আজারবাইজানের বাকুতে চলা বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনকে ঘিরে একদিকে আশা অন্যদিকে আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট মহলের। আশার কথা হচ্ছে এই সম্মেলনে জলবায়ু ঝুঁকি নিরসনে গঠিত ‘লস এ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’ এ অর্থায়নের পরিমাণ বাড়বে। এবং জীবাষ্ম জ্বালানির ব্যবহার ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনতে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাবে। পাশাপাশি ২০১৪তে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নে ইতিবাচক অবস্থানে আসবে বিশ্ব। অন্যদিকে আশঙ্কা হচ্ছে বায়ুমন্ডলকে উত্তপ্ত করতে দায়ী কার্বন নিসরনকারি অন্যতম দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কার্বন নিঃসরণ কমাতে সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতিবাচক অবস্থান নিয়ে। এমনি এক দ্বৈত রথে চড়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী আধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস কর্তৃক সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্য এবং সাইড লাইনে বিভিন্ন ফোরামে প্রদত্ত বক্তব্য এবং তার অবস্থায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, জলবায়ু অ্যাক্টিভিস্ট, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম সমূহকে আকৃষ্ট করেছে। এবারের সম্মেলনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি ছিল বাংলাদেশের ভূমিকা, অবস্থানের প্রতি। আপাতত দৃষ্টিতে এই সম্মেলনে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের জনগণ, জলবায়ু অ্যাক্টিভিস্ট, নাগরিক সমাজের জন্য ‘অন্যতম অর্জন’। বিশেষ করে পৃথিবীকে জলবায়ু বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর উপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তাতে তাৎক্ষণিক বিশ্ব নেতৃবৃন্দের আকুণ্ঠ সমর্থন এবং এই বক্তব্যের জন্য মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানান। আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে কপ-২৯ এর ওয়ার্ল্ড লিডার্স ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটের উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তৃতায় বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বেঁচে থাকার জন্য আমাদের আরেকটি সংস্কৃতি গঠন করতে হবে। একটি ভিন্ন জীবনধারার উপর ভিত্তি করে আরেকটি পাল্টা সংস্কৃতি গড়তে হবে। এটি হবে শূন্য বর্জ্যরে উপর ভিত্তি করে। এ সংস্কৃতি নিত্যপণ্যের ব্যবহারকে সীমিত করবে, কোনো বর্জ্য অবশিষ্ট রাখবে না।’ এই জীবনযাত্রাও হবে শূন্য কার্বনের উপর ভিত্তি করে, যেখানে কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি থাকবে না, শুধু নবায়নযোগ্য শক্তি থাকবে। এতে এমন একটি অর্থনীতি হবে, যা প্রাথমিকভাবে সামাজিক ব্যবসার মতো ব্যক্তিগত পর্যায়ে শূন্য মুনাফার উপর ভিত্তি করে তৈরি হবে। সামাজিক ব্যবসাকে সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের জন্য একটি অলাভজনক ব্যবসা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে তিনি বলেন, সামাজিক ব্যবসার একটি বিশাল অংশ পরিবেশ ও মানবজাতির সুরক্ষায় মনোযোগ দেবে। অন্যদিকে, তিনি বলেছেন ‘সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের জীবন কেবল সুরক্ষিতই হবে না, গুণগতভাবে উন্নত হবে। এটি যুবকদের জন্য উদ্যোক্তা হওয়ার পথ সহজতর করবে। উদ্যোক্তা হওয়ার নতুন শিক্ষার মাধ্যমে তরুণেরা প্রস্তুত হবে। চাকরিপ্রার্থী তৈরির শিক্ষা উদ্যোক্তা-কেন্দ্রিক শিক্ষা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে।’ পরিবেশের সুরক্ষার জন্য একটি নতুন জীবনধারার প্রয়োজন, উল্লেখ করে নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী বলেন, নতুন জীবনধারা চাপিয়ে দেয়া হবে না, পছন্দ অনুযায়ী বেছে নিতে হবে। তরুণরা সেই জীবনধারাকে পছন্দ হিসেবে বেছে নেবে। প্রতিটি যুবক তিন শূন্যভিত্তিক ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে উঠবে। এগুলো হচ্ছে শূন্য নেট কার্বন নির্গমন, শুধু সামাজিক ব্যবসা গড়ে তোলার মাধ্যমে শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ ও নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে পরিণত করার মাধ্যমে শূন্য বেকারত্ব। ‘প্রত্যেক মানুষ তিন শূন্যভিত্তিক ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে উঠবে এবং সারা জীবন তিন শূন্যভিত্তিক ব্যক্তি হিসেবে থাকবে। এটি নতুন সভ্যতা গড়ে তুলবে।’ তিনি বলেন, ‘এটি করতে আমাদের যা করতে হবে, তা হলো এ গ্রহের নিরাপত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি নতুন জীবনধারা গ্রহণ করা, যেখানে সবাই বসবাস করে। আজকের তরুণ প্রজন্ম বাকিটা করবে। তারা তাদের এই গ্রহকে ভালোবাসে।’ ড. ইউনূস বলেন, ‘আশা করি, আপনারা এই স্বপ্ন দেখায় আমার সঙ্গে যোগ দেবেন। আমরা যদি একসঙ্গে স্বপ্ন দেখি, তবে তা সম্ভব হবে।’ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জলবায়ু সংকট তীব্রতর হচ্ছে এবং সে কারণে মানবসভ্যতা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মানুষ আত্মবিধ্বংসী মূল্যবোধের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। আত্মরক্ষাত্মক ও আত্মশক্তিবর্ধক একটি নতুন সভ্যতার ভিত্তি স্থাপনের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক, আর্থিক ও যুবশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। আমরা এই গ্রহের মানব সমাজ এই গ্রহের ধ্বংসের কারণ। তিনি বলেন, মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে এটি করছে এবং তারা এমন একটি জীবনধারা বেছে নিয়েছে, যা পরিবেশের বিরুদ্ধে কাজ করে। তারা একে একটি অর্থনৈতিক কাঠামো দিয়ে ন্যায্যতা দেয়, যা এই গ্রহব্যবস্থার মতো প্রাকৃতিক হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে অপর এক অনুষ্ঠানে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘অর্থনৈতিক কাঠামোটি সীমাহীন খরচের উপর ভিত্তি করে চলছে। আপনি যত বেশি ব্যবহার করবেন, তত বেশি প্রবৃদ্ধি পাবেন। যত বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করবেন, তত বেশি অর্থ উপার্জন করবেন।’ জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় এবং পৃথিবী ও মানুষের জন্য কল্যাণকর এমন নতুন সভ্যতা গড়ার প্রচেষ্টায় বিশ্বের একটি নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো দরকার বলেও পরামর্শ তার। গত ১৩ নভেম্বর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে এলডিসি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে তিনি এই পরামর্শ দেন। রুদ্ধদ্বার এ বৈঠকে পাঁচটি প্রধান জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ স্বল্পোন্নত দেশ- নেপাল, মালাউই, গাম্বিয়া, লাইবেরিয়া এবং বাংলাদেশের নেতারা যোগ দেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের একটি নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো দরকার, যা পৃথিবী এবং মানুষের জন্য কল্যাণকর। একই সঙ্গে বিশ্বের তরুণদের জন্য একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরির লক্ষ্যে জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় হওয়া সম্মেলন ‘সামিট ফর দ্য ফিউচার’-এ সমর্থন জানান তিনি। তিনি বলেন, আমরা এমন অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করেছি যার মূল হচ্ছে ভোগ, ভোগ এবং ভোগ। এটি শুধু বর্জ্য, বর্জ্য এবং বর্জ্য তৈরি করে। আমাদের শূন্য বর্জ্যরে বিশ্ব তৈরি করতে হবে। তিনি প্রতি বছর আলোচনার জন্য মিটিং করা সময়সাপেক্ষ, অপচয় এবং অপমানজনক বলেও মত ব্যক্ত করেন। জলবায়ু আলোচনার জন্য একটি নতুন পদ্ধতির আহ্বান জানিয়ে উল্লেখ করেন যে, বর্তমান পদ্ধতিটি বিশ্বের বেশিরভাগ চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলো সবচেয়ে বড় অবিচারের সম্মুখীন হয়েছে। তিনি বলেন, জলবায়ু অভিযোজন এবং প্রশমনের জন্য একটি বৃহত্তর তহবিল সুরক্ষিত করতে এলডিসিগুলোকে কঠোর আলোচনা এবং ‘গুরুতর প্রক্রিয়া’ তৈরি করতে হবে। অন্যদিকে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বুধবার নেপাল ও ভুটানে উৎপাদিত জলবিদ্যুতের জন্য একটি দক্ষিণ এশিয়া গ্রিড তৈরি করার আহ্বান জানিয়েছেন। ১৩ নভেম্বর বুধবার জলবায়ু সম্মেলনের ফাঁকে সোশ্যাল বিজনেস গ্রুপের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এ আহ্বান জানান। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং ভুটানের সঙ্গে সংযোগকারী বিদ্যুৎ গ্রিড না থাকায় হিমালয়ের দেশগুলোর বেশিরভাগ জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভাবনা স্থিমিত রয়েছে। বৈঠকে নেপালের কর্মকর্তারা জানান দেশটির ৪০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে, যা ভারত ও বাংলাদেশের মতো বড় দেশগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করতে পারে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং ভুটানকে দক্ষিণ এশিয়ার গ্রিড তৈরি করার কথা ভাবতে হবে। ‘বাংলাদেশ সহজেই নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আনতে পারে কারণ এটি বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৪০ মাইল দূরে। নেপালের জলবিদ্যুৎ সহজলভ্যও হবে।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ বন্যা রোধে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পানির সর্বোত্তম ব্যবহারে পানি ব্যবস্থাপনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘পানি আমাদের প্রধান পরিবেশগত সমস্যা। এমনভাবে পানি ব্যবস্থাপনা করতে হবে যেন তা প্রকৃতিকে সমর্থন করে।’ প্রত্যাশা থাকবে ধরিত্রী রক্ষায়, মানব জাতির নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে কপ-২৯ জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রদত্ত বক্তব্য, সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ কার্যকর উদ্যোগ নেবেন।