ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
নগর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্রই বিক্রি হচ্ছে নকল ও ভেজাল ওষুধ। প্রকাশ্যে এ ধরনের ওষুধ বিক্রি চললেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন। অভিযান চালিয়ে জরিমানা পর্যন্ত করে থেমে যাচ্ছে প্রশাসন। ফলে এ অপকর্মের মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।তাই দেশের ওষুধ ব্যবসা এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, যেখানে স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। সুস্বাস্থ্য রক্ষার্থে প্রয়োজন স্বাস্থ্য সচেতনতা, ডাক্তার ও ওষুধ। আর ওষুধই অসুস্থতার একমাত্র নিয়ামক। বর্তমানে বাংলাদেশে ওষুধ শিল্প অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক ভালো সময় পার করছে। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প দেশের প্রয়োজনীয় সকল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করতে সমর্থ। তাছাড়াও, দেশের অর্থনীতিতে রাখছে বিরাট ভূমিকা। বাংলাদেশের উৎপাদিত ঔষধের চাহিদা ও ব্যবহার বিশ্ববাজারে বেড়েই চলেছে। এত সব সুখবরের মধ্যে, বিশ্ববাজারে যখন বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধের চাহিদা বেড়ে চলেছে, ঠিক তখনই এর বিপরীত চিত্র দেশের ওষুধের বাজারে। দেশীয় বাজারে উৎপাদিত হচ্ছে ভেজাল ও নকল ওষুধ, যার ফলে ক্রমশই অস্থির হয়ে উঠছে ওষুধ শিল্প ও চিকিৎসাব্যবস্থা। নকল ভেজাল ওষুধ তৈরিতে জড়িত নামসর্বস্ব কিছু ওষুধ কোম্পানি এবং তথাকথিত ইউনানী ও হারবাল ওষুধ কোম্পানিগুলো।
দেশে ইউনানী ওষুধের লাইসেন্স রয়েছে প্রায় ৩০০টি যা কোনোভাবেই এক ডজনের বেশি হওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। এসব তথাকথিত প্রতিষ্ঠানের আড়ালে হুবহু ‘আসল’ মোড়কে গ্যাস্ট্রিক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনিসহ বিভিন্ন জটিল রোগের নকল ওষুধ বাজারে ছাড়া হচ্ছে। যা দেখে ভোক্তাদের আসল-নকল পরখ করা অনেকটাই দুঃসাধ্য। স্বনামধন্য এবং পরিচিত ওষুধ কোম্পানির ওষুধগুলোই নকল করা হয় বেশি। নকল ওষুধ সাধারণত রুগ্ন কারখানা বা ইউনানী-হারবালের মতো কারখানাগুলোতে উৎপন্ন হয়। রাতের শিফটে এসব নকল ওষুধ উৎপাদন করে ভেজাল সিন্ডিকেটের কুশীলবরা। কারখানা থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঢাকায় চক্রের তালিকাভুক্ত কিছু ফার্মেসির কাছে পৌঁছানো হয় এসব ভেজাল ওষুধ। মিটফোর্ড কেন্দ্রিক কিছু অসাধু ফার্মেসি নকল ভেজাল চক্রের সঙ্গে জড়িত। সেখান থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রাণঘাতী এসব নকল ওষুধ। ভেজাল ওষুধের রমরমা বাণিজ্যের কারণে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে এবং মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এ নকল ভেজাল ওষুধ তৈরি ও বিপণনের অপরাধকে জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। কিন্তু তার প্রয়োগ নেই।
ভেজাল ওষুধে সয়লাব : একই জেনেরিক নামের ওষুধ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করলেও একেকটির মান একেকরকম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদারকির অভাবেই নিম্নমানের ওষুধ দেদার বিক্রি হচ্ছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এখন দেশে ২৪১টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩০ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ বানাচ্ছে। যেকোনও ওষুধ বাজারজাত করার আগে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমতি নিয়ে বাজারজাত করতে হয়। কিন্তু একবার বাজারজাত করার পর সেই ওষুধের গুণগত মান নিয়ে আর কোনও তদারকি হয় না। এই সুযোগেও অনেক নামসর্র্বস্ব প্রতিষ্ঠান ওষুধের মান কমিয়ে দেয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফার্মেসি মালিক বলেন, ‘বড় ও নামকরা কোম্পানির ওষুধের দাম বেশি। কিন্তু অন্য আরেক কোম্পানি একই ওষুধ কমদামে বিক্রি করে। এজন্য অনেক ফার্মেসি মালিক প্রেসক্রিপশন দেখে জেনেরিক নাম ঠিক রেখে ব্র্যান্ড বদলে দেয়। তাদের কাছে লাভটাই বড়, মান নয়।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কাজ হলো মাঝে মাঝে বাজার থেকে ওষুধ সংগ্রহ করে মান পরীক্ষা করা। কিন্তু তাদের ল্যাবরেটরির সক্ষমতা কম। এই সুযোগ কাজে লাগায় অনেক কোম্পানি। লোকবলের অভাব ও ক্যাপাসিটি না থাকার দোহাই দিয়ে কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় না। তাই এ বিষয়ে সরকার সক্রিয় হলে নকল ভেজাল রোধে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। নকল এবং ভেজাল ওষুধের বাজার বন্ধ না করতে পারে ওষুধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা দিনে দিনে কমে আসবে। এতে বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারে স্বাস্থ্য খাত। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজারে যে ওষুধ বিক্রি করা হয় তার ১৫ শতাংশ ওষুধই নিম্নমানের, ভেজাল বা নকল। জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির এক প্রতিবেদন মতে, দেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি হয়।
লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি