বিশ্রাম মানে কাজ থেকে বিরত থাকা। শারীরিক ও মানসিক কাজ শেষে বিশ্রামে যেতে হবে। বিশ্রাম হলো এক ধরনের শারীরিক নিরাময়। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। শরীর সতেজ করতে হবে। অসুস্থতা এবং মানসিক চাপ কমাতে নিয়মিত ইভবিশ্রামে থাকতে হবে। বিশ্রাম ছাড়া লাগাতার কাজ করে যেতে থাকলে কাজের মান কমে যাবে। দেহে সুখী হরমোন বিশ্রাম থেকে আসে। প্রবীণদের দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা বিশ্রামে থাকা প্রয়োজন। যেভাবে বিশ্রাম নিতে হবে তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো। পছন্দের বই পত্রিকা পড়া, গান শোনা, খেলাধুলায় অংশগ্রহণ, টেলিভিশন দেখা, ফেসবুকে থাকা, প্রাকৃতিক পরিবেশে কিছুটা সময় কাটানো, নিজের মতো করে থাকা, সুনির্দিষ্ট কোনো কাজ না করা, হাঁটতে যাওয়া, গোসল করা, দিবাস্বপ্ন দেখা, মেডিটেশন করা, কিছু সময়ের জন্য মোবাইল ফোন নীরব করে রাখা। দিবাস্বপ্ন নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের মতভিন্নতা রয়েছে। কেউ কেউ দিবাস্বপ্ন দেখাটা মানসিক স্বাস্থ্যের অনুকূল বলে মনে করছেন।
আমি নিজেও মনে করি খানিকটা দিবাস্বপ্ন ব্যক্তিকে তৃপ্ত করতে সহায়তা করে। মানুষের জীবনে অনেক ধরনের অপ্রাপ্তি থাকে তার কিছুটা দিবাস্বপ্নের দ্বারা পূরণ হলে তেমন কোনো ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। দিবাস্বপ্ন ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবনযাপনকে যেন বিঘ্নিত না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিনোদন বলতে এমন একধরনের কাজ যা দর্শক বা শ্রোতাকে আকর্ষণ করে, আনন্দ দান করে। বিনোদনের মূলবিষয় হলো- মজা ও হাস্যরস। মানুষ সারাক্ষণ সিরিয়াস হয়ে থাকতে পারে না। জীবনে আছে দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা বেদনা, অপমান অবহেলা, ঘাত-প্রতিঘাত। মানুষ এসব মোকাবিলা করে স্বাভাবিক জীবনে থাকতে চায়। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে বিনোদন সহায়ক ভূমিকা পালন করে। দুঃখকে দুঃখ দিয়ে মোকাবিলা করা যায় না। দুঃখকে দূর করতে সুখ তৈরি করতে হয়। সুখের আবেশ দুঃখ ভুলতে সহায়তা করে। দুঃখ, অপমান, অসম্মান, কষ্টের কথা লোকজনের কাছে বললে হাল্কা হয় কি না, এসব বিষয় নিয়ে মতবেদ রয়েছে। দুঃখ-কষ্ট অপমানের কথা যতবার বলবেন, ততবারই নতুন করে ব্যথা উথলে উঠবে। দুঃখ-কষ্ট অপমানের কথা ভুলতে বিনোদন টনিক হিসেবে কাজ করে। শাস্তি দেখাকে মানুষ বিনোদন হিসেবে গ্রহণ করেছে। চোর ছিনতাইকারী ধরে যখন গণপিটুনি দেয়া হয়, তখন বেশিরভাগ মানুষই আনন্দ লাভ করে। খুব অল্প কিছুসংখ্যক মানুষই চোর ছিনতাইকারীর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। পরকীয়া, তালাক, হিলা বিয়ে, ইভটিজিং, মাদক সেবন নিয়ে গ্রাম্য সালিশ বিচারে মানুষের কৌতূহল, আগ্রহ, উপস্থিতি এক ধরনের বিনোদন হিসেবে বিবেচনা করা যায়। দুই পক্ষের ঝগড়াঝাটি যখন মারামারিতে রূপ নেয়, তখন আশপাশের মানুষ তামাশা দেখতে দেখতে হাজির হয়। কারো দুর্নাম, সমালোচনা, গালাগালি, নালিশ, অভিযোগ অনুযোগ শোনা কিছু মানুষের বিনোদন। কেউ রাস্তায় পা ফসকে পড়ে গেলে আশপাশের মানুষ হেসে উঠে। প্রতিবন্ধী মানুষ নিয়ে নানান রকমের কথা বলে কিছু মানুষ আনন্দ লাভ করে। গল্প বলা, জারি সারি, বাউল গান, কবি গান, কবিতা আবৃত্তি, অভিনয়, নাটক, যাত্রাপালা, চলচ্চিত্র, নৃত্য, প্রদর্শনী, খেলাধুলা ইত্যাদি থেকে মানুষ প্রচুর বিনোদন লাভ করে। মানুষের সর্বনাশ দেখা বোধ হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিনোদন। অবকাশ হলো কাজ থেকে দূরে থেকে নিজের মনমতো সময় কাটানো। কেউ কেউ অবকাশ আর অবসর কে এক করে বিবেচনা করেন। অবসর হলো ইচ্ছায় অনিচ্ছায় কর্মহীন হওয়া। অবসর মানে ব্যক্তির পেশাগত জীবনের অবসান। আর অবকাশ হলো ব্যক্তির আত্মতুষ্টি। প্রবীণ অবকাশ যাপন করতে পারলে সৃজনশীল কাজে ভালো করতে পারবেন। বিশেষ করে গবেষণা, লেখালেখি, বুদ্ধিমত্তার কাজে বিশেষ পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম হবে।
প্রবীণরা অবকাশে থাকতে পারলে সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে নতুন নতুন চিন্তাভাবনা অভিজ্ঞতার আলোকে জাতির সামনে হাজির করতে পারবেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের ‘ঘ’ ধারা অনুযায়ী যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার বিষয়টি মৌলিক অধিকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দুই কোটি প্রবীণের বসবাস। ২০৫০ সাল নাগাদ প্রবীণের সংখ্যা হবে চার কোটি। বিশাল এই প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশ যাপনের প্রস্তুতি তেমন একটা নজরে পড়ছে না। অতি প্রবীণ ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে সেই সাথে তাদের সেবা যত্ন নিশ্চিত করতে পরিবার এবং সমাজের তেমন কোনো উদ্যোগ আমরা দেখতে পাই না। অতি প্রবীণরা প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে মৃত্যুর কথা বলতে এবং ভাবতে থাকেন। দীর্ঘমেয়াদি পরিচর্যার ভেতরে থাকলেও একজন প্রবীণ যেন বিনোদন এবং অবকাশ যাপনের সুযোগ পায় সেরকম ব্যবস্থা, প্রস্তুতি এখন থেকে নিতে পারলে সবচেয়ে বেশি ভালো হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে বিশ্রাম, বিনোদন এবং অবকাশ প্রবীণের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার।
লেখক : কলামিস্ট