দেশ দুর্নীতিমুক্ত করতেই হবে

এ কে এম আতিকুর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব

প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিভিন্ন দেশে অবস্থিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দপ্তরের সঙ্গে একযোগে সংস্থাটির ঢাকা অফিস সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (করাপশন পারসেপশনস ইনডেক্স, সিপিআই) ২০২৩’ ঘোষণা করে। এই সূচকে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী কীভাবে গণতান্ত্রিক অনুশীলনের অবক্ষয় এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার পুনরুত্থান বিচারিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করেছে সে চিত্রটিই ফুটে উঠেছে। ডেনমার্ক সূচকে সর্বোচ্চ ৯০ স্কোর, ফিনল্যান্ড ৮৭ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় এবং নিউজিল্যান্ড ৮৫ স্কোর নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। ১১ স্কোর নিয়ে সোমালিয়া সবার নিচে রয়েছে। দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া ও ভেনিজুয়েলা যৌথভাবে তালিকার নিচ থেকে দ্বিতীয় (১৩ স্কোর) এবং ইয়েমেন ১৬ স্কোর নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।

বাংলাদেশ ২৪ স্কোর পেয়ে নিচ থেকে দশম এবং ওপর থেকে ১৪৯তম অবস্থানে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভুটান ৬৮, ভারত ৩৯, পাকিস্তান ২৯ এবং নেপাল ৩৫ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে। সংস্থাটি দুর্নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এহেন অবস্থানের জন্য অনেকগুলো বিষয়কে উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মূলত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দুর্নীতির দায়মুক্তি, নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং ক্ষমতার অনিয়ন্ত্রিত অপব্যবহারের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনিয়মের ব্যাপকতা বাংলাদেশকে একপ্রকার বাধাহীনভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত করে চলছে। দুর্নীতির বহুমুখী প্রকৃতি ও অনুশীলন সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং নানা কারণেই বাংলাদেশে দুর্নীতির বিস্তার অব্যাহত রয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সিপিআই অনুযায়ী ২০২২ সালে নিচ থেকে ১২তম এবং ২০২১ সালে ১৩তম থাকলেও ২০২৩ সালে আরো নেমে যায়। অবশ্য এর আগে অর্থাৎ ২০২০, ২০১৯ ও ২০১৮ সালেও বাংলাদেশের অবস্থান খুব একটা ওঠানামা করেনি। স্পষ্ট করে বলতে গেলে দুর্নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় তার অবস্থান সুদৃঢ় করেই চলছে। বিগত সরকারগুলোর আমলে কখনো দুর্নীতির মূলোৎপাটনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে আন্তরিক হতে দেখা যায়নি। সবাইকে দুর্নীতির ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নামের বুলি আওড়ানোতেই ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। অথচ দিন দিন দুর্নীতির মাত্রা যে বেড়ে যাচ্ছে, সে কথা জেনেবুঝেও প্রতিকারের ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

এ বছরের প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর টিআইবি ক্ষেত্রটির উন্নয়নের জন্য একটি পাঁচ দফা পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে। সংস্থাটি দুর্নীতির মামলায় দায়মুক্তি চ্যালেঞ্জ এবং প্রধান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে অরাজনৈতিক করার আহ্বান জানিয়েছে। এ ছাড়া নীতি করায়ত্তকরণ এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে কৌশলগত খাতগুলোকে রক্ষা করার ওপর জোর দেওয়ার কথা বলেছে। টিআইবি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সামগ্রিক বাকস্বাধীনতা সংরক্ষণের পরামর্শ দিয়েছে, যাতে দমনের ভয় ছাড়াই দুর্নীতিকে চ্যালেঞ্জ করা যায়। নিজের অবস্থানকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত লাভকে নিরুৎসাহ করতে সংস্থাটি রাজনৈতিক এবং আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে একটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তনের উন্নয়নের গুরুত্ব রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে।

আয়তনের বিচারে বাংলাদেশ একটি ছোট্ট দেশ। ঘনবসতিপূর্ণ সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিই জানে কারা কারা দুর্নীতিগ্রস্ত। যখন দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির অঙ্গুলিহেলনে সমাজের শ্বাস-প্রশ্বাস চলে, তখন সেই সমাজব্যবস্থায় ন্যায়, সততা ও আইনের শাসনের মৃত্যু ঘটে। দিনে দিনে সেই সমাজ দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়। সমাজ থেকে মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার, মনুষ্যত্ব ও ধর্মীয় অনুশাসনের বিলুপ্তি ঘটে। দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের দাপটে সৎ মানুষগুলো বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগও খুঁজে পায় না। দেশের প্রতিটি মানুষই দেখছে কীভাবে দুর্নীতির মাত্রা ও ব্যাপ্তি দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলছে। সবাই এসব জানা সত্ত্বেও নানা কারণেই দেশের জনগণ বাকরুদ্ধ হয়ে আছে, বলার সাহস পাচ্ছে না। দুর্নীতিবাজরা এতটাই ক্ষমতাশালী যে ‘কার ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে’ যা নিয়ে তাদের চ্যালেঞ্জ করতে এগিয়ে আসবে! কারণ তাদের পক্ষে শুধু ক্ষমতাশালীরাই থাকে না, নিজেদের বাহিনীও থাকে। তাই তাদের কাছে সবাইকে নতি স্বীকার করতেই হয়। নচেৎ কখন যে চ্যালেঞ্জকারী নিজেই লাপাত্তা হয়ে যাবে কেউ জানতেও পারবে না।

দুর্নীতি যে একটি নিরাময় অযোগ্য ব্যাধি হয়ে উঠতে পারে, বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ বারবার তা প্রমাণ করেছে। এই ব্যাধি যা তা ব্যাধি নয়, এক কঠিন ব্যামো। সারানোর মতো বদ্দি যে এ দেশে একেবারেই নেই, তেমনটি নয়। কিন্তু সেই বদ্দিকে কে ডাকবে? ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের আখের গোছাতেই যখন সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন ওই সব চিন্তা করার ফুরসত কোথায়? বলার অপেক্ষা রাখে না, এ দেশে সৎ, দায়িত্বশীল, নিষ্ঠাবান এবং দেশপ্রেমিক মানুষ সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত ও অবহেলিত। সৎ মানুষকে সেই দায়িত্ব না দেয়া হলে কীভাবে নিরাময়ের ব্যবস্থা হবে? দেশ পরিচালনায় সৎ, যোগ্য মানুষের উপস্থিতি না থাকায় দুর্নীতিবাজদের দুয়ার অবারিত হয়ে গেছে।

পৃথিবীর অনেক দেশেই কমবেশি দুর্নীতি রয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশের মতো খুব কম দেশেই দুর্নীতিবাজদের এতটা বেপরোয়া ও নির্লজ্জ হতে দেখা যায়। সর্বত্র দুর্নীতির প্রতিযোগিতা চলছে, কখনো ক্ষমতার বা প্রতিপত্তির জন্য, কখনো আবার অর্থের জন্য। তাদের রুখবে কে? ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি এই পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ে একটি লেখায় আমি দুটি উদাহরণ দিয়েছিলাম। একজন ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি ড. এ পি জে আবদুল কালাম, যিনি ২০১৫ সালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করলে সম্পদ হিসেবে কিছু বই, ব্যবহৃত কাপড়চোপড়, একটি বীণা, একটি সিডি প্লেয়ার এবং একটি ল্যাপটপ রেখে গিয়েছিলেন। আরেকজন ১৯৯৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা মানিক সরকার, যিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে যখন সরকার ছেড়ে চলে যান, তখন তার ব্যাংক হিসাবে ছিল মাত্র দুই হাজার ৪১০ টাকা।

এমনকি তার নিজের বাড়িঘর না থাকায় পার্টির অফিসে গিয়ে উঠেছিলেন। আমাদের দেশের কথা বাদই দিলাম, ভারতেও হয়তো এমন নজির বিরল। আসলে দুর্নীতির মূল কারণ হচ্ছে মানুষের লোভ, যা যেকোনো কারণেই হোক না কেন মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে দেয় এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাহীন করে তোলে। সেই ব্যক্তি তখন সততা, ব্যক্তিত্ব এবং ভালোমন্দ বোধ হারিয়ে ফেলে। দুর্নীতি করার জন্য তার মনের ভেতর যে প্রবৃত্তি কাজ করে, তা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো শুধু তাকেই নয়, সমাজব্যবস্থাকেও ধ্বংস করে দেয়। এমনকি ধর্মীয় আদর্শ এবং অনুশাসনও দুর্নীতি থেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের যেকোনো সরকারি অফিস-আদালতে, বিশেষ করে জনসেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানে, কোনো সেবা নিতে গেলেই সাধারণ মানুষকে ঘুষ দিতে হয়, না হলে কোনো সেবাই পাওয়া যায় না। এমনকি মানুষ গড়ার বা মানুষের জীবন রক্ষা করার কাজে নিয়োজিত শিক্ষক ও ডাক্তাররাও দুর্নীতিমুক্ত নন।

এদিকে চাকরি বা বদলি বাণিজ্যতেও দুর্নীতির রমরমা ব্যবসা। সরকারি প্রকল্পে যে কতভাবে দুর্নীতি হয়, তা সবারই জানা। আসলে সমাজের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে দুর্নীতির সড়ক তৈরি হয়নি। অনুকূল পরিবেশ আর লোভের প্রবল ইচ্ছায় বরং বিস্তারিত হয়ে নতুন নতুন ডালপালা আর ফুলে-ফলে দুর্নীতি নামের বৃক্ষটি আজ এক মহাবিস্ময়ের মহীরুহে পরিণত হয়েছে। তারই ছায়া-সুনিবিড় পরিমণ্ডলে মহাধুমধামে চলছে দুর্নীতিবাজদের উল্লাসের মহাকীর্তন। অন্যদিকে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন আর সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন মরীচিকার মতো দূর থেকে দূরে, দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে।

দুর্নীতিতে বাংলাদেশ যে অবস্থানে আজ দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে উত্তরণের জন্য কোনো পরিকল্পনা গ্রহণের আগেই কয়েকটি ক্ষেত্রে সংস্কারের বা নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজন হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে-১. প্রশাসন; ২. আইন-শৃঙ্খলা; ৩. কর্মকাণ্ডে দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা; ৪. সমাজে ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা; ৫. ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বিদ্যমান আয়বৈষম্য হ্রাস; ৬. তরুণ প্রজন্মের জন্য কর্মসংস্থান; ৭. রাজনীতিবিদদের গ্রহণযোগ্যতা; ৮. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন; ৯. উন্নয়ন প্রকল্পে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি; ১০. অর্থপাচার রোধের ব্যবস্থা ইত্যাদি। এ ছাড়া দুর্নীতি হ্রাসের জন্য যে বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা যেতে পারে তা হলো-ক. জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আরো কার্যকর ও বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ; খ. ব্যাংক লেনদেন, সরকারি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন ব্যবস্থাপনা, সরকারি ক্রয়-বিক্রয় এবং যেকোনো সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় ক্ষেত্রের মনিটরিং কাজে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা; গ. আন্তর্জাতিক মানে দুর্নীতি দমন কমিশনকে আধুনিকীকরণ; ঘ. সরকারি কর্মচারী এবং জনপ্রতিনিধিদের সম্পত্তি ও আয়-ব্যয়ের যথাযথ মনিটরিং কাঠামো প্রণয়ন ইত্যাদি। আমাদের দেশে ‘স্বজনপ্রীতি’ নামের আরেকটি দুর্নীতি অত্যন্ত প্রকট, যা শুধু অন্যায়ই নয়, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে অন্যতম অন্তরায়। স্বজনপ্রীতি সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে দুর্বল করে, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মেরুদণ্ডে আঘাত হানে। আর সেই দুর্বল মেরুদণ্ডের ওপর বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি কিভাবে শক্তি নিয়ে দাঁড়াবে? স্বজনপ্রীতিকে উৎসাহিত করার অর্থ দেশকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া, সমাজে অন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা।

এই মুহূর্তের বাংলাদেশের জন্য দুর্নীতির স্তর শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা বাস্তবিক অর্থেই একটি কঠিন কাজ। এ জন্য সময় দিতে হবে। প্রথমে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিতে হবে, যাতে ধীরে ধীরে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়। শুরু থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতির প্রয়োগ করতে হবে। অবশ্যই এ জন্য থাকতে হবে নেতৃত্বের সদিচ্ছা এবং বজ্রকঠিন অঙ্গীকার। তবে দুর্নীতিকে চিরতরে নির্মূল করার জন্য জনগণকেও সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ দুর্নীতির চোরাগলিতেই হারিয়ে যাবে। বর্তমান সরকার কি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম হবে, যা আগামী দিনে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারবে?