তরুণদের বিদেশমুখী প্রবণতা কমাতে হবে

প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সম্প্রতি ব্রিটিশ কাউন্সিলের উদ্যোগে প্রকাশিত ‘নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশ ২০২৪’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৫৫ শতাংশ তরুণ বিদেশে যেতে আগ্রহী। এর প্রধান কারণ হিসেবে, তরুণ শ্রেণি বেকারত্ব, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, নিয়োগবৈষম্য ইত্যাদিকে দায়ী করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের তরুণ শ্রেণির এই সমস্যা নতুন নয়, দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। প্রত্যেক সরকারই এসব সমাধানে অনেক আশ্বাস ও উদ্যোগের কথা বলেছে। সর্বশেষ, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তা কেবল কথার ফুলঝুরি হয়েই ছিল। এতে তরুণ শ্রেণি হতাশ হয়ে ‘দেশে কিছু হবে না’ বলে দেশ ছাড়ার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, বৈধ-অবৈধ পথে দেশ ছেড়েছে। বন-জঙ্গলের দুর্গম পথ ও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে জীবন দিয়েছে। এসব সংবাদ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, যা দেশের ভাবমর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। হাসিনার আমলে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে এক তুঘলকি কাণ্ড সৃষ্টি হয়েছিল। মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে প্রভাবশালী চক্র সিন্ডিকেট করে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা নিয়ে বিদেশগামীদের অনেককে নিঃস্ব করে দিয়েছে। বিদেশ পাঠালেও সেখানে গিয়ে প্রতিশ্রুত কাজ পায়নি। অনেকে গ্রেফতার হয়ে জেলে মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছে, অনেককে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। তারপরও দেশের তরুণ শ্রেণি কেন বিদেশগামী হচ্ছে, এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথার নামে বৈষম্য সৃষ্টির প্রতিবাদে। একসময় তা ফ্যাসিস্ট হাসিনার মসনদই উল্টে দেয়। এই বিপ্লব প্রকাশ্য কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বে সংগঠিত হয়নি। তরুণ ও জনসাধারণের হাতাশা ও বৈষ্যম্য থেকে উত্থিত হয়। তরুণ শ্রেণির সামনে কোনো আশার আলো ছিল না। বেকারত্বের ভারে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস চলছিল। এর কোনো কিছুই হাসিনা সরকার সমাধান করতে পারেনি। ফলে সকল শ্রেণি তার অপশাসনের বিরুদ্ধে জীবনবাজী রেখে বিপ্লব করে। এতে হাসিনা পালিয়ে গেলেও দেশে বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক অপূর্ণতা রয়ে গেছে। তরুণদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কমেনি, বরং বেড়েছে। তাদের এই বিদেশগামী প্রবণতার মূল কারণ হচ্ছে, দেশে তাদের কর্মসংস্থান বা কোনো কিছু করে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ না থাকা। দিনি দিন কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে। ফলে বিদেশের কঠিন পরিবেশের মধ্যেও স্বাবলম্বী হয়ে জীবন উন্নত করার প্রত্যাশা নিয়ে সেখানে যাওয়া শ্রেয় মনে করছে। তাদের প্রবণতা এই, দেশে বছরের পর বছর চাকরির পেছনে ছুটে সময় নষ্ট করার চেয়ে কোনো রকমে বিদেশ যেতে পারলে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যাবে। ফলে কষ্ট ও অবমাননাকর জীবনের মুখোমুখি হওয়ার বাস্তবতা মেনে নিয়েই তারা বিদেশগামী হচ্ছে। ভিটেমাটি, জমিজমা বিক্রী ও ধার-কর্জ করে হলেও তারা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফলাফল করেও শিক্ষার্থীরা দেশে কিছু হবে না বলে, স্কলারশিপসহ বিভিন্নভাবে বিদেশ চলে যাচ্ছে। সেখানে গিয়ে ভাল ফলাফল করে সেখানেই থেকে যাচ্ছে। এতে দেশে দীর্ঘদিন ধরে ‘ব্রেইন ড্রেইন’ বা মেধাপাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত বৃহস্পতিবার ‘বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যানের শতবর্ষ উদযাপন: ঢাকার উত্তরাধিকার’ শীর্ষক সম্মেলনে বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার বিপ্লবের ফসল, বিপ্লবের মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষকরা চিন্তার স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে।’ আবার এটাও সত্য, এই বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ছাত্র-জনতার প্রত্যাশাও বিপুল। তারা প্রথমত, অর্থনৈতিক মুক্তি চায়। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে বেকারত্বের অবসান চায়। দুবেলা দুমুঠো পেটভরে খেয়ে স্বস্তিতে থাকতে চায়। জনগণের এ প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকার কতটা অগ্রাধিকার দিচ্ছে, সেটাও বিবেচনা করা দরকার। আমরা জানি, লুটেরা শেখ হাসিনা সরকার উন্নয়নের নামে দেশের অর্থনীতিকে লুটপাট করে ধ্বংস করে দিয়েছে। ব্যাংকে টাকা নেই, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের কষ্টের সীমা নেই, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নেই, কর্মসংস্থান নেই। এসবই অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। তবে এগুলো নিরসন এবং সহনীয়-স্বস্তিকর অবস্থায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে উদ্যোগের অভাব রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপর জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য, চীন, জাপানসহ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাইকা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক দাতা প্রতিষ্ঠান থেকে ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে বিপুল আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। এসব সহায়তা পর্যায়ক্রমে পাওয়া যাবে এবং কিছু কিছু আসছে। এতদসত্ত্বেও, জরুরিভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে যে কাজটি করা উচিত তা হচ্ছে, দেশের বেকারত্ব নিরসনে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া। অন্যদিকে, নিত্যপণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ পিষ্ট হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমার পরিবর্তে বেড়েছে। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২.৬৬ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিদায়ের পর সাধারণ মানুষ ধরেই নিয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় নিত্যপণ্যের দাম কমে সহনীয় পর্যায়ে আসবে। এটি না হওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।

অন্তর্বর্তী সরকার মূলত তরুণ শ্রেণিী স্বপ্নের সরকার। তাদের স্বপ্ন পূরণে এ সরকার দ্রুত উদ্যোগ নেবে, এ প্রত্যাশা থাকা স্বাভাবিক। সরকার মুখে মুখে এ কথা বললেও তরুণদের স্বপ্ন পূরণে দ্রুত উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। সরকার ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক খাত কিছুটা শৃঙ্খলায় আনলেও অর্থনীতিতে সেভাবে গতি আনতে পারেনি। এখন দুর্নীতি ও অর্থপাচার না হলেও তা বিনিয়োগে গতি আনতে পারেনি। বিনিয়োগে গতি না এলে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ হবে না। কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি না হলে তরুণরা আরো হতাশ হয়ে বিদেশমুখী হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারকে এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তারুণদের কদর করেন, তাদের নিয়ে উচ্চাশা পোষণ করেন। এর প্রতিফলন বাস্তবে থাকতে হবে। শুধু কথায় তারুণ্যের স্বপ্নের কথা বললে হবে না, তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের বিদেশমুখী প্রবণতা ঠেকিয়ে দেশের সম্পদে পরিণত করতে হবে। এজন্য বিনিয়োগ বাড়িয়ে তাদের মেধাকে কাজে লাগাতে হবে। তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। তাদের উদ্যোক্তা হতে উৎসাহ দিতে হবে, যাতে তারা স্বাবলম্বী হতে পারে।