গত রোববার রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করাসহ তিন দফা দাবিতে কয়েকশ’ শিক্ষার্থী মহাখালি সড়ক ও রেলগেট অবরোধ করে দিনভর আন্দোলন করে। এতে মহাখালী থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে আশপাশের সড়কগুলোতে। এতে অসংখ্য যাত্রী চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তিতে পড়ে। ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগী, বিমানের যাত্রী, কর্মজীবীসহ সাধারণ মানুষকে অসহনীয় যন্ত্রণায় ভুগতে হয়েছে। অনেকে যানবাহন ছেড়ে মাইলের পর মাইল হাঁটা শুরু করে। শিক্ষার্থীরা শুধু রেলপথ ও সড়কই অবরোধ করেনি, ট্রেনে হামলা ও ভাঙচুরও করেছে। গতকালও তারা আন্দোলন চালিয়ে যায়। তবে সড়কে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও প্রায় শতাধিক সেনাসদস্য সড়কের পাশে অবস্থান নিতে দেখা যায়। একই দিনে গার্মেন্ট শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। গাজীপুরে শ্রমিকরা বিভিন্ন কারখানায় হামলা-ভাঙচুর করে এবং জিরানি বাজারসংলগ্ন একটি কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেয়। গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলন যে ষড়যন্ত্রমূলক, তা সকলেরই জানা। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর গার্মেন্ট মালিকরা নিজেরাই কারখানা বন্ধ করে শ্রমিক ও বাইরের সন্ত্রাসীদের দিয়ে আন্দোলন করাচ্ছে বলে এরইমধ্যে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তবে হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে তিতুমীর কলেজের কয়েকশ’ শিক্ষার্থীর অবরোধ আন্দোলন করা যে ষড়যন্ত্রের অংশ তা পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। কারণ, হাসিনার বিগত সাড়ে ১৫ বছরেও এ নিয়ে তারা কোনো দাবি ও আন্দোলন করেনি। সড়ক অবরোধে দুর্ভোগে পড়া মানুষের প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা সচেতন এবং তারা জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের যদি কোনো দাবি-দাওয়া থাকে, তাহলে সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা বা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে তা জানাক। সড়ক অবরোধ করে মানুষকে কষ্ট দেয়া তো কোনো সুবিবেচনা হতে পারে না। তারা কি দেখছে না, কত মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছে? তাদের এই না বোঝা অত্যন্ত দুঃখজনক। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমরা বারবার বলেছি, ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার প্রভু মোদি যৌথভাবে অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করেছে, করছে এবং তা চলমান থাকবে। এরই ধারাবাহিকতায় একশ্রেণির গার্মেন্ট শ্রমিক ও শিক্ষার্থীর এই আন্দোলন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস ও অর্থনীতিকে ফোকলা করে এবং মানুষের জীবনযাপনকে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে রেখে গেছে। এমন এক ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়েই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফসল অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। একদিকে ভঙুর রাষ্ট্র, অন্যদিকে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও প্রশাসনসহ সর্বত্র ঘাপটি মেরে থাকা তার দোসরদের ষড়যন্ত্র সরকারকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সরকার এখন ধীরে ধীরে থিতু হলেও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। তবে সরকারের যে কাজটি সবার আগে করা দরকার ছিল তা হচ্ছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সার্বিক অব্যবস্থাপনাকে নিয়ন্ত্রণ করা। এসব ক্ষেত্রে সরকারের যথেষ্ট সংকুচিত অবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ এ সরকার যে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে, তার মধ্যেও সেই বিপ্লবী তেজ থাকা জরুরি ছিল। তা না থাকার ফলে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং উঠছে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, সরকার এসব দিকে মনোযোগের চেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে, সংস্কারের ওপর। পর্যবেক্ষকদের মতে, সংস্কার করতে হবে, তবে দেশের পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে সংস্কার হোক আর যাই হোক, সবই ভেস্তে যাবে। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার মতো কাজ করা উচিত নয়। সরকার এখন পর্যন্ত নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হবে বলে বড় বড় কথা বললেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। গতকালও পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ও ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর ব্যবসায়ীদের কারণে পণ্যমূল্য আকাশ ছোঁয়া হয়ে রয়েছে। সরকার এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারছে না। এতে জনঅসন্তোষ ও ক্ষোভ ক্রমেই বাড়ছে। যে কোনো সরকারের ১০০ দিনের কার্যক্রমের উপর তার সাফল্য-ব্যর্থতার পথরেখা নির্দেশ করে। তার গতিপথ কোনদিকে, তা বোঝা যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনে মানুষ যে বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে পরিবর্তন আশা করেছিল, সে আশা খুব কমই পূরণ হয়েছে। সরকারের উচিত ছিল, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও মোদির ষড়যন্ত্রের মধ্যেই, কীভাবে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অর্থনীতিকে গতিশীল করা যায়, তার রোডম্যাপ তৈরি করা। তা না করায় পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। সরকারের মধ্যে বিপ্লবী স্পিরিটের চেয়ে গতানুগতিক মনোভাবই বেশি প্রকাশিত হচ্ছে। মানুষের নিরাপত্তা ও জীবনমানের উন্নতি ঘটানোর মতো দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিয়ে যে স্বস্তি দেবে, তার কোনো আলামত পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বরং অর্থনীতির সূচক নিচের দিকে চলে যাচ্ছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে। গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের রেটিং এজেন্সি মুডিস ঋণমান সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ‘বি-ওয়ান’ থেকে ‘বি-টু’তে নেমে গেছে। এসব বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগের অভাব রয়েছে। উপদেষ্টাদের বেশিরভাগই যেন কাজের চেয়ে ক্ষমতা উপভোগে ব্যস্ত। যেসব সমস্যার উদ্ভব ঘটছে, তা সমাধানে করব-করছি, কিংবা নির্লিপ্ত হয়ে রয়েছে। জনগণ যে আওয়াজ তুলছে, তা যেন তাদের স্পর্শ করছে না। গার্মেন্ট শ্রমিকরা দিনের পর দিন যে ষড়যন্ত্রমূলক আন্দোলন করছে, তা এখন পর্যন্ত দামাতে পারছে না। এসব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের পেছনে কারা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কি জানে না? কি করছে তারা? নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারিদের শনাক্ত করে কেন ধরা হচ্ছে না? গোয়েন্দা সংস্থার তো কাজই হচ্ছে, ষড়যন্ত্রকারিদেরে ষড়যন্ত্রের আগে চলা ও তথ্য পাওয়া, যাতে তা শুরুতেই নির্মূল করা যায়। তিতুমীর কলেজের একদল শিক্ষার্থী যে একটি অসময়োপোযোগী দাবিতে আন্দোলন করবে, তা গোয়েন্দা সংস্থার জানার কথা। জানতে পারলে, আগেই যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া যেত। শিক্ষার্থীদেরও বোঝা উচিত, দাবি করলে কিংবা চাইলেই রাতারাতি বিশ্ববিদ্যালয় করা যায় না। এর শিক্ষার মান, অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে শিক্ষক ও জনবলের প্রয়োজন। এগুলো আগে নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সময়ের প্রয়োজন। সড়ক অবরোধ করে মানুষকে কষ্ট দিয়ে ‘এখনই করতে হবে’ বলার কোনো যৌক্তিকতা নেই। জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। তাদের ভেবে দেখতে হবে, তারা কোনো ষড়যন্ত্রের কবলে পড়েছে কি না। আমরা দেখেছি, শেখ হাসিনার শাসনামলে অলি-গলিতে কীভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, যেগুলোতে শিক্ষার মান, পর্যাপ্ত শিক্ষক, শিক্ষার পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা বলে কিছু নেই। ফলে বছরের পর বছর মানহীন এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দলে দলে শিক্ষার্থী পাস করে চাকরি না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে চায় না। যে কোনো সরকারকে দেশের সবদিক সামাল দিয়ে চলতে হয়। দেশের মানুষের সেবা ও সুবিধা-অসুবিধা দেখা ও স্বস্তিতে রাখাই সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এজন্য সকল খাতকেই সরকারকে সমান গুরুত্ব দিতে হয়।
একরৈখিকভাবে দেশ চালানো সম্ভব নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রবণতা পরিদৃষ্ট হচ্ছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, সরকারের অন্যতম কাজ, দেশের আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা। এ কাজটি অন্তর্বর্তী সরকার এখনো করতে পারেনি। এরইমধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গত সোমবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তার গবেষণায় বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর অর্পিত দায়িত্ব বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় কৌশল ও রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হয়নি। এর অর্থ হচ্ছে, সরকারের শুরুতেই যা করা দরকার ছিল, তা করেনি। জরুরিভিত্তিতে যে সমস্যাগুলো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারের উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিল, তা নিতে পারেনি। এতে নানা সমস্যা, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ গার্মেন্ট খাতে শ্রমিক আন্দোলনের নামে যে ষড়যন্ত্র চলছে, তা সরকার এখন পর্যন্ত থামাতে পারেনি। এতে কারখানা বন্ধ হওয়াসহ উৎপাদন ব্যাহত ও অসংখ্য শ্রমিক বেকার হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির চরম ক্ষতি হচ্ছে। আন্দোলনের নামে এ খাত ধ্বংস করার জন্য যারা ষড়যন্ত্র করছে, কারখানা পুড়িয়ে দিচ্ছে, সরকারের উচিত, তাদের চিহ্নিত করে সর্বোচ্চ সাজা দেয়া। অন্যদিকে, বিভিন্ন দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীসহ অন্যদের সড়ক অবরোধ আন্দোলন অর্থনীতির টুটি চেপে ধরছে। আন্দোলন করার অধিকার সবার রয়েছে, তার অর্থ এই নয়, মানুষকে কষ্ট দিয়ে সম্পদ ধ্বংস করে আন্দোলন করতে হবে। সরকারকে এসব বিষয় আমলে নিয়ে যেভাবে সমাধান করা যায়, সেভাবে দ্রুত সমাধান করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, নিত্যপণ্যের মূল্য মানুষের নাগালের মধ্যে আনাসহ অর্থনীতিকে সচল করতে সরকারকে দৃঢ় ও গতিশীল পদক্ষেপ নিতে হবে।