শুরা পূর্ণাঙ্গ করার ফয়সালা হয়।
অবশেষে ১৩ জনের শুরা গঠন করা হয়। কিন্তু মাওলানা সাদ শুরা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ভারত ফিরে যান। যারা মাওলানা সাদকে আমির মানবেন না, তিনি তাদের বলপ্রয়োগ করে নিজামুদ্দিন মারকাজ ত্যাগ করতে বাধ্য করেন। নিজামুদ্দিন মারকাজের যারা মূল দায়িত্বে ছিলেন, তারা প্রায় সবাই মারকাজ ছেড়ে চলে যান, যার মধ্যে মাওলানা সাদের শিক্ষকরাও রয়েছেন। একে একে সবাই দিল্লি মারকাজ ত্যাগ করার পর ঐহিত্যবাহী ‘শুরা’ ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়। শুরু হয় পরিবারতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র। এর জের ধরে বিশ্বব্যাপী তাবলিগ জামাত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
২. বর্তমানে দাওয়াত ও তাবলিগে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার অন্যতম কারণ হলো সাদ কান্ধলভি কোরআন-হাদিসবিরোধী মনগড়া বহু কথা প্রচার করেছেন। তার সেসব বক্তব্য থেকে এখানে কয়েকটি কথা তুলে ধরা হলো-
মসজিদের বাইরে হেদায়েত নেই : সাদ কান্ধলভি বলেন, ‘মসজিদে ঈমানের আসর কায়েম করা ফরজ। মসজিদের বাইরে অন্য কোথাও হেদায়েত পাওয়া যাবে না।’ (সূত্র : দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া : ১৫)।
মুসা (আ.)-এর ওপর অপবাদ : সাদ সাহেব বলেন, ‘মুসা আলাইহিস সালাম নিজের জাতির মধ্যে দাওয়াতের কাজ ছেড়ে আল্লাহতায়ালার সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্যে নির্জনবাসে চলে গিয়েছিলেন। যার ফলে ৫ লাখ ৮৮ হাজার বনি ইসরাইল গোমরাহ হয়ে যায় (মুরতাদ হয়ে যায়)।’ (সূত্র : দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া : ১৮)।
তাবলিগের ৬ নম্বরই প্রকৃত ইসলাম : সাদ সাহেব বলেন, ‘যে ব্যক্তি এই ৬ নম্বরকে পূর্ণ দ্বীন মনে করে না, সে হলো ওই ব্যবসায়ীর মতো, যে নিজেই নিজের দধিকে টক বলে বেড়ায়। এমন ব্যবসায়ী কখনো সফল হতে পারে না।’ (সূত্র : দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া : ১৭)।
ক্যামেরা মোবাইল পকেটে থাকলে নামাজ হবে না : তিনি বলেন, ‘আমার মতে ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল পকেটে রেখে নামাজ পড়লে নামাজ হবে না। ক্যামেরাযুক্ত মোবাইল থেকে দেখে দেখে কোরআন শোনা ও পড়া হারাম। এতে কোরআনের অবমাননা হয়। এর কারণে কোনো সওয়াব হবে না। যেসব আলেম তা বৈধ হওয়ার ফতোয়া দেন, তারা উলামায়ে সু।’ (সূত্র : দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া : ১৬) ।
না বুঝে কোরআন পড়লে লাভ নেই : তিনি বলেন, কোরআন বুঝে পড়া প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ওয়াজিব। না বুঝে কোরআন পড়ার কারণে কোনো লাভ হবে না। এমন লোকের ওয়াজিব তরকের গোনাহ হবে।’ (সূত্র : দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া : ১৭) তাঁর এই বক্তব্য মওদুদির বক্তব্যের প্রতিধ্বনি।
কোরআন পড়িয়ে অর্থ নেয়া হারাম : তিনি বলেন, ‘বিনিময় নিয়ে কোরআনে কারিম পড়া নোংরা নারীর বিনিময়ের মতো। নোংরা নারী তার আগে জান্নাতে যাবে।’ (সূত্র : দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া : ১৬)।
নিজামুদ্দিন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে ধর্মত্যাগের গোনাহ হবে : তিনি বলেন, ‘সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ঈমান আনয়নের পর মদিনা থেকে ফিরে নিজের এলাকায় যাওয়াকে ইরতিদাদ তথা ধর্মত্যাগ মনে করতেন। কাজেই নিজামুদ্দিন মারকাজ (তাবলিগের মূল কেন্দ্র) থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াকে সাধারণ বিষয় মনে কোরো না।’ (সূত্র : অব্যাহত বিভ্রান্তিকর বয়ান, পৃষ্ঠা ২৫) ।
আসহাবে কাহফের সঙ্গী কুকুর ছিল না : তিনি বলেন, ‘আসহাবে কাহফের সঙ্গী জন্তুটি কুকুর ছিল না; বাঘ ছিল।’ (সূত্র : অব্যাহত বিভ্রান্তিকর বয়ান, পৃষ্ঠা ৪৯) তার এ বক্তব্য পবিত্র কোরআনের সুরা কাহফের ১৮ নম্বর আয়াতবিরোধী।
নিজামুদ্দিন পৃথিবীর অন্যতম পবিত্র স্থান : তিনি বলেন, ‘এই স্থানটির (নিজামুদ্দিন) সম্মান কোরো। সমগ্র পৃথিবীর অবস্থা হলো এমন যে মক্কা-মদিনার পরে যদি এমন কোনো সম্মানিত জায়গা থাকে, যে জায়গাকে আদর্শ মনে করতে হয়, যে জায়গার অনুসরণ করতে হয়, যে জায়গাকে মহান মনে করতে হয়, তাহলে সেটি হলো এই নিজামুদ্দিন বাংলাওয়ালি মসজিদ।’
তাবলিগের মাশওয়ারা নামাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ : তিনি বলেন, ‘মুমিন যেভাবে গুরুত্বের সঙ্গে নামাজ আদায় করে, গুরুত্বের সঙ্গে মাশওয়ারায় (পরামর্শ) উপস্থিত থাকা এর চেয়েও অধিক জরুরি।’ (সূত্র : অব্যাহত বিভ্রান্তিকর বয়ান, পৃষ্ঠা : ৯)।
তাবলিগের বাইরের কিতাব পড়া যাবে না : তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজের (তাবলিজি) সঙ্গে লেগে থাকতে হবে এবং মাওলানা ইলিয়াছ ও মাওলানা ইউসুফ সাহেবের কিতাব পড়বে, অন্য কোনো কিতাব পড়বে না।’
৩. তাবলিগ জামাতের সংকট ঘনীভূত হওয়ার আরো একটি কারণ হলো, সাদ সাহেব শত বছরের ঐতিহ্যবাহী তাবলিগের মূল কাঠামোতে মনগড়া ও অনর্থক পরিবর্তন এনেছেন। প্রথমেই তিনি নিজেকে সমগ্র উম্মতের ‘আমির’ বলে দাবি করেন। অথচ কোনো পরামর্শসভায় তাকে আমির বানানো হয়নি। বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে তিনি নিজামুদ্দিন দখল করেন। তার ওস্তাদসহ সব আলেমকে সেখান থেকে বের করে দেন, বের করতে গিয়ে আলেমদের শরীর থেকে রক্ত ঝরাতেও কসুর করেননি। (সূত্র : দাওয়াত ও তাবলিগ, ড. মুহাম্মদ আবদুল হাননান, বিশ্বসাহিত্য ভবন, নভেম্বর, ২০১৮ ভূমিকা দ্রষ্টব্য, পৃষ্ঠা ১৩)। তাবলিগ জামাতের স্বপ্নদ্রষ্টা মাওলানা ইলিয়াস (রহ.), মাওলানা ইউসুফ (রহ.) এবং মাওলানা এনামুল হাসানের পদ্ধতির বাইরে তিনি নানা রকম তত্ত্ব ও বয়ান উপস্থিত করেন। পরামর্শের উদ্দেশ্য, তালিমের উদ্দেশ্য, ছয় সিফত ইত্যাদিতে তিনি এত কালের বর্ণনা বাদ দিয়ে নিজের থেকে নতুন নতুন জিনিস হাজির করেন।
১৯২০ সাল থেকে চলে আসা তাবলিগের ছয় মূলনীতির ব্যাখ্যা ছিল এক ধরনের। (ড. মুহাম্মদ আবদুল হাননানের কলাম, তাবলিগ জামাতের ছয় মূলনীতি, দৈনিক কালের কণ্ঠ : ১৩-০১-২০১৭) কিন্তু সাদ এসে এই মূলনীতি বদলে দেন। (ছয় নম্বর ও তাবলিগের বয়ান, মাওলানা লুৎফর রহমান সংকলিত, মাকতাবাতুল মিসবাহ, ঢাকা, ২০১৬) এত দিন তাবলিগ জামাতের যে পরামর্শসভার পদ্ধতি ছিল, যা একেবারে চূড়া থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ছিল, তা-ও তিনি বাদ দিয়ে দেন। ধীরে ধীরে সাদ সাহেব তাবলিগ জামাতে ব্যাপক বিকৃতি ঘটাতে থাকেন। যেমন : দৈনন্দিনের মেহনতের মধ্যে দাওয়াত, তালিম ও ইসতিকবাল (পরবর্তী সময় নাম রাখা হয় ‘মসজিদ আবাদির মেহনত’) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে উমুমি গাশতের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে; অথচ এই উমুমি গাশতই ছিল তাবলিগের মেরুদণ্ড। এর ফলে এই মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। সমাজের বিশেষ লোকদের মধ্যে মেহনত করাকে ‘তবাকাতি মেহনত’ নাম দিয়ে এই মেহনতের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ফলে উম্মতের বিশেষ শ্রেণি এই মেহনত থেকে মাহরুম হয়ে যায়। মাসতুরাতের তালিমের মধ্যে পাঁচটি বিষয় যুক্ত করা হয়। বিদেশি দেশগুলোতে ৪ মাসের পরিবর্তে পাঁচ মাসের তরতিব বানিয়ে দেওয়া হয়।
১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে মাওলানা ইজহারুল হাসান ইন্তেকালের পর সাদ সাহেব নিজামুদ্দিনের কোষাগারও হাতের মুঠোয় নিয়ে নেন। আয়-ব্যয়ের নিয়মমাফিক কোনো হিসাব-নিকাশ এখন আর তৈরি হয় না। এমনকি মজলিশে আমেলার সামনেও কোনো বিবরণী উপস্থাপন করা হয় না। আরেকটি নতুন কাজ হলো, ফাজায়েলের কিতাবগুলোর তালিম বাদ দিয়ে ‘মুনতাখাব হাদিস’কে গুরুত্ব দেয়া হয়। অথচ কোনো সুরাই কখনো এ কিতাবকে জামাতের সিদ্ধান্তকৃত নিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেনি। উপরন্তু এ কিতাবকে মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ (রহ.)-এর ‘চয়ন-নির্বাচন’ বলা হচ্ছে। বাস্তবতা হলো, এ বইয়ের হস্তলিপি বা পাণ্ডুলিপি আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি। কারো সঙ্গে এ নিয়ে তিনি আলাপ-আলোচনাও করেননি! এত কিছু করেই তিনি থেমে যাননি। তিনি বদলে দেন নামাজের কাঠামোও! নিজামুদ্দিন মসজিদের এই জায়নামাজে তার পরদাদা, দাদা ও পিতা; এমনকি নানাদের মতো ব্যক্তিদের যে পদ্ধতিতে নামাজ নিজে পড়েছেন, অন্যদের পড়িয়েছেন, এখানে-সেখানে বড় দাগে পরিবর্তন করেন এভাবে যে কাওমা (রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানো অবস্থায়) ও জলসায় (দুই সিজদার মাঝখানে বসা অবস্থায়) সেই এমন সব দোয়া পাঠ করা শুরু করে দেন, যা হানাফি মাজহাব অনুসারে ফরজ নামাজে নয়; শুধু নফল নামাজে পড়া যাবে। এমন পরিবর্তনে গোটা জামাত বিস্মিত হয়; কিন্তু কেউ ‘উফ’ বলার সাহস পায়নি। একজন এ ব্যাপারে কারণ জানতে চাইলে তিনি জবাব দেন, ‘আমি মুহাম্মাদি। আমি সুন্নাহ অনুসরণ করি।’ এভাবেই তিনি তাবলিগ ও নামাজের কাঠামো বদলে দেন।
(সূত্র : চৌধুরী আমানত উল্লাহ, সদস্য, মজলিশে আমেলা, মাদ্রাসায়ে কাশেফুল উলুম, বাংলাওয়ালি মসজিদ, নয়াদিল্লি; অনুবাদ : আবদুল্লাহ আল ফারুক, মাকতাবাতুল আসআদ, ঢাকা, ৫ আগস্ট ২০১৭)