আজ বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী দিবস ২০২৪। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা দেশমাতৃকার সেবার পাশাপাশি বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রেখে যাচ্ছেন। শৃঙ্খলা ও আন্তরিকতা হচ্ছে পেশাগত উৎকর্ষ ও নিজেকে আদর্শ সৈনিক হিসেবে গড়ে তোলার দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি- এ কথা বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ভালো করেই জানেন। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর অবদানের কথা স্মরণ করেই ২১ নভেম্বর যথাযোগ্য মর্যাদায় সেনা-নৌ-বিমান- এই তিন বাহিনী ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস’ পালন করে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর অবদানকে স্মরণ করলে আমরা দেখতে পাই, সাত বীরশ্রেষ্ঠের সবাই সামরিক ব্যক্তি। বীর-উত্তমদের মধ্যে একজন ছাড়া আর কোনো বেসামরিক ব্যক্তি নেই। মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তার অনেকেই অবসরের পরও দেশকে নানা ক্ষেত্রে সেবা দিচ্ছেন। তবে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের সশস্ত্র বাহিনী আরো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বর্তমান বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী একটি পরিচিত ও আস্থার প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দুর্যোগময় পরিবেশে শান্তি স্থাপন করে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তাই এইদিনে আমরা সকল সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সম্মান জানাই যারা যুদ্ধ ও শান্তির সময়ে দেশের সেবা করেছেন এবং করে চলেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের সাহসী আত্মত্যাগের ঋণ আমরা কখনোই শোধ করতে পারব না। যারা মুক্তিযুদ্ধে তাদের জীবন হারিয়েছেন এবং যারা শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সেসব বীর সেনানী এবং তাদের পরিবারের সদস্য এবং প্রিয়জনদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। স্বাধীনতার পর ১৯৮০ সাল থেকে ২১ নভেম্বরকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এর আগে ২৫ মার্চ সেনাবাহিনী, ১০ ডিসেম্বর নৌবাহিনী এবং ২৮ সেপ্টেম্বর বিমানবাহিনী স্বতন্ত্রভাবে তাদের নিজস্ব বাহিনী দিবস পালন করত। কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে উদ্?যাপন বাদ দিয়ে ১৯৮০ সালে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মুক্তিযুদ্ধে গোটা সশস্ত্র বাহিনীর যে অসাধারণ লড়াই আর ত্যাগের ইতিহাস রয়েছে, তাকে স্মরণ রাখতে এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই দিবস পালনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অবদানকে দেশের আপামর জনগণের আত্মত্যাগের সঙ্গে একীভূত করে দেখা হয়।
বর্তমানে সশস্ত্র বাহিনীর মোট সদস্য সংখ্যা ২ লাখ ৪ হাজার ৫৯৬ জন। এর মধ্যে ১ লাখ ৬২ হাজার ১২৫ জন সেনাবাহিনী। ২৫ হাজার ৮১ জন নৌবাহিনীর এবং ১৭ হাজার ৩৯০ জন বিমান বাহিনীর সদস্য আর এই তিন বাহিনীতে প্রায় ২১ হাজার বেসামরিক ব্যক্তি কাজ করছেন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীতে ১৩ হাজার ৪০৮, নৌবাহিনীতে ৩ হাজার ৮০০ এবং বিমান বাহিনীতে ৩ হাজার ৬৮৬ জন বেসামরিক ব্যক্তি আছেন।
সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে এলিট ফোর্স র্যাবের সদস্য হয়ে রেখে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের নেতৃত্ব দিয়ে সীমান্তকে সুরক্ষা দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
যে কোনো দুর্যোগেই- সেটা প্রাকৃতিক কিংবা মানুষ সৃষ্ট হোক সেসব দুর্যোগে এখনও জনগণের আস্থা ও ভরসার নাম সশস্ত্র বাহিনী। ঘূর্ণিঝড়, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে উদ্ধার, ত্রাণ তৎপরতা ও পুনর্বাসনে সামনের কাতারে এসে দাঁড়ায় সশস্ত্র বাহিনী সদস্যরা। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী আমাদের গর্ব ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশেও সংকটের সময় জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে বারংবার। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী সদস্য সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৮৮ সাল থেকে সেনাবাহিনী, ১৯৯৩ সালে নৌ ও বিমানবাহিনী, ১৯৮৯ সাসে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা শান্তিরক্ষী পরিবারের সদস্য হন। জাতিসংঘের ৬৮টি মিশনের ৫৪টিতেই বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত কম্বোডিয়া, সোমালিয়া, নামিবিয়া, কঙ্গো, উগান্ডা, হাইতি, কসোভো, জর্জিয়া, পূর্ব তিমুর, তাজিকিস্তান প্রভৃতি দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা, অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী সদস্যদের ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। সশস্ত্র বাহিনী নানা ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ড অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবিলা করে জনগণের মধ্যে আস্থা অর্জন করেছে। তার অন্যতম উদাহরণ মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে মাঠপর্যায়ে শারীরিক দূরত্ব ও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে কাজ করা।
স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে লকডাউন কার্যকর, ত্রাণ সহায়তা, বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা, বিদেশ ফেরতদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবাসহ করোনা মোকাবিলায় রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী পেশাগত দায়িত্ব পালনের সঙ্গেসঙ্গে দেশ ও জাতির উপর অর্পিত দায়িত্বও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করে আসছে। ছবিসহ ভোটার তালিকা, জাতীয় পরিচয়পত্র, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট তৈরি করে দেশে-বিদেশে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে।
আর বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পরপরই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশ সচিবালয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়ন ও তাদের কার্যক্রমের সাফল্য গাথা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হবে এই দিবসটি উদযাপনের তাৎপর্য। ২১ নভেম্বরের তাৎপর্য সমুন্নত রাখতে সম্মিলিত দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালনের পেছনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সক্রিয়।
মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সামরিক বাহিনীর অবদানকে সাধারণ জনতার আত্মত্যাগের সঙ্গে একীভূত করে দেখা হয় এ দিবসটিতে। পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও ভৌগলিক অখণ্ডত্ব রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যগণ অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিশ্বশান্তি রক্ষায়ও তাদের ভূমিকা বিশ্ব সমাজে প্রশংসিত। আর স্বাধীনতার ঘোষক সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে একটি আধুনিক, গতিশীল ও দক্ষ পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করেছিলেন। আজকের দিনে আমি তার স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। আমি বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধে নিজের জীবনদানকারি বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল, বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন, বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান, বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নুর মোহাম্মদ শেখ ও বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফকে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়ার সময় থেকেই বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী সুশৃঙ্খল, ক্ষিপ্র ও সদা তৎপর এক আধুনিক বাহিনীতে পরিণত হয়, যা বিশ্বের যেকোনো আধুনিক রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সমকক্ষ। পরবর্তীতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার থাকতে সশস্ত্র বাহিনীকে শহীদ জিয়ার গৃহিত কর্মসূচির ধারাবাহিক বাস্তবায়নের অগ্রগতি সাধিত করে এই বাহিনীকে আরো আধুনিকায়ন ও একে শক্তিশালী করে গড়ে তুলেছিলেন। সুতরাং অফুরন্ত শক্তির জায়গা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সমৃদ্ধ থাকবে- সেটাই জনমানুষের প্রত্যাশা। সব বাহিনীর সব সদস্যকে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অভিনন্দন ও আন্তরিক শুভেচ্ছা।