হেমন্ত, নবান্ন ও অঘ্রাণের ঘ্রাণে মুখরিত বাংলাদেশ

এসএম মুকুল

প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

হেমন্ত আসে ধীর পায়ে শিশিরস্নাত শীতল পরশ আলতো গায়ে মেখে। হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই কৃষিপ্রধান এই বাংলাদেশে সূচনা হয় নবান্ন উৎসব। ঋতুর রানি হেমন্তে নতুন ফসলের মৌ মৌ গন্ধে প্রকৃতিতে প্রশান্তির ভাব চলে আসে। ভোরের কুয়াশায় ফসলের মাঠে, গাছের পাতায়, ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু শিশির জমে। নতুন ধানের মৌ গন্ধে ফসলের মাঠে ওড়াউড়ি করে প্রজাপতি, ভ্রমর আর ঘাসফড়িংয়ের দল। হেমন্তে ফোটে ফুল শিউলি। দোলনচাঁপাও সুবাস ছড়ায় চারিদিকে। নবান্নের ঋতু হেমন্তকে ঘিরে কবি-সাহিত্যিকরা লিখেছেন গল্প, কবিতা আর গান। কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন- ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে/হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’। সত্যিই কবিতার মতোই সুন্দর নবান্নের চিরায়ত এই বাংলার গ্রামীণ রূপ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’ আবহমান এই বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধতার শুরু মা-মাটি-কৃষি থেকে। হেমন্ত নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুুর ঋতু। তাই বোধ হয় হেমন্তকে অনুভবের ঋতুও বলা হয়। আবার হেমন্তকে মৌন, শীতল বা অন্তর্মুখী ঋতুও বলা যায়। প্রকৃতির হিম হিম ভাব আর হাল্কা কুয়াশায় শীতের আগমন বার্তা নিয়ে জানিয়ে ১ কার্তিক থেকেই শুরু হয়েছে হেমন্তকাল। এক হেমন্তের দুটি রূপ- ঋতুর শুরুতে মরা কার্তিকে অভাব আর ক্ষুধার হাহাকার; আবার শেষে অগ্রহায়নে ধানের প্রাচুর্য। প্রকৃতিপ্রেমী কবি জীবনানন্দ দাশ যথার্থই বলেছেন- ‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপর মাথা রেখে/অলস গেঁয়োর মতো এইখানে-কার্তিকের খেতে;/মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার/চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ/তাহার আস্বাদ পেয়ে পেকে ওঠে ধান’। কবির বর্ণনা যেন প্রকৃতির প্রতিচিত্র। কার্তিক আর অগ্রহায়ন দুই মাস হেমন্ত কাল। এই হেমন্তের অঘ্রাণে কৃষকের ঘরে নতুন আমন ফসল উঠে। একারণে হেমন্তকে বলা হয় নবান্নের ঋতু। অঘ্রাণে ফসলে মাঠে মাঠে কাঁচা-পাকা অপরূপ দৃশ্য মন কাড়ে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে অঘ্রাণের মোহনমায়ার চিত্ররূপকেই উপস্থাপন করেছেন- ‘ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা খেতে, (আমি) কি দেখেছি মধুর হাসি। ...’ সবুজ ফসলের মাঠজুড়ে কাঁচা-পাকা ধানের আভা ছড়িয়ে শুরু হলো অগ্রহায়ণ। তাই হিমেল হাওয়ায় ভেসে আসা হেমন্তকাল সবুজ-হলুদ রঙে আমনের মৌ মৌ সুবাস ছড়িয়ে দিগন্তজোড়া আনন্দ আহ্বানে কৃষক পরিবারের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন ফসলের বার্তা। সত্যিই হেমন্তে অগ্রহায়ণ মাসের আগমন বাঙালি কৃষক পরিবারে যেন সেই বার্তাই দেয়। পহেলা অগ্রহায়ণ বাংলার কৃষক পরিবারের নবান্নের প্রথম দিন হিসেবে দেশজুড়ে কৃষি বিভাগের উদ্যোগে পালিত হয় জাতীয় কৃষি দিবস। তবে অগ্রহায়ণ মাসে মাঠজুড়ে ধান কাটার ধুম পড়ে। ফসল তোলার কাজে ব্যস্ত সময় কাটে কৃষক-কৃষানির। মানব সমাজে জীবিকার প্রয়োজনে কৃষিপ্রথা চালু হওয়ার পর থেকেই নবান্ন উৎসব পালন হয়ে আসছে। তখন থেকেই বিভিন্ন কৃষ্টি মেনে ঘরে ফসল তোলার আনন্দে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম।

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্তকাল। অগ্রহায়ণের শেষ দিন পর্যন্ত বহাল থাকবে হেমন্তের আধিপত্য। হেমন্তের প্রকৃতি হিম হিম ভাব নিয়ে কুয়াশার শীতল আভা ছড়িয়ে দেয়। হেমন্ত হলো ষড়ঋতুর চতুর্থ ঋতু। শরৎকালের পর এই ঋতুর আগমন। শীতের আগাম আভাস দেয় বলে তাকে শীতের পূর্বাভাস ঋতুও বলা হয়। প্রকৃতির মায়ায় নানা রঙ-রূপের বৈচিত্র্য নিয়ে আগমন করে বলে গ্রাম-বাংলায় এই ঋতু উৎসবের ঋতু বলেও পরিচিত। প্রকৃতিতে শীতের আগমনি পূর্বাভাস পাওয়া যায় হেমন্তের শুরু থেকেই। কৃষকের কষ্টের সম্পদ ফসল তখন মাঠজুড়ে কাঁচাপাকা ধানের বর্ণিল অপরূপ সাজে কৃষকের মনে আনন্দের দোলা দেয়। এই শোভা দেখে কৃষকের মন আনন্দে নেচে ওঠে। বাড়ির আঙিনা-উঠোন পরিষ্কার করে সোনার ফসল ঘরে তোলার প্রস্তুতি নেয় কৃষক কৃষাণিরা। হেমন্তের বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ। বাড়ির আঙিনা নতুন ধানে ভরে ওঠে। কৃষক বধূ মনের আনন্দে ধান শুকোয়। প্রতি ঘর থেকে আসে ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ। বাড়ির চারপাশে লাউ, শিম, মুলা, বেগুনসহ সবজি গাছগুলো সতেজতায় প্রাণজাগায় প্রকৃতি সবুজ অঙ্গনে। ভোরের হাল্কা কুয়াশার পরশ, সকালের সোনারোদ, দুপুরের ঝকঝকে উচ্ছ্বল রুদ্দুর, বিকালে হিমেল আভা প্রকৃতির সবকিছুতে যেন আনন্দের নতুন বার্তা ভেসে বেড়ায়। এক সময় বাংলায় বছর শুরু হতো ধান উৎপাদনের ঋতু হেমন্ত দিয়ে। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধান পরিপক্ব হয়। এভাবেই হেমন্ত আসে কৃষকের দুয়ারে ফসলের হাসি নিয়ে। এ ঋতুতে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, কামিনী, হিমঝুরি, দেব কাঞ্চন, রাজ অশোক, ছাতিম, বকফুল ফোটে প্রকৃতিকে অনিন্দ্য রূপময়ী করে তোলে।

অগ্রহায়ণের প্রথম দিন- অগ্র অর্থ ‘প্রথম’ আর ‘হায়ণ’ অর্থ ‘মাস’। এক সময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। এ মাসটি বাঙালির সামাজিক জীবনে ঐতিহ্যবাহী, অসাম্প্রদায়িক বন্ধনে আবদ্ধ। যদিও আকাশ সংস্কৃতির হালআমলে অনেকটাই পাল্টে গেছে সেই অগ্রহায়ণের চিরাচরিত উৎসবের রীতি। এই পালন যেন ভুলতে বসেছে আধুনিকমনস্ক কৃষক সমাজও। তথাপি কৃষিনির্ভর গ্রামবাংলার সরল জীবনযাপনের প্রতীক এই নবান্ন উৎসব একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায়নি বাঙালির জীবন থেকে। বাদশা আকবরের সময়ে পহেলা অগ্রহায়ণকে (মধ্য নভেম্বর) বাংলা নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন সমস্ত দেশ এই শস্যে ছেয়ে যেতো। সে সময়ে বেশ জনপ্রিয় এবং ব্যাপক চাহিদা সম্পন্ন ফসল ছিলো আউশ। অগ্রহায়ণ এর কিছুটা আগে মানে কার্তিক মাসে আউশ শস্যটি রোপণ করা হতো যার ফলে, হেমন্ত কাল এসে পোঁছাতেই শস্যের মাঠ হলুদে ছেয়ে যেত। হলুদ ফসলের মাঠ দেখে কৃষকদের মুখে ফুটে উঠত তৃপ্তির হাসি। একারণেই সে সময়টিকে উৎসবে পরিণত করা হল, নাম দেওয়া হয় ‘নবান্ন উৎসব‘। নবান্ন উৎসব মানে ‘নতুন চাল বা অন্নের উৎসব‘। এই সময় ধান কেটে শুকিয়ে সিদ্ধ করে তৈরি করা হয় নানা ধরনের পিঠাপুলি, পায়েস। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যয় যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালন হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। ‘নবান্ন’ মানে ‘নতুন অন্ন’। বাংলাদেশে নবান্ন শুরু হয় আমন ধান কাটার পর। আমনের নতুন ধানের চালের প্রথম রান্না উপলক্ষকে কেন্দ্র করেই নবান্ন শব্দটির জনপ্রিয়তা। অঘ্রাণে নতুন ফসল পাকলে কৃষকরা ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালের এক কোণায় বেঁধে রাখেন। বাকি এই চালের পায়েসে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। এই নতুন চালের পায়েস দিয়ে মজজিদে দেওয়া হয় সিন্নি। এক সময় সাড়ম্বরে নবান্ন উদযাপন হতো। এই উৎসব মানুষের ভেতরে সমাদৃত ছিল অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে। কিন্তু কালের বিবর্তনে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব অনেকটা স্বকীয়তা হারিয়েছে।