দোষের কথা উঠলেই আমলার দোষ, পুলিশের দোষ কিংবা অন্যান্য সেক্টরের সরকারি চাকরিজীবীদের দোষগুলো যতভাবে আলোচিত হয়, যত প্রবলভাবে কথা বলা যায়, জনতার দোষ নিয়ে তত আলোচনা-সমালোচনায় কেউ মুখর হয় না। নতুন এক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি দাবি উঠেছে রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কারের। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শাসককে স্বৈরাচারে পরিণত করার, ফ্যাসিবাদ জন্ম হওয়ার যে ক্ষেত্রগুলো আছে সেখানে পরিবর্তনের দাবি জোড়ালোভাবেই উঠেছে।
পুলিশের দানবীয় কার্যকলাপ বন্ধে এবং আমলাদের জনগণের মালিক হয়ে ওঠার দৌরাত্ম্য থামানোর জন্যই এই আন্দোলন। তাছাড়া সরকারি চাকরিজীবীরা যে রাষ্ট্রের জনগণের সেবক, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়- সেসব কথা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য এই আন্দোলনে অধিষ্ঠিত সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। জনতার পক্ষ থেকে বিবেচনা করলে সব দোষ বিপক্ষের কিন্তু নিরপেক্ষভাবে দেখলে জনগণকে কি সাধু বলার সুযোগ আছে?
শত কিলোমিটার দূরে বসে সার্জেন্টের হাতে মোটরসাইকেলসহ আটক হয়েছে বলে যে আত্মীয় পুলিশ কর্মকর্তা তাকে ফোন দিয়ে ফেভার চাওয়া হয়। কাছের কিংবা দূরের যে আত্মীয় সরকারি কর্মকর্তা তার পরিচয়ে পরিচিত হতে বাঙালি সুখানুভব করে। কারো সাথে ক্ষমতাধার রাজনীতিবিদের সখ্যতা আছে শুনলে সুযোগসন্ধানীর চোখ চক চক করে ওঠে। সুপারিশ করার মতো আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-পরিচিত যাদের যা আছে তাদের থেকে সহায়তা নেওয়ার কৃপণতা কেউ করে না। তখন কোন প্রকার লজ্জাও ভর করে না। ডাক্তারের সিরিয়াল দেওয়ানো থেকে শুরু করে রেলের টিকিট কাটা, চাকরির জন্য সুপারিশ করানো থেকে শুরু করে মামলার তদবির- মোটকথা, স্বজনদের ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে যত ধরনের অবৈধ সুযোগ গ্রহণ করা যায়- তাতে কাছের ও দূরের পরিচিতজনরা ছাড়ে না। একজন মানুষের সুপারিশ করা অপছন্দের, কর্মক্ষেত্র তিনি সৎ হিসেবে পরিচিত কিংবা এসব করার ক্ষমতা আদৌ তার নাই- সেসব সত্ত্বেও লোকজন তার পিছু ছাড়ে না। বরং জোঁকের মতো লেগে থাকে। দেখবোনে বলে যদি না দেখে কিংবা সরাসরি না বলে ফিরিয়ে দেয় তবে তার দোষের আর অন্ত থাকে না। মানুষের নিন্দায় মানুষ এমন সব কথা ও অভিযোগ হাজির করতে পারে যা শুনে শয়তানও রীতিমতো লজ্জা পায়।
আমি অমুকের তমুক কিংবা তমুকের অমুক বলে কর্মক্ষেত্রে কিংবা সমাজ-রাষ্ট্রে বাড়তি সুযোগ নেয়া ও পাওয়া সহকর্মীরা কিংবা মানুষগুলো যখন নীতি কথা বলে তখন যেভাবে হাসি পায় তা চাপিয়ে রাখা মুশকিল। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যের কেউ না বরং বন্ধুর পরিচিতের একজন নিকটাত্মীয় ক্ষমতাধর- মানুষ তার দোহাই দিয়েও চলে। একজনের অধিকার আটকে আছে কিংবা মিথ্যা কোন অভিযোগে হয়রানি করা হচ্ছে- সেখানে সুপারিশ করার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। কিন্তু অন্যায় করবে, অবৈধ কাজে সম্মতি আদায় করবে কিংবা সততার শৃঙ্খল ভাঙবে- আর সেই কাজেও আত্মীয়-স্বজনকে ফোন দিয়ে মদদ চায়। প্রচণ্ড সৎ না হলে একজন মানুষ সরাসরি না বলতে পারে না। এই না বলতে না পারার মৌনতাকে পুঁজি করেও সুযোগবাদী লোকে ভাবে তাকে পক্ষে সম্মতি দিয়েছে।
কেউ একজন উচ্চপদে গেলে, ক্ষমতা পেলে কিংবা কিছু করে দেয়ার ক্ষমতা থাকলে মানুষ এমনভাবে ঘিরে ধরে যা সেবার ক্ষেত্রে সবার জন্যই ক্ষতিকর। স্বজনপ্রীতির উদ্ভব এভাবেই চক্ষু লজ্জায় শুরু হয় এবং দুর্নীতির বড় অংশে পরিণত হয়। দেশে থানা-আদালতে যত সংখ্যক মামলা-ফ্যাসাদ হয়, সেসবের অধিকাংশ ভুয়া। শুধু প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজের সন্তানকে হত্যা করে, গুম করে কিংবা আহত করে মামলা হয়েছে বলে বহুবার পত্রিকায় এসেছে। অন্যের জমিজমা দখল করতে মারামারি হয় এবং মামলাবাজি চলে। নিশ্চয়ই এসব মামলা রুজুতে থানা-পুলিশ প্ররোচিত করে না। তাছাড়া দ্রুত সেবা পাওয়ার মানসিকতা, যেকোন পথে স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে নামা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় খুন-জখম এসবে আমলারাও উৎসাহিত করে না। ব্যবসায় সিন্ডিকেট, অবৈধ মজুত, বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা কিংবা গুজব ছড়ানোয় জনগণ ওস্তাদ। কাজেই একপাক্ষিক দোষ বর্ণনা করে শুধু চাকরিজীবী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে দোষারোপ করলে সেটা ন্যায়সঙ্গত হবে না। বরং ভোট না হওয়া, অবৈধভাবে কেউ দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা, সরকারি কাজে কন্ট্রাক্টটরদের ফাঁকি দেওয়া- এসবের পেছনে জনগণের মৌনতাও কম দায়ী নয়। যতক্ষণে নিজে আক্রান্ত না হবো, ততক্ষণে অন্যায়ে বিপক্ষে না বলা আমাদের চরিত্রের চর্চায় পরিণত হয়েছে। সবার পাশে সবার না থাকাতে, না দাঁড়ানোতে আমাদের ঐক্যে ফাটল ধরেছে এবং জুলুমবাজরা সুযোগ পাচ্ছে। শাসকের স্বৈরাচার হয়ে ওঠায়, পুলিশের চরম ক্ষমতা পাওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর যথেচ্ছাচার আচরণে জনগণের সয়ে যাওয়া মানসিকতাও সমানভাবে দায়ী। ভোট প্রদানের সময় প্রার্থীদের কাছে ২০০ থেকে ৪০০ টাকায় ভোট বিক্রি করা, সরকারি সাহায্য অন্যায়ভাবে কুক্ষিগত করার জন্য স্থানীয় সরকারের সদস্যদের কাছে কাকুতি-মিনতি করা কিংবা ন্যায়-অন্যায় বিচার না করে হুজুগে কোন পক্ষের অন্ধ সমর্থন করার কারণে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।
জাতির সামনে সংস্কারের যে সুযোগ এসেছে তা হাতছাড়া করলে সেটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। কোন পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে পরবর্তী ক্ষমতাশীনরাও পূর্ববর্তীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। জাতির ভাগ্য আর বদলাবে না।