বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতীয় হস্তক্ষেপ কাম্য নয়

সামিউ রিকাবদার রাফিউ

প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সবসময় দেখা যায় বাংলাদেশের নানান ইস্যুতে ভারতের নাম জড়িত হয় এবং বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে ভারতের একটি প্রভাব থাকে। বিগত বছরগুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা বলতেই পারি ভারত শুধু রাজনীতিতে প্রভাব নয় বরং বাংলাদেশের ক্ষমতা নির্ধারণ করতে নিজেদের বল প্রয়োগ করে থাকে এবং তারা সফলভাবেই অতীতে তা করে গিয়েছে। যখন ভিন্ন একটি রাষ্ট্র অন্য একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে নির্ধারণ করতে চাইবে, তখন কি তাকে শুধুই প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে দেখার সুযোগ থাকে? ‘না’ ভারত কখনোই বাংলাদেশকে তাদের প্রতিবেশী একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে চিন্তা করতে চায় না বরং তারা বাংলাদেশের উপর নিজেদের একটি অঙ্গরাজ্যের মতোই প্রভাব বিস্তার করতে চায়। গত বছর ভারতের সংসদ ভবনে অখণ্ড ভারতের মানচিত্রে বাংলাদেশকে তাদের অংশ দেখানোর কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। তাছাড়া ভারত-বাংলাদেশ পানিবণ্টন এবং বাঁধ সমস্যার কথা তো সবারই জানা। সেখানেও দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে থাকা পানিবণ্টন এবং বাঁধ নির্মাণের আন্তর্জাতিক আইন কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করে না ভারত।

ভারতের এই প্রভুত্বের বেশ কিছু কারণ রয়েছে। ভারত বাংলাদেশের উপর তাদের প্রভুত্বতার সর্বোচ্চ সীমায় ছিল বিগত আওয়ামী সরকারের সময়। এ সময়ে ভারত সম্পর্কে যে দুটি কথা আমরা সবসময় শুনে এসেছি তা হচ্ছে- বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে ভারতের অবদান এবং মানচিত্রে বাংলাদেশের তিনদিকে ভারতের মতো একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের অবস্থান। বহুল ব্যবহৃত দুটি কথাই অত্যন্ত অর্থ বহুল, লক্ষ্য করলে দেখা যায় প্রথম কথাটি অর্থাৎ স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান এটি ব্যবহার করা হতো সাধারণ মানুষের মনে ভারত সম্পর্কে একটি দুর্বলতা কাজ করাতে আবার উল্টো দিকে দ্বিতীয় কথাটি অর্থাৎ মানচিত্রে বাংলাদেশের তিনদিকে ভারতের অবস্থান এটি ব্যবহার করা হতো মূলত সাধারণ মানুষের মনে ভারত সম্পর্কে একটি ভয় বা আতঙ্ক হিসেবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কেন ভারতের এই প্রভুত্ব মাথা পেতে সয়ে যেতো এবং তাদের স্বার্থ হাসিলের কাজ করত তা নিশ্চয়ই আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই, এক কথায় বলে দিলে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য। বিগত সরকারের আমলে ভারত ইস্যুতে শোনা সেই বহুল ব্যবহৃত দুটি কথা কতটুকু সত্য? এতে কোনো সন্দেহ নেই যে ভারত ইস্যুতে বলা দুটি কথাই শতভাগ সত্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান কখনোই ভোলার নয়। তবে এ অংশে আমি মনে করিয়ে দিতে চাই যে বাংলাদেশের ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ভারত আমাদের যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়ে ছিল বিজয়ের ১৩ দিন আগে অর্থাৎ ডিসেম্বরের ৩ তারিখ। এটি যদিও কৌশলগত কারণ তবে বলার উদ্দেশ্য এটি স্মরণ করিয়ে দেয়া যে ভারতের সাহায্য ছাড়া আমাদের যুদ্ধ করা কিংবা আমাদের স্বাধীনতা সম্ভব ছিল না এ কথা কখনোই বলা যাবে নাহ। হয়তো ৯ মাস নয়, ৯ বছর লাগতে পারত কারণ দুই পাকিস্তানের সৃষ্টিই হয়েছিল বিভক্তির জন্য।

আমাদের হয়ে যুদ্ধ করা ভারতীয় সেনাদের কথা আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করব আবার স্বাধীনতার পর ভারতীয় সেনাদের লুটতরাজের কথা মুছে ফেলা যাবে না একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে ভারত প্রায় ২০০ কোটি টাকার সম্পদ লুট করে নিয়েছিল। আর দ্বিতীয় কথাটি মানচিত্রের অবস্থান। অস্বীকার কিংবা বদলে ফেলার কোনো সুযোগ নেই যে ভারত আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী আর এটিই ছিল আওয়ামী সরকারের আরও একটি হাতিয়ার যা দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখানো যেতো। প্রায় প্রতিটি বাংলাদেশি একটি কথা জীবনে একবার হলেও শুনেছেন তা হচ্ছে, ভারত চাইলে যেকোনো সময় আমাদের দখল করে নিতে পারে। কারণ ভারত বাংলাদেশ থেকে সামরিক দিক থেকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। তারা উদাহরণ হিসেবে সিকিম আর হায়দ্রাবাদকে দেখাত। আচ্ছা জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত কোনো দেশকে কী এতো সহজেই দখল করে রাখা যায়? এমন কোনো ইতিহাস কী আছে যে জাতিসংঘের সদস্য কোনো দেশকে অন্য একটি দেশ যে কি না, জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য নয়- সে দখল করে রেখেছে? ভারত কিন্তু জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য নয় আর হতেও পারবে না, সুতরাং সিকিম আর হায়দ্রাবাদের প্রসঙ্গ এখানে খাটবে না কারণ এরা জাতিসংঘের সদস্য ছিল না। আর যুদ্ধ, যুদ্ধ কী শুধু দুটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে? পাকিস্তানও সামরিক দিক থেকে অনেক এগিয়ে ছিল না? ভারত বাংলাদেশের সাথে যুদ্ধ করতে চাইলেও সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ করতে পারবে না তার পাশে পাকিস্তান এবং চীন রয়েছে, তাদের জন্য রিজার্ভ শক্তি রেখে এমনকি অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহীদের জন্য রিজার্ভ শক্তি রেখে বর্তমান বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আমার দৃষ্টিতে সম্ভব হবে না। এমন যুদ্ধে ভারতের জন্য প্রাপ্তির চেয়ে হারানোর পরিমাণ বেশি হবে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার এবং বেগম জিয়ার শাসনামলে অনেক সময় ভারতের সাথে বৈরী সম্পর্ক দেখা গিয়েছে, তখন কি বাংলাদেশকে দখল করে নিয়েছিল ভারত?

আসলে এসব ছিল আমাদের গোলাম করে রাখার পাঁয়তারা। তারা সিকিমের উদাহরণ দিলেও বাংলাদেশের ‘লেন্দুক দর্জি’ শেখ হাসিনাকে নিয়ে চুপ থাকত। লেন্দুক দর্জি যেভাবে সিকিমকে ভারতের হাতে তুলে দেয়, হাসিনাও তাই করতে চেয়েছিল। প্রেক্ষাপট বদলে গিয়েছে, এই নতুন আগামীর বাংলাদেশকে ভারতের আগ্রাসনমুক্ত দেখতে চাইলে একজন সৎ সাহসী রাষ্ট্রনায়ক প্রয়োজন। রাষ্ট্রনায়ক এমন হতে হবে, যার সাহসের উৎস হবে জনগণ, জনগণের সমর্থন না থাকলে সে যেই রাষ্ট্র পরিচালনা করুক, তাকে হাসিনার মতো ভারতনির্ভর হয়ে থাকতে হবে। একটি স্বাধীন দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি সকল দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাই কারোর হুকুমদারি চাই না।

লেখক : শিক্ষার্থী