মানুষের জীবনবোধের সঙ্গে নৈতিক মূল্যবোধের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে যদিও মানুষ প্রাণী সে পশু নয়। তাইতো সমাজ বিজ্ঞানী ডেভিড পোপেনোরের মতে, ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক, কাঙ্ক্ষিত-অনাকক্সিক্ষত সমাজের সদস্যদের যে ধারণা তার নামই মূল্যবোধ। মূল্যবোধের অবক্ষয় এখন চারিদিকে প্রকট হয়েছে। মূল্যবোধ বলতে সকলের মনে একটা ধারণা যদিও সুস্পষ্টভাবে কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে মূল্যবোধ সাধারণত আচার-আচরণের এক ধরনের মানববোধ, কিছু আদর্শগত সমষ্টি যার দ্বারা মানুষ যেকোনও কাজের ভালো-মন্দ, শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা যাচাই করে অগ্রসর হতে পারে। মূল্যবোধের শিক্ষা বলতে সত্যবাদিতা, অহিংসা, নির্ভিকতা, সামাজিক সচেতনতা এবং দায়িত্ববোধ, সেবা প্রমুখ বিষয়ের ওপর জোর দেয়া হয়। অর্থাৎ মূল্যবোধ কেবলমাত্র ব্যক্তিগত ভালো-মন্দ বিচার করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়-এর সামাজিক দিকগুলোও আছে যেগুলো খুব প্রয়োজনীয়। মূল্যবোধ হলো মানুষ তার নিজের এবং সমাজের জন্য এক বিশেষ কোড অব কনডাক্ট যার দ্বারা একজন মানুষ অথবা সমাজ উত্তরণের দিকে অগ্রসর হতে পারে।
মূল্যবোধ সবসময় একটা জায়গায় থেমে থাকে না। World Value Survey মূল্যবোধের ওপর বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। এই সংস্থার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বিভিন্ন শাখার বিজ্ঞানীরাও। এর এক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে যে মূল্যবোধ বা ভ্যালু বলা বস্তুটি কখনও এক জায়গায় স্থির থাকে না। সমাজ পরিবর্তন, বিবর্তনের সঙ্গে মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটে। World Value Survey -এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী যখনই কোনো দেশের ঔদ্যোগিক বিকাশ এবং তার উত্তর ঔদ্যোগিক জ্ঞান সমাজের দিকে যতই এগোচ্ছে ততই ওই দেশের পরস্পরাগত মূল্যবোধ যেমন- পিতামাতা ও সন্তানের মধ্যে বন্ধন, পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক, ধর্মীয় গুরুত্ব, অন্যান্য এসবের প্রতি টান কমছে। হবে হ্যাঁ, ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তিবাদী মূলূবোধের মান বাড়ছে। এই পরস্পরাগত পারিবারিক সম্পর্ক বা ধর্মীয় ক্ষেত্রে যে মূল্যবোধের অবক্ষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে, এর ফলে মানুষের মধ্যে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য কতটা অবনতি হয়েছে?
WVS -এর প্রতিবেদনে বলা হয় ২০০৮-২০১৬ সন পর্যন্ত মানুষের সুখ-শান্তি এবং জীবনের সন্তুষ্টি বেড়েছে। এ নৈতিকতা ও মূল্যবোধের নিরিখে সুখী দেশের তালিকা প্রস্তুত করে। সেখানে আমরা দেখতে পাই সেই সুখী দেশগুলোর মধ্যে শান্তি, শৃঙ্খলা, সন্তুষ্টি, সৌজন্যতা, সহনশীলতা, প্রগতিশীলতা বিদ্যমান। তাহলে আমরা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে সক্ষম হচ্ছি, এই ভেবে যে মূল্যবোধ কোনো অচল-অটল বস্তু নয়। সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু এখন কথা হলো- আসলে মূল্যবোধের আধার কি? ইহা কি এমনিতেই গড়ে উঠে না? এর কোনও সামাজিক প্রেক্ষাপট আছে? আমরা নিশ্চয়ই সেই উলঙ্গ রাজার কথা জানি। যেখানে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেছেন ‘সবাই দেখছে যে রাস্তা উলঙ্গ, তবুও সবাই হাততালি দিচ্ছে। সবাই চেঁচিয়ে বলছে, শাবাশ শাবাশ।’ গল্পটা সবাই জানি। কিন্তু সেই গল্পের ভেতর শুধু প্রশান্তি বাক্য উচ্চারণ কিছু আপদামস্তক ভিতু, ফাঁকিবাজ অথবা নির্বোধ স্তাবক ছিল না। একটা শিশুও ছিল। সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটা শিশু। এখন প্রশ্ন হলো- রাজসভায় যারা মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের মূল্যবোধের অবস্থান কোথায়? মূল্যবোধ আসলে কোনও বিমূর্ত বস্তু নয়। মূল্যবোধ সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি দ্বারা প্রভাবিত। আজকাল বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের মতবাদের প্রচার চলছে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মতবাদ প্রচারে বিভিন্ন চিন্তা একত্রে প্রসারিত করার চেষ্টায়। এক দলতো জোরপূর্বক তার মূল্যবোধ চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টায় অন্য দলের উপর। বিশ্বের সমস্ত ঘটনাবলি মানুষের নখদর্পণে। বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক সফলতা আর নিত্যনতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে সবকিছু আজ মানুষের সাধ্যে তা সত্ত্বেও পৃথিবী হয়ে পড়েছে হিংস্র, অশান্ত আর নৈরাজ্যের ঠাঁই। বর্তমান সমাজে বস্তুগত সমৃদ্ধির পরও এক বিরাট সংখ্যক মানুষের মধ্যে দেখা যায় অনৈতিকতা, সীমাহীন দুর্নীতি, ছলচাতুরী, চূড়ান্ত মিথ্যাচার। ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতার শীর্ষে থাকাটা স্থির করে নিয়েছে মানুষ। এমন এক সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে যেখানে প্রগতিশীল, ঔদ্যোগিক ধ্যান ধারণার বিপরীতে মৌলবাদী, একত্ববাদী ধ্যান-ধারণার বিকাশ। সৃষ্টি হয়েছে ভয়-শংকা-বিদ্বেষের পরিস্থিতি। ধর্মীয় মৌলবাদ এবং তজ্জনিত হিংস্রতায় সমাজ এক অস্থির সময়ে বিরাজ করছে। এটা সমগ্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমরা এখন ঔদ্যোগিক সভ্যতার দিকে এগোচ্ছি। উত্তর-ঔদ্যাগিক স্তর পেতে এখনও বাকি। এখনও আমরা অবৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণায় আচ্ছন্ন। সে সঙ্গে আমাদের ঠেলা হচ্ছে- ধর্ম-জাত-পাত, অসহিষ্ণুতা, নিম্নগামী যুক্তি তর্কের পরিবেশে। তাইতো এই দ্রোহকাল ভুলে গেছি সৌজন্য বিনিময়। তবে এইভাবে কি মূল্যবোধের উত্তরণ সম্ভব, মূল্যবোধের জন্ম সমাজেই হতে হবে। বিজ্ঞানী ব্রাউনের মতে ‘যদি পৃথিবীতে নৈতিকতার মান প্রযুক্তিগত কলাকৌশলের বৈপ্লবিক অগ্রগতির সঙ্গে অগ্রসর না হয়, তাহলে আমরা নিঃশেষ হয়ে যাব। শিক্ষার বিস্তারে বিজ্ঞানের চমকপ্রদ আবিষ্কারের ফলে প্রযুক্তিগত বিরাট প্রসার ঘটছে, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে নৈতিকতার মান অগ্রসর হয়নি মোটেই। মূল্যবোধের উত্তরণ ঘটছে না। তবে সংকীর্ণ চিন্তার পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে হিংসা, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি। এমন এক প্রচলিত সমাজ এর পরিবর্তনের দায়ভার কে নেবে? এর জন্য আমাদের শিক্ষক-অভিভাবক, ধর্মীয় নেতাদের সমান অংশীদারিত্বে পরিবর্তন সম্ভব। কারণ আগত ভবিষ্যৎ সমাজের মূল্যবোধ রক্ষার দায়িত্ব বর্তমান প্রজন্মের। অর্থাৎ আজকের যেসকল স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাদেরই। সমাজে শিক্ষকের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে যদি লক্ষ্য করি, তবে দেখা যায় কোন এক আদর্শ শিক্ষকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পরিচর্যায় আমরা আজ এতটা এগিয়েছি। তাদের ব্যক্তিত্ব, কথাবার্তা, চিন্তাধারা, ভাবনায় আমরা মুগ্ধ। নৈতিক শিক্ষা বা বিদ্যায়তনিক শিক্ষায় যদিও তাদের মতো অগ্রসর হতে পারিনি তবে আমাদের ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে কতটা ফলপ্রসূ তা নিশ্চয় আমরা বুঝতে পারি। কারণ ছাত্র জীবনে একটা ছেলে বা মেয়ে ঘরের সব থেকে বেশি সময় কাটায় স্কুলে। সেখানে একে অপরের সঙ্গে মেলামেশা, সহপাঠীদের সঙ্গে সহমর্মিতা, গুরুজনদের প্রতি ভক্তি, ছোটদের আদর, সত্যের প্রতি নিষ্ঠা, মুক্ত চিন্তার ক্ষমতা, বিজ্ঞান-মনস্কতা এসবের মূল্যবোধের ধারণা ও অভ্যাস সেখানেই গড়ে উঠে। আর এই অভ্যাস গড়ে তোলার মূল নায়ক হলেন শিক্ষক।
শিক্ষকই হচ্ছেন- Role Model শিক্ষক। একজন শিক্ষক পুঁথিগত জ্ঞানদানের সঙ্গে একজন পথপ্রদর্শক, সহানুভূতিশীল, বন্ধুভাবাপন্ন ব্যক্তি। যিনি ছাত্রছাত্রীদের মূল্যবোধ ও নৈতিকতার নিঃশুল্ক জ্ঞান দিয়ে থাকেন। সেইক্ষেত্রে একজন শিক্ষক শুধু বিদালয়ের শিক্ষক নন, সমাজেরও। তাই শিক্ষকের দায়িত্ব হল যতটুকু জানা, ততটুকুই সঠিকভাবে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করা। মূল্যবোধ ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করা। মূল্যবোধ ও নৈতিকতার নিরিখে জাপান বেশ এগিয়ে। জাপানে একটি কথা আছে একজন শিক্ষক ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করার জন্য, সৎ পথে চলার জন্য, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার নিরিখে সামাজ জীবনে সুস্থ মস্তিষ্কে আগ্রসর হওয়ার জন্য প্রথমে নিজেকে সেভাবে গড়তে হবে। তাহলে তিনি ছাত্রছাত্রীর আদর্শ হিসেবে পরিগণিত এবং তার প্রদত্ত শিক্ষাকে ছাত্রছাত্রীরা চিরদিন স্মরণ রাখবে।
সেই একইভাবে আমরা যারা অভিভাবক আছি তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একটা শিশুর প্রথম শিক্ষা তার ঘর থেকেই শুরু, চোখ খোলার পর ঘরকেই সে আপন করে নেয়। একটি শিশু প্রথমেই তার বাবা-মার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে বড় হয়। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কি ধরনের ভূমিকা পালন করতে হয়, সততা, তাদের বিশ্বাস, আচার-ব্যবহার সবকিছুই বাবা-মায়ের কাছ থেকে শিখে। অভিভাবকদের মধ্যে যদি অসদাচরণ, অযৌক্তিক চিন্তা-চেতনা, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার দেখা যায়, তবে সেই শিশুটিও মানসিকভাবে সেইভাবেই গড়ে উঠে। সমাজে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রয়োজন আছে, ভালোবাসা, সৎ-অসৎ বিচারের প্রয়োজন আছে তবে তার বীজ ঘরেই রোপণ করতে হবে এবং এর মূল হতে হবে বাবা-মা দুজনেই। মানবসমাজ সেই প্রাচীনকাল থেকেই মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। আকারে ক্ষুদ্র দ্বীপ হলেও নৈতিকতার জন্য ইংরেজরা পুরো বিশ্বজয় করেছিল। অনৈতিক কাজ দ্বারা ক্ষমতাসীন হলেও ধ্বংস অনিবার্য। আলোচনার পরিসমাপ্তিতে এটুকু বলা যায় যে, আমরা দিন দিন যেভাবে নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে হারিয়ে ফেলছি তাতে বর্তমান সমাজ রোগাক্রান্ত। পারস্পরিক মমত্ববোধ, প্রেম, সৌজন্যতা এসব আমরা হারিয়ে ফেলছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে, যেখানে একটা সুস্থ সমাজ উপহার দিতে পারি। নীতি-ঔচিত্যবোধ, সামাজিক ন্যায় বিচার, সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহিষ্ণুতা, শ্রমের মর্যাদা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ, রাষ্ট্রীয় আনুগত্য চর্চার মাধমে উন্নত, সভ্য ও কলুষমুক্ত সমাজ গড়া সম্ভব। সঠিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ চর্চাই পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব। নাকি ভুল বললাম?
সাংবাদিক-কলামিস্ট