দ্রুত সংস্কার, দ্রুত নির্বাচনই কাম্য
প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সরকারের ওপর ছাত্র-জনতার প্রত্যাশার কোনো শেষ নেই। পতিত ও বিতাড়িত স্বৈরাচারী সরকার দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচার, প্রশাসন, পুলিশ এবং রাষ্ট্রীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। এসব পুনর্গঠন, সংস্কার ও নববিন্যাস সাধনের দায়িত্ব বর্তেছে এ সরকারের ওপর। এইসঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার স্বাভাবিক ও দৈনন্দিন দায়িত্বও অর্পিত হয়েছে। একটি স্বপ্ন ও সুনির্দিষ্ট কিছু আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছাত্র-জনতা রক্তাক্ত আন্দোলন ও অভ্যুত্থান ঘটিয়ে স্বৈরাচারকে বিদায় করেছে। সেই স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন সরকারের অপরিহার্য কর্তব্য বলেই গণ্য। ১০০ দিনে সরকারের যতটা সাফল্য আশা করা হয়েছিল, ততটা আসেনি। এর একটা কারণ সম্ভবত এই, প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টামণ্ডলীর সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা কম। দ্বিতীয়ত, পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের, যারা সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও পর্যায়ে বিদ্যমান রয়েছে, তাদের অসহযোগিতায় সরকার পদে পদে বাধাগ্রস্ত ও বিব্রত হয়েছে; এখনো হচ্ছে। পাশাপাশি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং ভারতের মোদি সরকার অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। এই বিবিধ কারণ ছাড়াও আরো নানা কারণ রয়েছে, যার মধ্যে সরকারের কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে অপারগতা এবং কাজের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার কথা উল্লেখ করা যায়। অনেকের মতে, সরকার ব্যর্থতার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ, সরকার সর্বোতভাবে সফল হোক, এটাই গণমানুষ ও রাজনৈতিক দলসমূহের কামনা। কারণ, সরকার ব্যর্থ হলে আমরা সবাই ব্যর্থ হবো। ছাত্র-জনতার আন্দোলন, অভ্যুত্থান, রক্তদান, অঙ্গদান সবকিছু ব্যর্থ হবে। সরকার ব্যর্থ হওয়া মানে ছাত্র-জনতার আন্দোলন-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থাকা এবং স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসন ফিরে আসার পথ প্রশস্ত হাওয়া, যা কারো কস্বিনকালেই কাম্য হতে পারে না। অতএব, জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থেই অন্তর্বর্তী সরকারকে সফল হতে হবে। তাকে সফল করতে হবে। দলমত নির্বিশেষে সকলকেই সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতা করতে হবে। সরকারেরও সফল হওয়ার প্রতিজ্ঞা থাকতে হবে, যা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরকারকে আগ্রধিকার নির্বাচন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দৃঢ়তা, সমন্বয়হীনতা পরিহার ইত্যাদি করতে হবে। সবক্ষেত্রে সততা, জবাবদিহি, উদ্যাম, সৃজনশীলতা ও কর্মতৎপরতার পরিচয় দিতে হবে।
সরকারের সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার মাত্রাই বেশি বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। এজন্য জনমনে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। আন্দোলন-অভ্যুত্থানের সময় যারা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন, তাদের খোঁজ-খবর নেয়া এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা ছিল সরকারের প্রধান কর্তব্য। সরকার এ ক্ষেত্রে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। শহীদ পরিবারের সাহায্য, আহতদের চিকিৎসা ইত্যাদি কোনো কিছুই ঠিকমত হয়নি। পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের প্রশাসনসহ সকল ক্ষেত্র থেকে বিদায় করে দেয়া জরুরি হলেও তারা অনেকেই বহাল তবিয়তে আছে, সরকারের বিরুদ্ধে তলে তলে কাজ করছে। অথচ, সরকার তাদের বিদায় করতে পারছে না। আন্দোলন-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার হতাহতের ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের দ্রুত বিচার ও শাস্তির বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রেও সরকারের তেমন কোনো গা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এখনও ঘাতকদের চিহ্নিত ও তালিকা করাই সম্ভব হয়নি। প্রধান উপদেষ্টা একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা সুরক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বাস্তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিই ঘটেছে। পণ্যমূল্য, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে নিম্নআয়ের মানুষ তো বটেই মধ্যআয়ের মানুষের জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। আমদানি শুল্কহ্রাসসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও বাজারে তার প্রতিফলন নেই। সিন্ডিকেট সক্রিয়। সরকার তা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। স্বৈরাচারের গোটা শাসনে দুর্নীতি ও লুটপাট ছিল খোলাখুলি। বিভিন্ন সেক্টরে যে নৈরাজ্য, অর্থনীতির বেহাল, তার জন্য দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচার দায়ী। শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের একটা চেষ্টা দেখা যাচ্ছে বটে; কিন্তু যাদের দ্বারা ও মাধ্যমে অর্থপাচার হয়েছে সেই ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। স্বৈরশাসনে ব্যাংক খাতসহ অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। ভেঙেপড়া অর্থনীতি খাড়া করার চেষ্টা করছেন অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর প্রমুখ। এতে কিছু সাফল্য এসেছে। রিজার্ভ বেড়েছে, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। তবে বিনিয়োগের কোনো সুখবর নেই। দেশি-বিদেশি কোনো বিনিয়োগই হচ্ছে না। এফডিআই গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও বিনিয়োগের আশ্বাস নেই বললেই চলে। বিনিয়োগ না হলে শিল্পায়ন, উৎপাদন, রফতানি, কর্মসংস্থান- কোনোটাই বাড়বে না। এদিকে নজর দেয়া অত্যাবশ্যক হলেও কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকার, যদি তা হয় দুর্বল, অদক্ষ, অগ্রাধিকার নির্ধারণে অপারগ, তবে তার কাছ থেকে প্রত্যাশার অনেক কিছুই পাওয়া সম্ভব হয় না।
এই সরকারের প্রকৃতি অন্তর্বর্তীকালীন। অর্থাৎ সাময়িক সরকার। একটি নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত এ সরকার দায়িত্ব পালন করবে। এ সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো, একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এজন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করাও তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যেহেতু পতিত স্বৈরাচারী সরকার সরকারের যাবতীয় অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা বিনাশ ও অকার্যকর করে গেছে, সুতরাং সেগুলো সংস্কার ও কর্মক্ষম করা সরকারের দায়িত্বের অন্তর্গত। এরইমধ্যে সরকারের তরফে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। কতদিনে সংস্কার শেষ হবে, বলার উপায় নেই। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যথা শিগগিরই সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেয়া হবে। সরকারের কথা অনুযায়ী, নির্বাচন আটকে থাকছে সংস্কারের ওপর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতে, সংস্কারের জন্য যত সময় লাগুক, দিতে হবে। ওদিকে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচন দাবি করছে। সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ ও মতানৈক্যের আভাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। এমতাবস্থায়, সরকারের উচিত হবে যতটা প্রয়োজন সংস্কার দ্রুত করা এবং নির্বাচন দেয়া। সংস্কারের কাজ বাকি থাকলে নির্বাচিত সরকারই তা করবে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ক্রাইসিস গ্রুপ এক প্রতিবেদনে বলেছে, নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ১৮ মাসের বেশি সময় নেয়া উচিত হবে না। সংস্কারের প্রসঙ্গে বলেছে, সংস্কার এগিয়ে নিতে সরকারকে রাজনৈতিক ঐকমত্য বজায় রাখতে হবে। ওদিকে দ্য ইকোনমিস্ট তার এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইউনূস সরকারের উচিত নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনের টাইম ফ্রেম ঘোষণার জন্য দাবি জানিয়েছে। আমরা আশা করবো, সার্বিক দিক বিবেচনা করে সরকার দ্রুত নির্বাচনের সময় ঘোষণা করবে।