ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয়

ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম, সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ
বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয়

বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি বাংলাদেশ। সবুজ বন, নদী, নালা ও জলপ্রপাত এদেশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য আরো মনোরম করেছে। কিন্তু বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনে দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের দিক থেকে বাংলাদেশ দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে রয়েছে। এরই মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নানা কারণে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো আক্রান্ত হয়েছে জনজীবনে নেমে এসেছে নানা বিপর্যয়। বিশ্বে মানুষের যত রকম ঝুঁকি রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা তার মধ্যে অন্যতম।

বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য মূলত কার্বন ডাই অক্সাইড কে দায়ী করা হয়। কিন্তু এর সাথে মিথেন, নাইট্রস অক্সাইড, ক্লোরফ্লরো ইত্যাদি গ্যাস বিশেষ ভূমিকা রাখে। গ্রীন হাউস গ্যাসের প্রভাবে পৃথিবী ক্রমাগত উষ্ণ হচ্ছে। মানব সভ্যতার অগ্রগতি, প্রযুক্তি ও শিল্প উন্নয়নে নির্মাণকারী কারখানা, শিল্প কারখানা থেকে বায়ু মন্ডলে সি,এফ সি গ্যাস যুক্ত হচ্ছে।

মানুষের অসচেতন কর্মকাণ্ডের ফলে বায়ু মন্ডলে এসব গ্যাস যুক্ত হয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতায় ভূমিকা রাখছে।

১৯১৭ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে গ্রীন হাউজে ৭০ ভাগ গ্যাস বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত এ কারনে পৃথিবী উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে। যার পরিণতি হচ্ছে ভয়াবহ। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নতুন একটি পরিবেশগত সমস্যায় পতিত হয়েছে বাংলাদেশ।

জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে থাকা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নাম অগ্রগণ্য। বিশ্বের বড় বড় জিসিএমগুলো আগামী শতকে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার কারণে সমুদ্র সমতলের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর কোন কোন স্থানগুলো সমুদ্রতলে বিলীন হয়ে যাবে তার একটা ধারণা দিচ্ছে যার মধ্যে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৫৭টি নদী প্রবাহ ছাড়াও দেশটির দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগরের অবস্থান। দক্ষিণের উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাবে তলিয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। ১৯৯০-২০০৯ সালের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফের সমুদ্র উপকূলের পানি মেপে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। গবেষকদের ধারণা-২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে পানির উচ্চতা আরো বেড়ে যাবে এবং বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। বিশ্বে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ ৪৫ জনের মধ্যে ১ জন জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। ফলশ্রুতিতে সেখানে প্রতি ৭ জনে ১ জন উদ্বাস্তু হবে। উদ্বেগজনক তথ্য এই যে, ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। এরই মধ্যে কুতুবদিয়া এলাকার ২০ হাজার মানুষ মূল ভূখণ্ড ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, প্রতিদিনই মানুষ নদীভাঙন তথা জলবায়ু পরিবর্তনের খারাপ শিকার হয়ে ঢাকায় এসে বস্তি গড়ছে। ক্ষুদ্র আয়তনের বাংলাদেশে এমনিতে বিপুল জনসংখ্যার চাপ রয়েছে। জলবায়ু শরণার্থীর সমস্যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায়। ঢাকার মানুষ এখন ১ কোটি ৩০ লাখ। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে এখানে বাস করেন ২৭ হাজার ৭০০ মানুষ।

২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৩০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। মানুষ তার অগ্রযাত্রায় পরিবেশ থেকে নানা উপকরণ গ্রহণ করছে প্রতিনিয়ত। পরিবেশের অনেক উপাদানই আছে যার পরিমাণ সীমিত। মানুষের অনবরত ব্যবহারের ফলে প্রকৃতির অনেক উপাদানই আজ প্রায় নিঃশেষ হওয়ার পথে যার প্রভাব পড়েছে পরিবেশের উপর। ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে বিশ্বব্যাপী। আর এতে করে পরিবেশ হয়ে উঠছে মানুষের জন্য বসবাসের অনুপযোগী। পরিবেশের নানা উপাদানকে মানুষ তার প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যথেচ্ছ ব্যবহার করার ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী সার্বিক পরিবেশের বিপর্যয়কেই অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব পরিবেশ যে সকল হুমকির সম্মুখিন তা হলঃ গ্রীন হাউস ইফেক্ট, ওজোনস্তর ক্ষয়, মরুকরণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি , জৈব বৈচিত্র ধ্বংস নদ-নদীর প্রবাহ পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বৃদ্ধি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

বিশ্ব পরিবেশ বিপর্যয় দুই বা একদিন বা দুই এক বছরে সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ বছরের পর বছর মানুষ পরিবেশকে তার প্রয়োজনে ব্যবহার করতে গিয়েই পরিবেশকে বিপর্যয়ের সম্মুখীন করেছে। যার বেশির ভাগ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের মত পৃথিবীর উন্নয়নশীল দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর উপর। পৃথিবীব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয়ের এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে আগামী শতাব্দীতে পৃথিবী মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে।

মারাকেশ ঘোষণা : মারাক্কেশে ১৯০টি দেশের জলবায়ু সমঝোতাকারী প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরির চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু বিশ্বনেতারা গত বছরের সম্মেলনে ২০২০ সালের মধ্যে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরির সময়কাল ঠিক করেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, রাষ্ট্রগুলো ওই চুক্তি অনুমোদন করতে বছর তিনেক সময় নেবে। তবে গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেই ৪০টি দেশ প্যারিস চুক্তি অনুমোদন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে আদৌ স্বাক্ষর করবে কি না, তা নিয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ যেমন চীন, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) রাষ্ট্রগুলোর সংশয় ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডামাডোল শুরু হওয়ার আগেই নির্বাহী আদেশে ওই চুক্তি অনুমোদন দেন।

১৯৯৭ সালে প্রথম জলবায়ু চুক্তি কিয়োটো প্রটোকলে স্বাক্ষরের পর যুক্তরাষ্ট্র তা অনুমোদন করেনি। তাই প্যারিস চুক্তির শর্তের মধ্যে ছিল, কোনো দেশ চুক্তি অনুমোদনের চার বছরের মধ্যে তা বাতিল করতে পারবে না। ফলে যুক্তরাষ্ট্র অনুমোদনের পর বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ চীন ও ভারত তা অনুমোদন করে। মরক্কোর রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদের উদ্যোগেই মারাকেশ ঘোষণা। এক পৃষ্ঠার এই ঘোষণায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাকে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছে রাষ্ট্রগুলো।

সে জন্য প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে একমত হয়েছে ১৯৩টি রাষ্ট্র। ১৮ নভেম্বর ছিল মারাকেশ সম্মেলনের সমাপনী দিন। সম্মেলনের আয়োজক সংস্থা জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (ইউএনএফসিসিসি) ওয়েবসাইটে ওই ঘোষণা প্রকাশ করে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণকে ওই ঘোষণার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে গুরুত্ব পেয়েছে স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়ন। মারাকেশ ঘোষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সবুজ জলবায়ু তহবিলে রাষ্ট্রগুলোকে ২০২০ সালের মধ্যে এক হাজার কোটি মার্কিন ডলার দেওয়ার আহ্বান। একই সঙ্গে এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা যাতে আরো ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না বাড়ে, সে জন্য রাষ্ট্রগুলোকে কার্বন নিঃসরণ কমানোর অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য বলা হয়েছে ঘোষণায়।

প্যারিস জলবায়ু চুক্তি : পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। এর প্রভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন এবং এর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি সারা বিশ্বে বহুল আলোচিত বিষয়। একে পৃথিবীর নিরাপত্তার প্রতি গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নামে দেশে দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের অপরিমিত ও যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারী গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনও বেড়ে গেছে। এ দুটো কারণে আজকের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইউএনএফসিসিসির আওতায় ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ২১তম জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন হয়। সম্মেলনে কনভেনশনের সব সদস্য দেশ ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি জলবায়ু চুক্তি করে, যা পরিচিত ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তি নামে।

প্যারিস চুক্তির দুর্বল দিক : প্যারিস চুক্তির প্রধান দুর্বলতা হলো, বিশ্বেও সব সদস্য দেশকে—বিশেষ কওে শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোকে এই চুক্তির বাধ্যবাধকতায় আনার জন্য ছাড় দেওয়া হয়েছে। দেশগুলোর মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস, আর্থিকসহ অন্যান্য সহায়তা ইত্যাদি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা এসব দেশ নিজেরাই নির্ধারিত করবে, যা পাঁচ বছর পর পর কনভেনশন সচিবালয়ে দাখিল করবে।

প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন হবে কবে : প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরের পর যাতে প্রক্রিয়াগত কারণে তা বাস্তবায়নে দেরি না হয়, সে জন্য ১১০টি দেশ তাতে দ্রুত স্বাক্ষর করে। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নবিষয়ক সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটির সভা শুরুও হয়েছিল এবারের সম্মেলনে। যদিও কিছুক্ষণ পর তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বলা হয়েছে, আগামী বছর আলোচনা হবে। পরে বলা হয়েছে, আগামী দুই বছর প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের নীতি ও কাঠামো তৈরিতেই ব্যয় হবে। ধরে নেওয়া যায়, ২০২০ সালের আগে প্যারিস চুক্তির কার্যকর বাস্তবায়ন শুরু হচ্ছে না। আগামী দুই বছর ১১টি বিষয়ের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করে রাষ্ট্রগুলো যেসব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছবে, সে বিষয়গুলো ধরেই চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে। এবারের সম্মেলনে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় স্বল্পোন্নত রাষ্ট্র ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো হতাশ। এ পরিস্থিতিতেই মারাকেশ ঘোষণা। এর মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈশ্বিক উদ্যোগে আশার আলো জ্বালিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বাংলাদেশের অঙ্গীকার : বাংলাদেশ প্যারিসে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানোর যে অঙ্গীকারনামা (এনডিসি) জমা দিয়েছে, তাতে বলেছে, তারা নিজস্ব অর্থায়নে ৫ শতাংশ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা পেলে আরো ১০ শতাংশ অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ কমাবে। মূলত জ্বালানি, পরিবহন ও শিল্প খাত থেকে ওই কার্বন নিঃসরণ কমানোর কথা বলেছে বাংলাদেশ। বর্তমানে সারা বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুর্নিঝড়, বন্যা, খরা, ভুমি কম্পন, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড় ধস, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, পানির স্থর নিচে নেমে যাওয়া, অসময়ে অধিক বৃষ্টি ও অধিক খরাসহ বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে হিমালয়ের বরফ, উত্তর মেরু ও অ্যান্টাকটিকার বরফ গলতে শুরু করেছে। সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। গত ১০০ বছরে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ১৫ সেঃ মিঃ থেকে ২৫ সেঃ মিঃ। বছরে বৃদ্ধির হার ১.৫ সেঃ মিঃ থেকে ২.৫ সেঃ মিঃ। যা গত ৩০০ বছরের ১০ গুন। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা তাপমাত্রা এভাবে বাড়তে থাকলে আগামী শতকে সমুদ্রের উচ্চতা বছরে বৃদ্ধি পাবে ৩০ সেঃ মিঃ থেকে ৪০ সেঃ মিঃ। এর ফলে পৃথিবীর অনেক নিম্ন অঞ্চল তলিয়ে যাবে। সূত্র মতে বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি বছর ৫ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করবে। পৃথিবীর ১০ ভাগ মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। বছরে প্রায় ৩৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতি হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বায়ু মন্ডলের পুঞ্জিভূত গ্রীন হাউস গ্যাস উৎসারণে বিশ্ব উষ্ণায়নে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশে দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় ক্রমাগত ঝুঁকি বাড়ছে। সাগরে প্রতিনিয়ত নিম্নচাপ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, কৃষিকে বাধাগ্রস্ত করছে। পানি, প্রাণিসম্পদ ও নগর উন্নয়ন হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হচ্ছে এবং ভূমি, বনাঞ্চল, শিল্পবাসস্থান পশু সমস্যা প্রকট হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। উপকূলবাসীকে প্রকৃতির ঢাল হিসাবে ঘূর্ণিঝড় সিডরসহ বিভিন্ন দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে সুন্দরবন হয়েছে নিজে লন্ডভন্ড। বাংলাদেশে সংঘটিত বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ১৯৭০, ১৯৭৪, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৭, ২০০৯ সালে বন্যা ও ঝড়ে দেশের বহুলোকের মৃত্যু হয়েছে। সূত্র মতে, তাপ মাত্রা ০.৫ থেকে ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি এবং সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পায়, তবে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন পানিতে তলিয়ে যাবে। প্রতি বছর সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা ৩ মিলিমিটার করে বাড়ছে। আইপিসিসির ৪র্থ সমীক্ষায় বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে বাংলাদেশে বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বেড়েছে মে মাসে ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং নভেম্বর মাসে ০.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। গড় বৃষ্টিপাত ও মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বেড়েছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছে আগামী ৫০ বছরে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রী থেকে ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ ১ মিটার বৃদ্ধি পেতে পারে। এর ফলে সুন্দরবনসহ উপকূলীয় এলাকা তলিয়ে যাবে। উপকূলীয় ১৩ জেলার ৬৩ উপজেলার ৫৬ লাখ ৩৭ হাজার ৮ শত ৭৬ একর জমি তলিয়ে যাবে। যা দেশের মোট জমির ১৫.৮ ভাগ। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে আংশিক তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। এতে বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষ বাস্তু হারা হবে। মানুষের জীবন ও জীবিকায় নেমে আসবে বিপর্যয়। বিপন্ন হবে উপকূলীয় অঞ্চল।

মানবসভ্যতার উন্নয়ন কাযক্রমে মানুষের অসচেতন কর্মকাণ্ডে আমাদের কৃষি, বনজ, পানি, মৎস্য সম্পদগুলো ও জীববৈচিত্র্য ঝুঁকিতে পড়েছে। আরো অনিশ্চয়তায় পড়বে যদি দ্রুত জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে। তাই আর চুপ করে বসে থাকলে হবে না। সবাইকে সচেতন ও সোচ্চার হতে হবে। বিশ্ব উষ্ণায়নে যে সমস্ত গ্যাস দায়ী আমাদের অসেচতন কর্মকাণ্ডে সে সমস্ত গ্যাস সম্মেলিত উদ্যোগের মাধ্যমে পরিহার করতে হবে। উন্নত বিশ্ব দীর্ঘদিন ধরে গ্রীন হাউস গ্যাস উৎসারণ করে বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধি ঘটিয়েছে।

বিশ্ব বাসিকে সুস্থভাবে বাঁচার জন্য আবহাওয়া, জলবায়ু ও বিশুদ্ধ বায়ু নিশ্চিত করতে হবে। তাই দায়ী উন্নত দেশগুলোকে এর সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।

উন্নত বিশ্ব যাতে বিশ্বায়ন রোধে গ্রীন হাউস গ্যাস কমিয়ে আনতে বাধ্য হয় তার জন্য ব্যাপক বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ও অভিঘাত মোকাবিলায় ভুক্তভোগী উন্নয়শীল দেশগুলোকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা প্রদানে উন্নত দেশগুলোকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত