মুসলিম দেশগুলোতে সুশাসনের ঘাটতি

সরদার সিরাজ

প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সব দেশেরই শান্তি ও উন্নতির জন্য সুশাসন অপরিহার্য। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মুসলিম দেশগুলোতে সুশাসনের অবস্থা ভালো নয়! যেমন: পাকিস্তান। ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের ‘রুল অফ ল’ ইনডেক্স-২০২৪’ মতে, আইনশৃঙ্খলার দিক দিয়ে ১৪২টি দেশের মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান তৃতীয় নিকৃষ্টতম। শুধুমাত্র মালী ও নাইজেরিয়ার অবস্থান পাকিস্তানের নিচে। সরকারি ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি উন্মুক্ত সরকার, মৌলিক অধিকার, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, নিয়ন্তক প্রয়োগ, সিভিল জাস্টিস এবং ফৌজদারি বিচারের জন্য নির্ধারিত হয়েছে উক্ত সূচক। এসব ক্ষেত্রে সূচকে পাকিস্তানের অবস্থান: সরকারি ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার জন্য ১০৩তম, দুর্নীতির জন্য ১২০তম, উন্মুক্ত সরকারের জন্য ১০৬তম, মৌলিক অধিকারের জন্য ১২৫তম, নিয়ন্ত্রক প্রয়োগের জন্য ১২৭তম, দেওয়ানি বিচারের জন্য ১২৮তম এবং ফৌজদারি বিচারের জন্য ৯৮তম। দক্ষিণ এশিয়ার ৬টি রাষ্ট্রের মধ্যে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান রয়েছে সূচকের তলানিতে! শুধু এই দুটি দেশই নয়, সুশাসনের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মুসলিম দেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তন্মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম! জাতিসংঘের ই-গভর্নমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স-২০২৪ মতে, ২০২৩ সালে বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০০তম (২০২২ সালে ছিল ১১১ তম, ২০২০ সালে ছিল ১১৯তম)। মুসলিম দেশগুলোর এই অবস্থা আজ নতুন নয়, বহুদিন থেকে চলছে। তাই ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও মুসলিম দেশগুলোতে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হচ্ছে না। অথচ, পণ্ডিতদের অভিমত, বিশ্বের মোট সম্পদের ৬০ শতাংশ রয়েছে মুসলিম দেশে। সক্ষমতার অভাবে তারা তা আহরণ করতে পারছে না। উক্ত সম্পদের কিছু অংশ বিধর্মীরা আহরণ করে সামান্যটুকু দিয়ে বাকিগুলো নিয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু আহরিত সম্পদের যেটুকু ভাগ মুসলিম দেশগুলো পাচ্ছে, তার অংশ পাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট দেশের সিংহভাগ মানুষ। শাসনকর্তারা বেশিরভাগ ভোগ করছে এবং অঢেল সম্পদ মজুদ করছে দেশ-বিদেশের ব্যাংকে।

তন্মধ্যে অমুসলিম দেশে, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে বেশি, যার কোনো জবাবদিহি নেই। ফলে সংশ্লিষ্ট দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের আর্থিক উন্নতি হচ্ছে না। গরিব থেকে যাচ্ছে। তাই তারা শিক্ষাসহ মৌলিক চাহিদা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। উপরন্তু অধিকাংশ মুসলিম দেশে সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।

তাই শক্তিশালী হতে পারছে না। এভাবে মুসলিমরা আজ বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক দুর্বল ও অশিক্ষিত জাতিতে পরিণত হয়েছে। সেই সুযোগে বিধর্মীরা স্টিমরোলার চালাচ্ছে মুসলমানদের উপর, যার সাম্প্রতিক প্রমাণ ফিলিস্তিন, লেবানন ও সিরিয়া। সেখানে ইসরাইল ব্যাপক আক্রমণ চালাচ্ছে! তবে সর্বাধিক ও লোমহর্ষক আক্রমণ হচ্ছে ফিলিস্তিনে। ফিলিস্তিনিরা আজ নিজ জন্মভূমিতেই গুম, খুন, আহত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। উপরন্তু উচ্ছেদ হয়ে পরবাসী হয়েছে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। সেখানে জাতিসংঘের ত্রাণ কর্মকর্তারাও আক্রান্ত হচ্ছে। উপরন্তু জাতিসংঘের ত্রাণ তৎপরতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইউএনআরডব্লিউএকেও নিষিদ্ধ করেছে ইসরাইল। জাতিসংঘ গত মে মাসে বলেছে, ‘গাজাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ৮০ বছর সময় লাগবে।’ ইসরাইলের এই অপকর্ম শতাব্দির সবচেয়ে বর্বরোচিত কাজ এবং দেশটির প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু শতাব্দির নিকৃষ্টতম নরঘাতক বলে পণ্ডিতদের অভিমত। জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস সম্প্রতি বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দৃঢ় অবস্থান না নিলে ইসরাইল গাজায় জাতিগত নির্মূল অভিযান চালাতে পারে।’ ফিলিস্তিনে ইসরাইলের নৃশংসতার প্রতিবাদে সম্প্রতি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এক হাজারের বেশি লেখক ও সাহিত্যিক ইহুদিবাদী ইসরাইলের সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলোকে সহযোগিতা করবেন না বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে এক বিবৃতিতে বলেছেন, ইহুদিবাদী সরকার ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর যে দমন-পীড়ন ও গণহত্যা চালিয়ে আসছে, তাতে সহযোগিতা করছে এসব সাংস্কৃতিক সংস্থা। তাই লেখকরা ইসরাইলি প্রকাশক, উৎসব, সাহিত্য সংস্থা এবং প্রকাশনাগুলোর সঙ্গে কাজ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এসব লেখকের মধ্যে অনেকেই নোবেল, পুলিৎজার ও বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত রয়েছেন। ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে গত ১ নভেম্বর একটি চিঠি দিয়েছে তুরস্কসহ ৫৪টি দেশ ও দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। ইসরাইলের জাতিসংঘের সদস্য পদ বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছে মালয়েশিয়া। স্মরণীয় যে, ইসরাইলের লালসা শুধুমাত্র ফিলিস্তিনেই সীমাবদ্ধ নয়। ইসরাইলি ইহুদীদের আকাঙ্ক্ষা সমগ্র এলাকা মিলে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ইসরাইলি লেখক আভি লিপকিন গত জানুয়ারিতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এমন এক দিন আসবে, যেদিন আমাদের সীমানা লেবানন থেকে সৌদি আরবের বিশাল মরুভূমি, ভূমধ্যসাগর থেকে ফোরাত নদী (ইরাক) পর্যন্ত বিস্তৃত হবে’। এই আগ্রাসী আকাঙ্ক্ষা শুধুমাত্র উক্ত লেখকেরই নয়, ইসরাইলের অধিকাংশ ইহুদিও একই আশা পোষণ করে এবং সেভাবেই কর্মকাণ্ড চালায়। ইসরাইলের এই পৈশাচিকতাকে বৈশ্বিক গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বঘোষিত সোল এজেন্টরা তথা পশ্চিমারা সার্বিক সহায়তা করছে। অন্যদিকে, অধিকাংশ মুসলিম দেশের কর্ণধাররা তা চেয়ে চেয়ে দেখছেন। প্রতিরোধ করা তো দূরে থাক, প্রতিবাদও করছেন না। বরং ইসরাইল ও তার মদদদাতাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। শুধুমাত্র ইরান পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে। তৎপ্রেক্ষিতে ইসরাইল ব্যাপক আক্রমণ চালিয়েছে ইরানে! এ অবস্থায় আমেরিকাও মধ্যপ্রাচ্যে অতিরিক্ত ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা বিধ্বংসী অস্ত্র, যুদ্ধবিমান স্কয়াড্রোন, ট্যাঙ্কার বিমান এবং বেশ কয়েকটি বি-৫২ দূরপাল্লার স্ট্রাইক বোম্বার মোতায়েনের পরিকল্পনা করেছে। পেন্টাগন বলেছে, এসব অস্ত্র আগামী কয়েক মাসের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে পৌঁছে যাবে। এছাড়া, ইউএসএস আব্রাহাম লিংকন ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপও সেখানে নিয়েছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ বাঁধার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

যা হোক, সমগ্র বিশ্বেই মুসলিমরা আজ শাসিত-শোষিত, নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত জাতিতে পরিণত হয়েছে! অথচ, একদা মুসলিমরা বিশ্বের সব ক্ষেত্রেই তথা শিক্ষা, জ্ঞান-বুদ্ধি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদিতে সর্বাধিক শক্তিশালী ছিল। বর্তমানে তারা দুর্বল জাতিতে পরিণত হয়েছে, যার জন্য মূলত দায়ী নিজেরাই। এর অন্যতম হচ্ছে, অনৈক্য, অশিক্ষা, দারিদ্র্য ও শক্তিহীনতা। এসব কারণের জন্য মূলত দায়ী সুশাসনের অভাব, যা সৃষ্টি হয় গণতন্ত্রহীনতা ও জবাবদিহিহীনতা থেকে। দুঃখজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ মুসলিম দেশে গণতন্ত্র নেই! আছে পরিবারতন্ত্র বা রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ও হাইব্রিড গণতন্ত্র। যে দু’চারটি মুসলিম দেশে গণতন্ত্র আছে, তার অবস্থা বিশ্বের শীর্ষ ফ্যাসিস্ট হাসিনা সৃষ্ট গণতন্ত্র তথা হাইব্রিড গণতন্ত্র! অথচ, গণতন্ত্রের সূচনা ঘটেছে পবিত্র ইসলামের শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে। কারণ, তিনি তার জীবদ্দশায় তার কোনো উত্তরাধিকার মনোনীত করেননি। সকলেই মিলে গণপ্রতিনিধি মনোনীত করবে সেই আকাঙ্ক্ষায়, যা গণতন্ত্রের সূচনা। অথচ, তার অধিকাংশ উম্মত সেটি মনেপ্রাণে ধারণ করে না, করলেও তা বাস্তবায়ন করে না। তাই, অধিকাংশ মুসলিম দেশে গণতন্ত্র নেই, তাই সুশাসনও নেই!

মুসলমানদের বর্তমান দুর্গতি থেকে রক্ষা পেয়ে কাঙ্ক্ষিত সার্বিক উন্নতি তথা অতীত ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে হবে। সেজন্য সর্বাগ্রে দরকার সব মুসলিম দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলেই শোষণ, বঞ্চনা, অবিচার, বিলাসিতা, দুর্নীতি, অপচয়, অর্থ পাচার দূর হবে। তাতে সার্বিক উন্নতি হবে স্বল্প দিনেই। জাতিগত ঐক্যও সৃষ্টি হবে। আর সার্বিক উন্নতি হলেই মুসলিমদের শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটবে। আধুনিক সামরিক শক্তি অনেক বেড়ে যাবে। অনেক মুসলিম দেশ পারমাণবিক শক্তির অধিকারীও হতে পারবে। তখন আর কেউ মুসলিমদের শাসন, শোষণ ও নির্যাতন করার সাহস পাবে না। বরং সবাই মুসলিমদের সমীহ করে চলবে। তাই সব মুসলিম দেশে অবিলম্বে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্র না থাকলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না। কারণ, এ দুটি বিষয় একটি অপরটির পরিপূরক। তাই সব মুসলিম দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। উপরন্তু মুসলিম দেশগুলোর উন্নতি ত্বরান্বিত করার জন্য বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অর্থ মজুদ, পর্যটন, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বৃদ্ধি করা আবশ্যক। এছাড়া, কোনো বিষয়ে যদি মতবিরোধ সৃষ্টি হয়, তাহলে সেটা নিরসনের জন্য কোনো অমুসলিম দেশের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে নিরসন করতে হবে। অথবা, ওআইসির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে। তাহলে নিজেদের সম্পর্ক যেমন গভীর হবে, তেমনি আর্থিক উন্নতি, কর্মসংস্থান ইত্যাদি অনেক বৃদ্ধি পাবে, যার সুফল পাবে সব মুসলমান। দ্বিতীয়ত, বর্তমান বিশ্ব হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির। বিশেষ করে প্রযুক্তি এখন মানুষের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়েছে। তাই প্রযুক্তিতে যারা যত বেশি দক্ষ হচ্ছে এবং ব্যবহার করছে তারা তত বেশি উন্নতি করছে। তাই এ ক্ষেত্রে মুসলিমদের সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। সর্বোপরি কারিগরি শিক্ষা কর্মসংস্থান ও উন্নতির জন্য ব্যাপক সহায়ক। অপরদিকে, ধর্মীয় শিক্ষা মানুষের কল্যাণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ না করলে ধর্মীয় বিধান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জিত হয় না। ফলে মানবিক গুণাবলীর শূন্যতা সৃষ্টি হয়। ফলে শান্তি ও উন্নতি ব্যাহত হয়। তাই ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করা মুসলমানদের জন্য জরুরি। স্মরণীয় যে, মুসলমানদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব থেকে অধোগতির কারণসমূহের অন্যতম হচ্ছে, ধর্মীয় অনুশাসন থেকে দূরে সরে যাওয়া, যা ক্রমান্বয়ে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাই মুসলমানদের সার্বিক শান্তি ও উন্নতি লাভ করে অতীত ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়ার জন্য ধর্মীয় বিধান পূর্ণভাবে জানা ও পালন করা আবশ্যক।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।