সুযোগ সৃষ্টি হলেই জালেমকে তার জুলুমের শাস্তি বুঝিয়ে দেয়া জরুরি। অত্যাচারীর যারা সহচর-অনুচর তাদেরও বিচারের মুখোমুখি করে অপরাধের দণ্ড প্রদান করতে হবে। তবে কোনো অবস্থাতেই কেবল সন্দেহের বশবর্তী হয়ে নিরীহ-নিরপরাধকে ভুক্তভোগী করা যাবে না। একজন নির্দোষ মানুষও যদি ভুলে দণ্ড পায়, চাকরি হারায় কিংবা অসম্মানিত হয় তবে সেটা নব্য জুলুমাত তৈরি করবে। এই জুলুমাত গোটা বিচারব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করলেও ভবিষ্যতে ন্যায়গতভাবে শাসককে শাস্তি ও কৈফিয়তের মুখোমুখি করার ক্ষেত্র তৈরি করে রেখে যাবে। আইন বলছে, শত অপরাধী মুক্তি পেলেও যাতে একজন নিরপরাধ সাজা না পায়। এর ব্যত্যয় ঘটলেই ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হয়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অর্গানকে যারা সক্রিয় রাখে সেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যখন যে সরকার আসে তাদের সাথে কাজ করতে হয়। সময়ের আবর্তনে সরকারি চাকরিজীবীরা বিভিন্ন সময়ে আলাদা আলাদা সরকারের সাথে কাজ করতে বাধ্য হয়। এটা আমলাতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। তবে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের কর্মকালে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে লীন হতে পারবে না। যারা এই শর্তের বেড়াজালের বিরোধিতা করে চাকরিবিধি লঙ্ঘনের মাধ্যমে কোনো সরকারকে নগ্নভাবে সমর্থন করেছে, নিজেদের আখের গুছিয়েছে এবং সহকর্মীদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন-প্রকাশ্য প্রভাব খাটিয়েছে, ওই সময়ের ক্ষমতাসীন সরকার যদি জুলুমবাজ হয় তবে, তারাও সেই অত্যাচারীদের দোসর-অংশ। তাদের বিধিমোতাবেক দণ্ডে যা যা শাস্তি প্রাপ্য তা নিশ্চিত করা না গেলে বরং অপরাধের শিকড় থেকে যাবে। কিন্তু যারা কেবল দায়িত্ব পালন করেছে, দলান্ধ হয়ে চেয়ারে থাকেনি কিংবা অর্পিত কাজের বাইরে কোথাও নাক গলায়নি তাদের যাতে কোনো হেনস্তার শিকার করা না হয়। চাকরিতে থেকে সরকারি কোনো সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা, বিরোধিতা করা কিংবা মেনে না চলা সরাসরি চাকরিবিধির লঙ্ঘন। তবে যারা জুলুমবাজ সরকারের নজরে থাকতে, সান্নিধ্যে আসতে এবং আরও ক্ষমতাধর হতে বাড়াবাড়ি করেছে, আইন লঙ্ঘন করে সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে ও নিয়েছে কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে তাদের শাস্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন না করলে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বেচ্ছাচারী হতে প্রেরণা পাবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নজরদারিতে না রাখলে দুর্নীতি-অনিয়ম বাড়ে। জুলুমণ্ডঅত্যাচারের সময়ে সমাজের বুদ্ধিজীবীগণ, সুশীল ও শিক্ষিতরা চুপ থাকলে শাসকের দৌরাত্ম্য ও স্বৈরাচার গতি পায়। যা দেশের সামগ্রিক ক্ষতির কারণ। একজন সাধারণ মানুষ, মুক্ত মানুষ কিংবা সরকার কাঠামোর বাইরের মানুষ যেভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে সেভাবে একজন বিধিবিধানের অধীন নিয়োগপ্রাপ্ত সাধারণ এ সামান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী আওয়াজ তুলতে পারে না। চাকরিজীবীকে একদিকে যেমন পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা বিবেচনা করতে হয় তেমনি সরকারে বিরোধিতা করে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিলে জীবনের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হতে পারে। শুধু কর্মে নিস্ক্রিয় হয়ে আত্মভোলার ভূমিকায় কাটানো যায়। বিবেকবানরা এটাও পারে না। কেননা দলকানা বসের কাছে খবর গেলে হয়রানির শেষ থাকে না। জালেমে ও তার অংশীজনের শাস্তি হোক- এটা প্রত্যাশিত।
তবে যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন আমলাতন্ত্রের সবাই তাদের অন্ধ অংশ হয়ে যায়- এটা ভুল ধারণা। বরং খুব সামান্যই জুলুমাতে নিমজ্জিত হয়। কেবল দোষীদের চিহ্নিত করে দণ্ড দিলে চেতনায় যারা ভণ্ড তাদের সবাই সোজা হয়ে যাবে। রাষ্ট্র সিস্টেম পাল্টাতে পারে কিন্তু ক’জন মানুষ পাল্টাতে পারবে? প্রায় সব মানুষের মধ্যে একই বৈশিষ্ট্যের রক্ত প্রবাহিত হয়! ধারণা প্রসূতভাবে কিংবা আন্তঃকোন্দলের সুযোগ নিয়ে কাউকে স্যাক করা, হয়রানি করা কিংবা অসম্মানিত করা ন্যায়ের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্যও নিরপেক্ষতার শপথ থাকা জরুরি। যারা দলান্ধ, যারা দুর্নীতিবাজ কিংবা যারা অন্যায়ের প্রশ্রয়কারী তাদের শাস্তি প্রদানকালে যদি কোনো নীতিবান দণ্ডপ্রাপ্ত হয় তবে সেটা অন্যায়, ঘোরতর অন্ধকার। অন্তবর্তীকালীন সরকার জাতিকে আলো দেখাতে এসেছে। এই সরকার হাজার প্রাণ ও লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে কেনা। আশা নয় বিশ্বাস, সংস্কারের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। স্বপ্নের ওমাথায় নতুন বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে। কেবল হাত বাড়িয়ে স্পর্শের অপেক্ষায়। জুলুমাত ঠেলে জাতিকে আলোতে নিতে হবে। তবে সেই উদ্যোগ যাতে নতুন অন্ধকারাচ্ছন্নের সুযোগ সৃষ্টি না করে- সচেতন থাকতে হবে। সরকার পাল্টানোর সাথে সাথে যারা দফতর, অধিদপ্তর কিংবা বিভিন্ন অফিসে বসে তারাও যাতে আরেক দলের প্রতি ভীষণরকম দুর্বল কেউ না হয়। দলান্ধতা যাতে তাদের আবারও বিপথগামী না করে। সর্বত্রই নিরপেক্ষ, ন্যায়বান এবং যোগ্য লোক আছে।
রাষ্ট্রের অঙ্গগুলো সামলানোর লক্ষ্যে যোগ্য লোকের কাঁধে দায়িত্ব উঠুক। দক্ষ মানুষগুলো রাষ্ট্রকে পথ দেখাতে পারে। যত ভালো কাজ হোক, যত নিখুঁতভাবে হোক কিংবা যত নিরপেক্ষভাবে হোক তা নিয়ে এই দেশের অন্তত ৫ কোটি লোকের আপত্তি থাকবে। অবিসংবাদিত কিংবা সার্বজনীন বলে এদেশে কিছুই স্বীকৃতি পায়নি এবং পাবেও না। কেননা রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং ধর্ম ও ধর্মহীনতা এদেশে প্রবল। স্বার্থের ঊর্ধ্বে ভাবতে পারাদের সংখ্যা সামান্যই। প্রত্যেকের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনকালে সর্বোচ্চ সততাকে প্রধান্য দিতে হবে। এর নিশ্চয়তাও আদায় করতে হবে।
অপরাধের সাথে জড়িত না থেকেও, অন্যায়কে মেনে না নিয়েও এবং অত্যাচারীর সাথে বন্ধুত্ব না পাতিয়েও কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হয়। একজন সৎ মানুষের সম্মান আল্লাহর আরশের খুঁটির সাথে জড়িয়ে থাকে। অনর্থক হয়রানি, অতীতের আক্রোশ মেটানোর জন্য কোন দায়িত্বশীলের দিকে অন্যায্য প্রশ্ন তোলা যাবে না। তবে কেউ যদি তার সীমার পরিধি লঙ্ঘন করে বাড়াবাড়ি করে থাকে তবে তাকে শিক্ষা না দিলে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া হবে। যেটাও নীতিবিরুদ্ধ। যা ভবিষ্যতে নতুন নতুন অপরাধের সৃষ্টি করবে। সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিরপেক্ষভাবে, নির্মোহ থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তারা যাতে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বগুলো পালনে বাধ্য হয় সেজন্য জনপ্রশাসনের কিংবা সিস্টেমের যতটুকু সংস্কার দরকার তা সরকার নিশ্চিত করবে- এই আশাবাদ রাখছি।