বিপজ্জনক রং বাহারি পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার নিয়ন্ত্রণ জরুরি

মো. তাহমিদ রহমান

প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি/তোমার জন্যে গলির কোণে/ভাবি আমার মুখ দেখাব/মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।/একটা দুটো সহজ কথা/বলব ভাবি চোখের আড়ে/জৌলুশে তা ঝলসে ওঠে/বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।/কে কাকে ঠিক কেমন দেখে/বুঝতে পারা শক্ত খুবই/হা রে আমার বাড়িয়ে বলা/হা রে আমার জন্ম ভূমি।/বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া/তোমার সাথে ওতপ্রোত/নিয়ন আলোয় পণ্য হলো/যা কিছু আজ ব্যক্তিগত।/মুখের কথা একলা হয়ে/রইলো পড়ে গলির কোণে/ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু/ ঝুলতে থাকে

পঙ্ক্তিগুলো প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষের। আজকের আলোচনার সাথে কবিতাটি প্রাসঙ্গিক তাই সেটা দিয়েই লেখাটি শুরু করলাম। বিজ্ঞাপনের রসায়নে সমৃদ্ধ হতে নগ্ন প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছি সবাই। এতটাই বেড়ে গেছে বিজ্ঞাপনের ব্যানার যেটা নান্দনিকতাকে ছাপিয়ে আমজনতার বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে নেই বিজ্ঞাপন ব্যানারের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকারি, বেসরকারি অফিস প্রাঙ্গণ সর্বত্রই বিজ্ঞাপন ব্যানারের অসুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ্যণীয়। নিকট অতীতে এবং সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিক রসায়নকে হৃষ্টপুষ্ট রাখতে আজকাল অনেক দল ও ব্যক্তির চিন্তা চেতনাই যেন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বিজ্ঞাপনে নিজের বড় বড় ছবি প্রদর্শন করে রাষ্ট্র বিপ্লবের অংশীজন হতে হবে। ইদ, পূজা, পার্বণ, মিছিল, সমাবেশ, জন্মদিন, মিটিং, কনফারেন্স এবং এমন কোনো জাতীয় দিবস নেই যে, আমরা অসহায় জনগণ শুভেচ্ছা ব্যানারের বন্যায় ভেসে যাই না! ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষত মোবাইল অপারেটর ও মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান সমূহের পিভিসি ফ্লেক্স বিজ্ঞাপনে ধরাশয়ী আমরা ক্রেতাকূল। সেই সাথে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের গলায় সফলতার বরমাল্য নিয়ে বড় বড় ছবি দিয়ে ঢাউস আকৃতির ব্যানার ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সড়ক-মহাসড়কে মোড়ে মোড়ে। জনগণ ভালোভাবে গ্রহণ করুক বা না-করুক সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধিগণের এসব রাজনৈতিক রসায়নে হৃষ্টপুষ্ট ব্যানার ঝুলানো চাই চাই। সেসব ব্যানারে আবার লক্ষ্য করা যায় প্রাণ উজাড় করা অঢেল শুভকামনা, যদিও বেশিরভাগই স্বার্থন্বেষী, মেকি, ধান্দাবাজির মতলব। কিন্তু কি করার আছে আমজনতার। এ যেন আমাদের সর্বনাশ দেখে তাদের পৌষ মাস! বাণিজ্যিক প্রচার কিংবা তেলবাজি রাজনীতিতে নিজেকে জাহির করা, যে উদ্দেশ্যেই তৈরি হোক এসব বিপজ্জনক ফ্লেক্স ব্যানার সবই পরিবেশ বিধ্বংসী। অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ১ অক্টোবর থেকে পলিথিন, পলিপ্রপিলিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ যদিও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবতা ভিন্ন। ইতোপূর্বেও ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ আইন করে বিষাক্ত পলিথিন ব্যাগ এবং একবার ব্যবহারযোগ্য ভার্জিন প্লাস্টিকসামগ্রী উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু মুনাফা লোভী ব্যবসায়ী, আইন-শৃঙ্খলা প্রয়োগ বাহিনীর অবহেলা এবং জনসাধারণের অসচেতনতায় পলিব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার কমেনি; বরং গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। ধারাবাহিক তদারকি না করে হ্যালির ধূমকেতুর মতো বছরে দুই একবার ঝটিকা অভিযান চালালে এসব একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিন সামগ্রীর ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব নয়। পলি ভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি) এক ধরনের থার্মোপ্লাস্টিক। পিভিসির অনেক ধরনের পণ্যের মধ্যে একটা হল পিভিসির উপর ফ্লেক্সিবল পলিস্টারের কোটিং দেওয়া বিজ্ঞাপন ব্যানার। যা পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার বা ডিজিটাল ব্যানার নামে পরিচিত। বিজ্ঞাপনে চতুর্দিকে নিজেদের জয়গান গেয়ে যে ডিজিটাল বাহারি পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার ব্যবহার হচ্ছে সেগুলো কিন্তু প্লাস্টিক পণ্য যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক। দেখতে সুন্দর হলেও ভয়াবহ বিষাক্ত জিনিস হলো পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার। দাম কম ও সহজলভ্য হওয়ায় পিভিসি’র ব্যবহার জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে এবং যত্রতত্র পিভিসি বর্জ্য বাড়ছে ভয়ানক গতিতে।

এসব পিভিসি ফ্লেক্স তৈরি করতে গিয়ে উৎপাদন কারখানাগুলো প্রচুর পরিমাণে সলিড বর্জ্য তৈরি করছে। পাশাপাশি নানা রকম বিষাক্ত পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে পানি, বায়ু ও পরিবেশকে দূষিত করছে। পিভিসি উৎপাদনের কারণে পারদ বাষ্প আকাশে বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ছে। সেই পারদ আবার মাটিতে ফিরে আমাদের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ছে। মাটিতে ফিরে আসা পারদ মিথাইলেশন ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা মিথাইল মার্কারিতে পরিণত হচ্ছে। মিথাইল মার্কারি খুবই বিষাক্ত নিউরো টক্সিন। যার কারণে মানব শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হওয়া সহ হজমে সমস্যা, কিডনি রোগ, অটিজম সহ নানারকম স্নায়ুবিক রোগ দেখা দিচ্ছে। পিভিসি তৈরিতে উপজাত হিসেবে ভিনাইল ক্লোরাইড উৎপাদিত হয় যার কারণে ব্যাপক হারে মানব শরীর টিউমার, ফুসফুসের ক্যান্সার, লিম্ফোমাস, লিউকোমিয়া ও লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হচ্ছে। পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার ও পিভিসির তৈরি বর্জ্য পুড়িয়ে ফেললে ফুরান ও ডাই অক্সিন নামক রাসায়নিক দূষণ ঘটে। এই রাসায়নিক গুলোকে রোদ, বৃষ্টি, বাতাস, মাইক্রোবিয়াল অ্যাক্টিভিটি কিছুই ধ্বংস করতে পারে না অর্থাৎ এরা প্রায় অবিনশ্বর। দুঃখের বিষয় পরিবেশ দিবসের সচেতনামূলক অনুষ্ঠানগুলোও হাস্যকর ভাবে উপস্থাপিত হয় পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার ব্যবহার করে। সাম্প্রতিক সময় দেশের রাজধানীসহ বেশিরভাগ শহর এলাকায় ছয়লাপ হয়ে গেছে আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ব্যানারে। এটা একই সঙ্গে পরিবেশ বিধ্বংসী ও দৃষ্টিকটু। এসব বিপজ্জনক পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানারের সংখ্যা হয়তো বাড়িয়ে তুলবে আগামী ভোটের মৌসুম। বর্তমানে এসব ডিজিটাল ব্যানার গুলো যেখানে সেখানে লাগানো হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না সরকারি-বেসরকারি ভবন এমনকি সড়কের দুইধারের গাছও। ফলে ব্যাপকহারে দেশবাসী উপহার পাচ্ছে দূষণ সামগ্রী। প্লাস্টিকের পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ হলেও পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার সর্বত্র বিরাজমান কেন? এটাও তো প্লাস্টিকের তৈরি একটি বিপজ্জনক পণ্য। পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার গুলি প্লাস্টিক ব্যাগের মতোই একই উপকরণ দিয়ে তৈরি এবং অপচনশীল। প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপন্ন হয় পলিথিন থেকে এবং ফ্লেক্স ব্যানার উৎপন্ন হয় পলিভিনাইল ক্লোরাইড থেকে। বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত মোট প্লাস্টিকের পরিমাণগত দিক দিয়ে পলি ভিনাইল ক্লোরাইড তৃতীয় বৃহৎ উৎপাদিত প্লাস্টিক পণ্য। উন্নত বিশ্বতো বটেই আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, ভুটান এবং শ্রীলঙ্কাতেও পরিবেশের কথা চিন্তা করে পিভিসি ফ্লাক্স ব্যানার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পৃথিবীতে নিজেদের জাতিসত্তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এখনই আইন প্রণয়ন করে এসব পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানারের উৎপাদন বন্ধ করা জরুরি। আমরা আশাবাদী অন্তর্র্বতীকালীন সরকার দ্রুতই আইন প্রণয়ন করে পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার উৎপাদন বন্ধে যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় আইন প্রণয়নের পাশাপাশি জনগণকেও সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে এবং সকল স্তরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার ব্যবহারের প্রতিরোধে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসবে।

লেখক: প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা