ইনটেরিম সরকারের ১০০ দিন পার হলো। ফিরে যেতে হয় জুলাই-২৪ বিপ্লবে। রাজনৈতিক নেতা কিছু উচ্ছিষ্টভোগী সুবিধাভোগী তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের উচকানি, অতি উৎসাহী প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের জিঘাংসায়, নির্ভেজাল ছাত্রদের অরাজনৈতিক আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগ, যুবলীগের চতুর্মুখী পৈশাচিক বর্বতা, ক্ষোভে -দ্রোহের আগুনে রাস্তায় দলমত নির্বিশেষে ছাত্র জনতা আবাল বৃদ্ধ বণিতা। দমন-পীড়নে আকাশে হেলিকপ্টার নিচে সাঁজোয়া যান। মহুর্মুহু গুলি টিয়ারশেল সাউন্ড গ্রেনেড রক্তাক্ত আহত নিহত কারো ভাই, কারো পিতা কারো স্বামী কারো বুকের ধন একমাত্র সন্তান। রক্তে লাল রাস্তার কালো পিচ, মায়ের আচলের সবুজের মাঠ। নিজ দেশের মানুষের উপর এমন পৈশাচিকতা বর্বতা কোনো দেশপ্রেমিক মানুষের পক্ষে করা অসম্ভব? সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছে হাসিনা সরকার এবং তার দল আওয়ামী লীগ। এলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার বিজয়। রাষ্ট্র সংস্কার করে একটা সুষ্ট নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে গঠিত হলো ইনটেরিম সরকার। আপনজনদের হারানোর চোখের পানি এখনো শুকায়নি, ভুলতে পারেনি সন্তানের লাশের কথা, গুলিতে আহতদের রাস্তায় ছটফট করতে, রাস্তায় পড়ে থাকতে ছাত্র-জনতার মৃতদেহ, গুলি করে মেরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে মৃতদেহ। নিহতদের কবরের মাটি শুকায়নি আহতদের ক্ষত শুকাইতে পারেনি তাদের কষ্টের আহাজারি এখনো থামেনি। দলমত নির্বিশেষে এমন মানুষ ছিল না যারা পৈশাচিক বর্বরতায় ব্যথিত হয়নি। নাহ! বিশাল জনগোষ্ঠী সমর্থিত আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী এখন পর্যন্ত এই অমানবিক বর্বরতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেনি। তাদের কোনো অনুশোচনা নেই। কোনো ধৈর্য্যও তারা দেখাতে পারছেন না। আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে বিভিন্ন নামে প্রপাগাণ্ডা চালাতে গিয়ে মানুষের কাছে এখন কেবলই আফসোস লীগে পরিণত হয়েছে। শোনা যাচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের মাঝে ঢুকে সরকারের চিকিৎসা দিতে ব্যর্থতার অজুহাতে আন্দোলন করতে চেষ্টা করা হচ্ছে। যার নমুনা কিছুটা পরিলক্ষিত হতে দেখা গেছে উপদেষ্টাদের সাথে বৈঠকে।
আওয়ামী সরকার ক্ষমতা হারালে লাখো মানুষ হতাহত হবে তাদের বড় বড় নেতাদের উস্কানি ছিল। আল্লাহর অশেষ রহমতে সেই সংঘাত হয়নি/হতে পারেনি। তবে চারিদিকে চলমান ঘটমান নানা রকম কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে এখন সেই চেষ্টা চলছে চারিদিকে অতি আবেগি আওয়ামী নেতা কর্মীদের। আওয়ামী লীগের মনোনীত রাষ্ট্রপতি মহোদয়ও দেশ ও জাতীর রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি, নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে পারেননি ধৈর্য্য ধরতে। দলের নেত্রী শেখ হাসিনা বলতেন তার আর কিছু চাওয়া পাওয়া নেই দেশের মানুষকে সুখী দেখতে পাওয়াই তার একমাত্র চাওয়া। অথচ জনরোষে পালিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ছাত্র-জনতা হত্যায় উৎসাহ দিয়েছেন। আজ পালিয়ে গিয়ে ভারতের আশ্রয়ে থেকে টুস করে ঢুকে যাওয়ার বাসনায় দলের পাতি নেতাদের দেশের ভেতর অস্থিতিশীল করতে টেলিফোনে নানা রকম উসকানি দিয়ে যাচ্ছেন। বন্ধ নাই ভারতীয় মিডিয়ার বানোয়াট সংখ্যালঘু নির্যাতন ও বাংলাদেশের ভূখণ্ড দখলের আগ্রাসী প্রপাগাণ্ডা। কারণ তারা আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনকে মেনে নিতে পারেননি।
‘পক্ষে থাকলে সঙ্গী না থাকলে জঙ্গি’ এই মতবাদে দীর্ঘদিনের মামলা-হামলা, গুম-খুন নিপীড়ন নির্যাতনের পুঞ্জিভুত ক্ষোভ, অরাজনৈতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উপর পৈশাচিক বর্বরতা, শত শত হত্যা, রক্তাক্ত আহত হাজার হাজার। অতি-উৎসাহী স্বৈরাচারের দোসর প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের আদেশ পালন করতে গিয়ে পুলিশ প্রশাসনের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সে অনুযায়ী কিশোর-কিশোরী, ছাত্রছাত্রী সাধারণ মানুষ হত্যাকারী হাসিনা সরকারের কর্মিবাহিনী, তাদের নির্দেশ ও মদদদাতা মন্ত্রী-নেতা অতি উৎসাহী প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের তেমন কোনো ক্ষতিই হয়নি। সবাই চলে গেছে নিরাপদ আশ্রয়ে। প্রশাসনিক শূন্যতায় কিছু লুটেরা, পরাজিত তবে একেবারেই অক্ষত স্বৈরাচারী শক্তি ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের যোগসাজশে ছাত্র-জনতার বিজয়কে নস্যাৎ করতে চাইছে। চাইছে ‘আগেই ভালো ছিলাম’ এই কথা প্রতিষ্ঠিত করতে। আজ ভাবতে হবে যারা কর্মীদের কথা ভাবেন নাই, যারা কোটি কোটি সমর্থকদের কথা ভাবেন নাই, দেশের অর্থ-সম্পদ লুটে পরিবার পরিজনদের নিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন তাদের জন্য কেন অস্থিতিশীল করতে হবে দেশটাকে? তাদের ভাবতে হবে গত পনের বছর কেবলই নেত্রী এবং তার পরিবারের তুষ্টীর জন্য লীগের নেতাকর্মীরা বিরোধী নেতাকর্মীদের উপর জুলুম নির্যাতন করেছেন। যদি ভাবতেন আমার বিপদে আমারই প্রতিবেশী আমারই পাশে থাকবেন আজ তাহলে কাউকে পালিয়ে বেড়াতে হতো না। অহংকার, মানুষের উপর জুলুম, নির্যাতন পতন অনিবার্য আবার তা আমরা দেখতে পেলাম হাসিনা এবং তার দলের পতনের মাধ্যমে। দোর্দণ্ড ক্ষমতাশালী, দাম্ভিক জুলুমবাজ শেখ হাসিনার এমন অপমান এবং লজ্জাজনক বিদায়ে জানি না আমাদের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা এখন যারা বীরদর্পে রাস্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা শিক্ষা নেয়ার চেষ্টা করছেন কি না। লোভ লালসা ত্যাগ করে সত্যিকারভাবে দেশ ও জনগণের প্রকৃত সেবক হয়ে জনগণের জন্য কিছু যদি করতে চান আজ তাদেরও ভাবতে হবে ব্যক্তি নয়, দল নয় দেশ এবং দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হবে। বিভিন্ন দলের কর্মী বাহিনী এলাকার পাতি নেতাদেরও শিক্ষা নিতে হবে, নেতাদের নির্দেশে প্রতিবেশী, বিরোধীপক্ষের উপর অত্যাচার নিপীড়ন করা যাবে না। অসময়ে বড় বড় নেতা নিজেদের বাঁচাতে কারো দিকে ফিরে তাকায় না। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাকরির মেয়াদ পর্যন্ত আপনারা নিজ নিজ জায়গায় থাকবেন, যদি না কোনো অনৈতিক কার্যকলাপে ধরা পড়েন। রাজনৈতিক নেতারা মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন যাবেন আরেকজন আসবেন তেলবাজি না করে সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে সততার সাথে জনগণের খাদেম হতে চেষ্টা করতে হবে। দেশকে ভালোবাসলে দেশের মানুষকে ভালোবাসলে আওয়ামী লীগের উচিত দেশকে অস্থিতিশীল না করে ধৈর্য্য ধরে দলকে নতুন করে সাজাতে। দেশপ্রেমিক তৃণমূল মানুষ থেকে নেতা তৈরি করে আগামী দিনের অপেক্ষায় কিছু দিন চুপ থাকতে। আকাশে এখন শুকুনের কালো ছায়া, চাইছে দেশটাকে খুবলে খেতে। ভাবতে হবে দেশ বাঁচলে তবেই না রাজনীতি? ৭৫-এর পর সব চাইতে খারাপ অবস্থা থেকে জোহরা তাজুদ্দিন আর সাজেদা চৌধুরীরা দলকে জিরো থেকে হিরো বানিয়েছিলেন। যদিও আওয়ামী লীগের সুদিনে তাদের মুল্যায়ন করা হয় নাই। বিএনপি জামায়াতকে শেষ করে দেয়ার জন্য সব কিছুই করা হয়েছিল। বিএনপি নেত্রীকে সাজানো বিচারে জেল দেয়া হয়েছিল। সু-চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। সাজানো বিচারে ফাঁসিতে হত্যা করা হয়েছে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের। কোনো দলই কিন্তু শেষ হয় নাই। আজকে মানতেই হবে এ বিজয় ছাত্র-জনতার, এ বিজয় নতুন প্রজন্মের, এ বিজয় দীর্ঘদিনের নিপীড়িত নিগৃহীত দলমত, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের। কারণ বিগত দেড় দশকে রাজনৈতিক নেতারা আন্দোলন করে, দলের অসংখ্য নেতাকর্মী সাধারণ মানুষকে মামলা-হামলা, জেল-জুলুম নির্যাতন নিপীড়নে নিপতিত করে ঘরছাড়া পরিবার ছাড়া করেও কোনো পরিবর্তন আনতে পারেন নাই। কিন্তু আমাদের সন্তানতুল্য ছেলে-মেয়েরা মাত্র ক’দিনের আন্দোলনে ভেদাভেদ ভুলে সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশের মানুষকে ইস্পাত কঠিন ঐক্যের মাধ্যমে একই পতাকাতলে এনে গন্তব্যে পৌঁছে গেছেন। ইচ্ছা করলেই সমন্বয়কারীরা বিক্রি হয়ে যেতে পারতেন আমাদের অনেক অনেক নামি-দামি বড় বড় নেতা-নেত্রীদের মতো কিন্তু অনেক অত্যাচার সহ্য করেও তারা বিক্রি হয় নাই। সব চাইতে বড় কথা শেখ হাসিনা নিয়মতান্ত্রিক উপায় পদত্যাগ করে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে শত শত ছাত্রছাত্রী সাধারণ মানুষ হত্যা, হাজার হাজার মানুষ রক্তাক্ত আহত করে, মানুষের মাঝে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে কোটি কোটি নেতাকর্মীর দিকে না তাকিয়ে নিজে চোরের মতো পালিয়ে যাওয়ায় প্রশাসনে অনেক সমস্যা তৈরি হয়েছে। এসব সামলাতে ইনটেরিম সরকারের সময় প্রয়োজন। কিন্তু শেখ হাসিনা যদি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পদত্যাগ করে ক্ষমতা হস্তান্তর করতেন দেশের এতো বড় সর্বনাশ হতো না। চারিদিক দিয়ে সবাই দাবি তুলে নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে এই সংকটময় অবস্থায় আরও সমস্যা বাড়ানো হচ্ছে যা কাম্য নয়। রাজনৈতিক নেতাদের বলি, চারিদিকে অনেক কথাই আসছে কান পেতে শুনুন, মানুষের চোখ ও মুখের ভাষা বুঝতে চেষ্টা করুন। আহত-নিহত অসহায় পরিবারের খোঁজ-খবর নিন। ১০০ দিন পার হয়ে গেছে এখন আর অতি আবেগ আপ্লুত হওয়ার, অতি উল্লসিত হওয়ার সময় নাই। রাজনৈতিক নেতাদের আছে অনেক ব্যর্থতা, আছে দেশ ও জাতির সাথে বেইমানী করার চেষ্টা। ৫৩ বছরের সেই রাজনৈতিক জঞ্জাল মুক্ত করে রাষ্ট্র সংস্কার খুব সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে পনের বছরের স্বৈরাচারী সরকারের আজ্ঞাবহ দলদাস রেখে ইনটেরিম সরকারের পক্ষে লক্ষ্যে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব কাজ, যদি না রাজনৈতিক দলের নেতারা সহযোগিতা করেন। ইনটেরিম সরকারের সবকিছু সংস্কার করাও কাজ নয় এবং তা সম্ভবও নয়। বিগত ১০০ দিনের একটা বিরাট সময় বিভিন্ন গোষ্ঠির দাবি-দাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যয় করতে হয়েছে এবং হচ্ছে এ ব্যাপারে কোনোভাবেই ইনটেরিম সরকারের নজর দেয়া ঠিক হয় নাই। প্রয়োজন ছিল দ্রুত নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবেশ তৈরি করা। অগ্রাধিকারভিত্তিতে আভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। পুলিশ প্রশাসন চালু করা, আনসার বিদ্রোহ সামাল দেয়া, একটা গোষ্ঠির সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা সামাল দেয়ার সফলতা আছে কিন্তু শিল্প এলাকা এখনো ঠিক করা যায় নাই। প্রয়োজন ছিল জুলাই বিপ্লবের হত্যাকাণ্ডসহ সকল গুম খুনের অতিদ্রুততম বিচারে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। প্রয়োজন ছিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তালিকা করে নিহত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের চিকিৎসাসহ ক্ষতিপূরণ নিষ্পন্ন করা। আহতদের ব্যাপারে কোথাও একটা গাফিলতি ছিল যার সুযোগ নিয়ে শোনা যাচ্ছে একটা মহল অরাজগতার পাঁয়তারা শুরু করেছে। দেশি-বিদেশি সুবিধাবাদী-ভোগবাদীদের ষড়যন্ত্রে তৈরি দাবি আর ইস্যুর বন্যায় ইনটেরিম সরকার আজ যদি ব্যর্থ হয় এই দেশ ও জাতির সামনে থাকবে কেবলই অমানিশার ঘোর অন্ধকার। তখন পুনর্বাসন/পরিবর্তন করেও রক্ষা পাওয়া যাবে না। সবাই ভাবুন সময় এখন বিবেক দিয়ে কাজ করবার আবেগ দিয়ে নয়।